হোকান ডাভিডসন | জীবনকাহিনি
বাইবেলের সত্য ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে সাহায্য করা
সুইডেনে আমার জন্ম হয় আর সেখানে আমি বড়ো হয়ে উঠি আমি যখন কিশোর ছিলাম, তখন যে-সমস্ত লোকেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হই। তাই যখন আমার বাবা, মা এবং ছোটো বোন যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করে, তখন তাতে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।
পরে যখন বাবা বার বার বাইবেল অধ্যয়নে বসতে বলে, তখন আমি তাদের সঙ্গে বসি। বাইবেল আলোচনার সময় যখন বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়গুলো আসে, তখন এগুলো যে এতটাই নিখুঁত তা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। আমি ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করি, বাইবেল ঈশ্বরেরই বাক্য আর যিহোবার সাক্ষিরা সঠিকভাবে তা শেখায় এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপনও করেন। ১৯৭০ সালে আমি ও আমার বাবা একসঙ্গে বাপ্তিস্ম নিই আর এর কয়েক বছর পর আমার মা ও দুই বোন তারাও বাপ্তিস্ম নেন।
আমার যখন ১৭ বছর বয়স ছিল, তখন আমি দেখতাম আমার সঙ্গীসাথিদের মধ্যে বেশিরভাগই পার্টি নিয়ে মেতে থাকত। আসলে তাদের এই বাঁধন ছাড়া জীবনযাপন দেখে আমিও আকর্ষিত হই। কিন্তু আমাকে যারা বাইবেল অধ্যয়ন করিয়েছিলেন তাদের পূর্ণসময় সেবাতে আনন্দ ও সন্তুষ্টি দেখে আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছি আর ২১ বছর বয়সে আমি সেই লক্ষ্যে পৌঁছোতে পেরেছি।
অগ্রগামী সেবায় আমি অনেক আনন্দ খুঁজে পেয়েছি আর এখন আক্ষেপ হয় যে, কেন আরও আগে এটা শুরু করিনি। বিশেষ করে আমি যখন গোটেনবার্গ বন্দরে মালবাহী জাহাজের বিদেশি ভাষাভাষীর নাবিকদের কাছে প্রচার করি এবং সত্য বিষয়গুলো জানাই, তখন আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি।
গত ৫০ বছর ধরে আমি এক বিশেষ পদ্ধতিতে লোকদের সাহায্য করেছি, যাতে বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকদের কাছে সুসমাচারের বার্তা পৌঁছে যায়। এখন বলছি কীভাবে সমস্ত কিছু শুরু হয়েছিল।
মেপস্ নিয়ে কাজ করা
অগ্রগামীর সেবা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি একটা ছাপাখানায় টাইপোগ্রাফার হিসেবে পার্টটাইমের কাজ করি। সেই সময় মুদ্রণ শিল্পে একটা বড়ো পরিবর্তন হতে শুরু করে। ছাপার ক্ষেত্রে সীসা ধাতু ব্যবহার করার পরিবর্তে অক্ষর এবং আঁকা ছবিগুলোর ফটো তুলে সেগুলো ছাপার কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়। আমি এমন আধুনিক টাইপসেটিং যন্ত্রের ব্যবহার শিখি, যেটা কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত এবং এভাবে ছাপাখানায় যে-প্লেট ব্যবহার হয় সেগুলো প্রস্তুত করতাম।
১৯৮০ সালে আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী, হেলেনকে বিয়ে করি। আমার মত তারও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতে এবং নতুন নতুন সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানতে ভালো লাগত। আমাদের লক্ষ্য ছিল গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেওয়া এবং মিশনারি হিসেবে সেবা করা।
যেহেতু টাইপোগ্রাফি সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা ছিল, তাই আমাকে ও হেলেনকে সুইডেনের বেথেলে সেবার জন্য ডাকা হয়। সংগঠন ছাপার পদ্ধতিগুলো আরও কার্যকরী করার জন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হয়। সেইজন্য, ১৯৮৩ সালে আমাদের নিউইয়র্কের ওয়ালকিল বেথেলে ডাকা হয়, যাতে সেখানে ভাইয়েরা যে-নতুন পদ্ধতি, মাল্টিল্যাঙ্গুয়েজ ইলেকট্রনিক ফটোটাইপসেটিং সিস্টেম (MEPS) a তৈরি করছিল, সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারি।
