সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

এক মূল্যবান খ্রিস্টীয় উত্তরাধিকার আমাকে উন্নতি করতে সাহায্য করেছে

এক মূল্যবান খ্রিস্টীয় উত্তরাধিকার আমাকে উন্নতি করতে সাহায্য করেছে

মাঝরাতে, শক্তিশালী নাইজার নদী আমাদের পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই নদীর জল খুব দ্রুত গতিতে বয়ে যায় এবং এটা প্রায় ১.৬ কিলোমিটার (এক মাইল) চওড়া। নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল আর তাই নাইজার নদী পার হওয়া খুবই বিপদজনক হতে পারত। তা সত্ত্বেও, আমাদের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল আর তা-ও একাধিক বার। কীভাবে আমি এইরকম এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছিলাম? তা জানার জন্য আসুন, আমার জন্মের আগের সময়ে ফিরে যাই।

১৯১৩ সালে আমার বাবা জন মিলজ নিউ ইয়র্ক সিটি-তে বাপ্তিস্ম নেন। সেই সময়ে তার বয়স ছিল ২৫ বছর। ভাই রাসেল বাপ্তিস্মের বক্তৃতা দেন। এর অল্পসময় পরই, বাবা ত্রিনিদাদে চলে যান। সেখানে তিনি কন্‌স্ট্যান্স ফার্মার নামে একজন উদ্যোগী বাইবেল ছাত্রীকে বিয়ে করেন। বাবা তার বন্ধু উইলিয়াম আর. ব্রাউনকে “ফটো-ড্রামা অভ্‌ ক্রিয়েশন” দেখানোর জন্য সাহায্য করেন। তারা ১৯২৩ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে সেই কাজ করে চলেন। এরপর, সেই বছরেই ভাই ও বোন ব্রাউনকে পশ্চিম আফ্রিকায় কার্যভার দেওয়া হয়। বাবা ও মা, দু-জনেই স্বর্গীয় আশা সম্পন্ন ছিলেন আর তারা ত্রিনিদাদেই তাদের কাজ চালিয়ে যান।

বাবা-মা আমাদের ভালোবাসতেন

আমার বাবা-মায়ের নয় সন্তান ছিল। সেইসময়ের ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ভাই রাদারফোর্ডের নাম অনুযায়ী তারা তাদের প্রথম সন্তানের নাম রাখেন। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর আমার জন্ম হয়। তারা স্বর্ণযুগ, ইংরেজি, (বর্তমানে সজাগ হোন!) পত্রিকার সম্পাদক ক্লেটেন. জে. উড্‌ওয়ার্থের নাম অনুযায়ী আমার নাম রাখেন। আমাদের বাবা-মা আমাদের সবাইকে মৌলিক শিক্ষা প্রদান করেন, তবে তারা যিহোবার সেবায় বিভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি বেশি জোর দেন। শাস্ত্র থেকে অকাট্য যুক্তি করার বিষয়ে মায়ের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। আর বাবা আমাদের নাটকের আকারে অঙ্গভঙ্গি করে বাইবেলের বিভিন্ন গল্প বলতে ভালোবাসতেন।

তাদের প্রচেষ্টা উত্তম ফল নিয়ে আসে। আমাদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেয়। আর আমাদের বোনদের মধ্যে তিন জন ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে অনেক বছর ধরে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করে। তাদের শিক্ষা ও উত্তম উদাহরণের মাধ্যমে বাবা-মা আমাদের “সদাপ্রভুর বাটীতে” রোপন করেন। তাদের উৎসাহ আমাদের সেখানে থাকতে এবং “আমাদের ঈশ্বরের প্রাঙ্গণে” উৎফুল্ল হতে বা উন্নতি করতে সাহায্য করে।—গীত. ৯২:১৩.

আমাদের বাড়ি প্রচার কাজের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। অগ্রগামীরা সেখানে একত্রিত হতো এবং প্রায়ই কানাডার একজন মিশনারি ভাই জর্জ ইয়াং-এর বিষয়ে কথা বলত, যিনি ত্রিনিদাদ পরিদর্শন করেছিলেন। আমাদের বাবা-মা উদ্যমের সঙ্গে তাদের প্রাক্তন সঙ্গীদের বিষয়ে অর্থাৎ ভাই ও বোন ব্রাউনের বিষয়ে কথা বলতেন, যারা সেই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় ছিলেন। এই সমস্ত কিছু আমাকে ১০ বছর বয়সেই ক্ষেত্রের পরিচর্যা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে।