মেপস্ হল এমন একটা কম্পিউটার পরিচালিত পদ্ধতি, যেখানে লেখাগুলো বিভিন্ন ভাষার লিপিতে টাইপ করা হয় আর এর সঙ্গে থাকা ছবিগুলো জুড়ে দিয়ে ছাপার জন্য কম্পোজ করা যায়। আমাদের কাজ ছিল মেপস্ ব্যবহার করে নতুন ভাষার লিপি তৈরিতে সাহায্য করা, যাতে আরও বেশি ভাষায় আমাদের প্রকাশনা ছাপানো যায়। এখন কয়েক দশক পর, যিহোবার সাক্ষিরা ১০০০-এরও বেশি ভাষার প্রকাশনা ব্যবহার করে সুসমাচার ঘোষণা করছে।
পরে, আমি আর হেলেন এশিয়াতে এক কার্যভার পাই, যাতে মেপস্-এ আরও বেশি ভাষা যোগ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারি। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আরও অনেক ভাষায় লোকদের কাছে সুসমাচার পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারা, আমাদের কাছে এক বড়ো সম্মানের বিষয়।
খুবই আলাদা ধরনের এক সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া
১৯৮৬ সালে আমি আর হেলেন ভারতে পা রাখি আর আমাদের খুবই আলাদা ধরনের এক সংস্কৃতির মুখোমুখি হতে হয়। আমরা যখন বোম্বে বা এখন যেটাকে মুম্বাই বলা হয়, সেখানে পৌঁছাই, তখন চারিদিকের পরিবেশ দেখে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। সুইডিশ এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। সেজন্য এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা সত্যি সত্যি বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য চিন্তা করতে থাকি।
এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর, আমরা দু-জনেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই আর বলি, আমরা সবসময় মিশনারি হতে চেয়েছিলাম। আর এখন, যখন আমাদের বিদেশে সেবা করার সুযোগ এসেছে, কীভাবে আমরা তা ছেড়ে দিতে পারি? তাই, আমাদের এখন এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে অবশ্যই মানিয়ে নিতে হবে।
দেশে ফিরে না গিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আমরা যতটা পারব এই ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতিতে নিজেদের মানিয়ে নেব আর আমরা যখন তা করতে থাকি, তখন খুব তাড়াতাড়ি ভারতকে ভালোবাসতে শুরু করি। এমনকী আমরা গুজরাটি আর পাঞ্জাবি ভাষাও শিখে ফেলেছিলাম।
যখন মিয়ানমারে যাই
১৯৮৮ সালে আমাদের মিয়ানমারে পাঠানো হয়, যেটা চিন, ভারত এবং থাইল্যান্ড দেশ দিয়ে ঘেরা। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল আর সেখানে বেশির ভাগ জায়গায় সামরিক শাসন চলছিল। তখনও পর্যন্ত মেপস্-এ ব্যবহার করার জন্য সেখানকার ভাষার কোনো লিপি ছিল না আর অন্য কোনো সফ্টওয়্যারও তা তৈরি করতে পারেনি। তাই, সেখানে গিয়ে আমাদের প্রথম কাজ ছিল সেই ভাষার লিপিগুলো ডিজাইন করা আর সেই নতুন লিপির ফাইলগুলো ওয়ালকিলে নিয়ে গিয়ে মেপস্-এ আপলোড করা।
ফিরে যাওয়ার জন্য যখন আমরা এয়ারপোর্টে যাই, হেলেনের হ্যান্ডব্যাগে সেই নতুন লিপির ছবিগুলো ছিল। যেহেতু সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই অস্থির ছিল, তাই সীমান্ত রক্ষীরা যদি আমাদের হাতে মিয়ানমার ভাষার কোনো পত্রপত্রিকা পেত, তাহলে আমাদের গ্রেপ্তার করে ফেলত। কিন্তু হেলেনকে যখন সার্চ করা হয়, তখন সে সেই ব্যাগটা হাতে নিয়েই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল আর সেটা কেউ লক্ষই করেনি।
পরবর্তী সময়ে, মিয়ানমারের অনুবাদকদের এই নতুন লিপি দেওয়ার পাশাপাশি ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং মেপস্-এর প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সেখানকার বেশিরভাগ অনুবাদকই আগে কখনো কম্পিউটার দেখেনি। কিন্তু এই নতুন বিষয় শেখার জন্য তারা খুবই আগ্রহী ছিল। এখন তাদের আর সেই মান্ধাতা আমলের ছাপার পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে হত না, যে-পদ্ধতিতে তাদের হাতে করে সীসার অক্ষরগুলো বসাতে হত। এখন এই নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে আমাদের প্রকাশনার গুণগত মান খুব তাড়াতাড়ি উন্নত হতে থাকে।
যখন আমরা নেপালে যাই
১৯৯১ সালে আমাকে আর হেলেনকে নেপালে সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়, যে-দেশটা হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশে অবস্থিত ছিল। সেই সময়ে নেপালে কেবলমাত্র একটাই মণ্ডলী ছিল আর নেপালি ভাষায় অল্প কিছু প্রকাশনা পাওয়া যেত।
অল্প সময়ের মধ্যেই আরও বেশি প্রকাশনা অনুবাদ করা হয় এবং সেই এলাকার লোকদের কাছে বিতরণ করা হয়। বর্তমানে, নেপালে ৪০-টারও বেশি মণ্ডলীতে প্রায় ৩,০০০ সাক্ষি রয়েছে আর ২০২২ সালে যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর স্মরণার্থ সভায় ৭,৫০০-রও বেশি লোক উপস্থিত ছিল।
লাহু ভাষায় এক ব্রোশার
১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরকে কেন্দ্র করে মিশনারিরা লাহু নামে পার্বত্য উপজাতির লোকদের কাছে প্রচার করা শুরু করে। লাহু ভাষায় যারা কথা বলে তারা চীন, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের সীমান্ত বরাবর এলাকায় বসবাস করে। তবে, সেই ভাষায় আমাদের কোনো প্রকাশনা পাওয়া যেত না।
মিশনারিদের সঙ্গে স্টাডি করছিলেন এমন এক যুবক,“দেখো! আমি সকলই নুতন করিতেছি” ব্রোশারটা থাই ভাষা থেকে লাহু ভাষায় অনুবাদ করেন। পরে, তিনি ও গ্রামের লোকেরা যারা সেই ভাষায় কথা বলে, তারা টাকা সংগ্রহ করে। তারপর, সেই টাকা আর লাহু ভাষায় অনুবাদ করা ব্রোশারটা তারা শাখা অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এই ব্রোশারের সঙ্গে তারা যে-চিঠি পাঠিয়েছিল, তাতে তারা লিখেছিল যে, এই ব্রোশার থেকে তারা যে-সত্য শিখেছে, তা যেন সমস্ত লাহু ভাষার লোকেরাও জানতে পারে।
কিছু বছর পর, আমার আর হেলেনের লাহু ভাষার অনুবাদকদের মেপস্-এর জন্য ট্রেনিং দেওয়ার সুযোগ হয়। সেই অনুবাদকদের মধ্যে একজন ভাই ছিলেন, যিনি সম্প্রতি বাপ্তিস্ম নিয়ে চিয়াং মাই অনুবাদ অফিসে সেবা করা শুরু করেন। আর আমরা এটা জেনে অবাক হয়ে যাই যে, তিনিই ছিলেন সেই যুবক, যিনি “দেখো!” ব্রোশারটা লাহু ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
১৯৯৫ সালে আমি আর হেলেন মেপস্ সংক্রান্ত আরও বিষয় শেখানোর জন্য ভারতে আসি, যেগুলো এই শাখায় থাকা অনুবাদকদের তাদের কাজ ভালোভাবে করার জন্য প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে, সেখানে আরও অনেক ভাষায় যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশনা পাওয়া যায়, যেগুলো ব্যবহার করে লোকেরা অধ্যয়ন করতে পারে আর বাপ্তিস্মের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
এক পুরস্কৃত জীবন
আমি আর হেলেন ১৯৯৯ সাল থেকে ব্রিটেন শাখা অফিসে সেবা করছি। বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ে যে-মেপস্ প্রোগ্রামিং টিম আছে, তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করি। লন্ডনের গুজরাটি এবং পাঞ্জাবি এলাকায় আমরা অনেকটা সময় ব্যয় করে প্রচার করি আর এতে আমরা খুবই আনন্দ পাই। যখন jw.org ওয়েবসাইটে কোনো নতুন ভাষা যুক্ত হয়, তখন আমরা আমাদের এলাকায় থাকা সেই ভাষার লোকদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, যাতে তাদের কাছে প্রচার করতে পারি।
আমি এখন খুবই আনন্দিত যে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পার্টিতে মেতে থাকার পরিবর্তে, যুবক বয়সেই যিহোবাকে সেবা করার লক্ষ্য স্থাপন করেছিলাম। আমি আর হেলেন যখন পিছনে ফিরে তাকাই তখন চিন্তা করি যে, পূর্ণ সময় সেবা করার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল আর তা নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই কাজের জন্য ৩০-টারও বেশি দেশে ভ্রমণ করে আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছি আর নিজের চোখে দেখেছি যে, কীভাবে প্রত্যেক জাতি ও বংশ ও ভাষার লোকদের কাছে সুসমাচার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।—প্রকাশিত বাক্য ১৪:৬.
a এখন এটাকে মাল্টিল্যাঙ্গুয়েজ ইলেকট্রনিক পাবলিশিং সিস্টেম বলা হয়। ডিজিটাল প্রকাশনা তৈরি করার ক্ষেত্রেও মেপস্ ব্যবহার করা হয়।