প্রাথমিক কার্যকলাপ

আমাদের পত্রিকাগুলো বিস্ফোরকের মতো ছিল। সেগুলোতে মিথ্যা ধর্ম, লোভী ব্যাবসাবাণিজ্য ও নোংরা রাজনীতির বিষয়ে খোলাখুলিভাবে তুলে ধরা হতো। এর ফলে, ১৯৩৬ সালে পাদরিরা দ্রুত রাজ্যপালকে চাপ দিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের সমস্ত প্রকাশনাকে নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করায়। আমরা সাহিত্যাদি লুকিয়ে রাখি, তবে সেগুলোর সমস্তই শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত সেগুলো ব্যবহার করে যাই। আমরা দলগতভাবে হেঁটে অথবা সাইকেল চালিয়ে প্ল্যাকার্ড ও ইস্তাহার ব্যবহার করে প্রচার করি। এর পাশাপাশি, আমরা সাউন্ড-কার গ্রুপের সাহায্যে টুনাপুনা শহর থেকে শুরু করে এমনকী ত্রিনিদাদের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও প্রচার করি। এটা খুবই রোমাঞ্চকর ছিল! এই আধ্যাত্মিক পরিবেশ আমাকে ১৬ বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিতে অনুপ্রাণিত করে।

টুনাপুনা সাউন্ড-কার গ্রুপ

পারিবারিক উত্তরাধিকার এবং এই প্রাথমিক অভিজ্ঞতাগুলো আমার মনে মিশনারি হওয়ার এক গভীর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। সেই আকাঙ্ক্ষা তখনও জীবিত ছিল, যখন আমি ১৯৪৪ সালে আরুবায় যাই এবং ভাই এড্‌মান্ট ডব্লু. কামিঙ্গজের সঙ্গে যোগ দিই। ১৯৪৫ সালে আমরা স্মরণার্থ সভায় ১০ জন ব্যক্তিকে একত্রিত করতে পেরে খুবই আনন্দিত হই। পরের বছর সেই দ্বীপে প্রথম মণ্ডলী গঠিত হয়।

ওরিসের সঙ্গে আমি নতুনভাবে জীবন শুরু করি

এর অল্পসময় পরই, আমি ওরিস উইলিয়ামজ নামে একজন সহকর্মীর কাছে রীতিবহির্ভূতভাবে সাক্ষ্য দিই। ওরিস তার শেখা মতবাদগুলো নিয়ে অনেক যুক্তিতর্ক করে। তবে, বাইবেল অধ্যয়নের মাধ্যমে ঈশ্বরের বাক্য আসলে কী শেখায়, তা ও জানতে পারে এবং ১৯৪৭ সালের ৫ জানুয়ারি বাপ্তিস্ম নেয়। ইতিমধ্যেই আমরা প্রেমে পড়ি আর বিয়ে করি। ও ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাস থেকে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করে। ওরিসের সঙ্গে আমি নতুনভাবে জীবন শুরু করি।

নাইজেরিয়ায় এক রোমাঞ্চকর সেবা

১৯৫৫ সালে আমাদের গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই বিশেষ সুযোগ পেয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আমরা দু-জনেই আমাদের চাকরি ছেড়ে দিই, আমাদের বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি করে দিই এবং আরুবাকে বিদায় জানাই। ১৯৫৬ সালের ২৯ জুলাই আমরা গিলিয়েড-এর ২৭তম ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হই এবং আমাদের নাইজেরিয়ায় সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়।

১৯৫৭ সালে নাইজেরিয়ার লাগোসে বেথেল পরিবারের সঙ্গে

অতীতের কথা স্মরণ করে ওরিস বলে: “যিহোবার পবিত্র আত্মা একজন ব্যক্তিকে তার মিশনারি জীবনের বিভিন্ন উত্থান-পতনের সময়ে রদবদল করার জন্য সাহায্য করতে পারে। আমি কখনোই আমার স্বামীর মতো মিশনারি হতে চাইনি। এর পরিবর্তে, আমি একজন গৃহিণী হিসেবে সন্তান বড়ো করে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, আমি যখন এটা উপলব্ধি করি যে, প্রচার করা কতটা জরুরি, তখন আমি আমার এই চিন্তাধারা পরিবর্তন করি। আর আমরা যখন গ্র্যাজুয়েট হই, তখন আমি ইতিমধ্যেই একজন মিশনারি হিসেবে প্রচার করার জন্য প্রস্তুত ও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হই। আমরা যখন কুইন মেরি জাহাজে চড়ি, তখন ভাই নরের অফিস থেকে আসা ওয়ার্থ থোর্নটেন নামে একজন ভাই আমাদের যাত্রার উদ্দেশে শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, আমরা বেথেলে সেবা করব। এটা শুনে আমি একটু নিরুৎসাহিত হয়ে যাই। কিন্তু, আমি দ্রুত রদবদল করি এবং বেথেল সেবাকে উপভোগ করতে শুরু করি। আমি সেখানে বিভিন্ন কার্যভার লাভ করি। সবচেয়ে বেশি আমি যে-কাজটা উপভোগ করি, সেটা হল রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করা। আমি লোকেদের ভালোবাসি আর এই কাজের কারণে আমি নাইজেরিয়ার ভাই-বোনদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারি। সেখানে অনেকে ধুলোবালি মেখে, ক্লান্ত হয়ে, তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় আসত। তারা যাতে প্রয়োজনীয় সতেজতা ও স্বস্তি লাভ করতে পারে, সেইজন্য তাদের সাহায্য করতে পারাটা সত্যিই অনেক আনন্দের এক বিষয়। এই সমস্ত কিছুই যিহোবাকে পবিত্র সেবা প্রদান করার একটা অংশ আর এটাই আমাকে পরিতৃপ্ত ও আনন্দিত করে।” হ্যাঁ, প্রতিটা কার্যভারই আমাদের উন্নতি করতে সাহায্য করে।

১৯৬১ সালে ত্রিনিদাদে আমরা পরিবারগতভাবে একত্রে মিলিত হই আর সেখানে ভাই ব্রাউন আফ্রিকার কিছু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আমাদের বলেন। এরপর, আমি নাইজেরিয়ায় আমাদের উন্নতি সম্বন্ধে কিছু তথ্য তুলে ধরি। ভাই ব্রাউন প্রেমের সঙ্গে আমার কাঁধের উপর হাত রাখেন এবং আমার বাবাকে বলেন: “জনি, তুমি আফ্রিকায় যেটা করতে পারোনি, উড্‌ওয়ার্থ সেটা করে দেখিয়েছে!” উত্তরে বাবা বলেন: “এভাবেই এগিয়ে চলো, ওয়ার্থ! এগিয়ে চলো!” এইরকম আধ্যাত্মিকভাবে পরিপক্ব ব্যক্তিদের কাছ থেকে উৎসাহ লাভ করা পরিচর্যাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন করার বিষয়ে আমার আকাঙ্ক্ষাকে গভীর করে তোলে।

উইলিয়াম “বাইবেল” ব্রাউন ও তার স্ত্রী আ্যন্টোনিয়া আমাদের অনেক উৎসাহিত করেন

১৯৬২ সালে আমি ৩৭তম গিলিয়েড ক্লাসের ১০ মাসের কোর্স থেকে আরও প্রশিক্ষণ লাভ করার বিশেষ সুযোগ পাই। এরপর, নাইজেরিয়ার শাখা অধ্যক্ষ ভাই উইলফ্রেড গুচ ৩৮তম ক্লাসে যোগ দেন এবং তাকে ইংল্যান্ডে কার্যভার দেওয়া হয়। সেইসময় নাইজেরিয়া শাখা দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। ভাই ব্রাউনের উদাহরণ অনুসরণ করে আমি প্রচুর ভ্রমণ করি, যাতে আমি নাইজেরিয়ায় আমার প্রিয় ভাইদের ভালোভাবে জানতে পারি ও তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে পারি। যদিও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় নাইজেরিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে কম বস্তুগত বিষয় রয়েছে কিন্তু তাদের আনন্দ ও সন্তুষ্টি স্পষ্টভাবে এটা দেখায় যে, এক উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন অর্থ অথবা বস্তুগত বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। এইরকম পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তারা যেভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ও মার্জিত পোশাক পরে সভায় আসে, সেটা দেখা সত্যিই বিস্ময়কর। সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য অনেকে ট্রাক ও বলাকেজাসে * (স্থানীয়ভাবে নির্মিত চারিদিক খোলা এক ধরনের বাস) করে আসে। প্রায়ই এই বাসগুলোতে আগ্রহজনক স্লোগান লেখা থাকত। সেগুলোর মধ্যে একটা হল: “বিন্দু বিন্দু জলে মহাসাগরের সৃষ্টি।”

সেই স্লোগানটা কতই-না সত্য! প্রতিটা প্রচেষ্টাই মূল্যবান; আমরাও এতে অবদান রাখি। ১৯৭৪ সালে নাইজেরিয়ার প্রকাশকের সংখ্যা ১,০০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নাইজেরিয়াই প্রথম এই সংখ্যায় পৌঁছায়। কতই-না উন্নতি লক্ষ করা যায়!

এই উন্নতির মধ্যে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। কয়েক মাসের জন্য নাইজার নদীর বিয়াফ্রান এলাকায় থাকা আমাদের ভাই-বোনদের সঙ্গে শাখা অফিসের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের জন্য আমাদের আধ্যাত্মিক খাদ্য নিয়ে যেতেই হতো। শুরুতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, প্রার্থনা ও যিহোবার উপর আস্থা রেখে আমরা একাধিক বার নদী পার করি।

নাইজার নদী পার করার সেই বিপদজনক যাত্রাগুলোর কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বন্দুকবাজ সৈনিক, বিভিন্ন রোগ ও অন্যান্য বিপদ থাকা সত্ত্বেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিই। সরকারি সৈন্যদের অতিক্রম করে যাওয়াটা ইতিমধ্যেই কঠিন ছিল কিন্তু নদীর ওপারে যেহেতু আন্দোলন চলছিল, তাই সেটা আরও বেশি বিপদজনক ছিল। এক বার, আমি রাতের বেলায় একটা ছোটো নৌকা করে অশান্ত নাইজার নদী পার হয়ে আসাবা শহর থেকে ওনিচা শহরে যাই আর তারপর আমি এনুগু শহরের অধ্যক্ষদের উৎসাহিত করি। আরেকটা যাত্রা আবা নামে এক শহরের প্রাচীনদের শক্তিশালী করেছিল, যেখানে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার রাতের বেলায় বাড়ির আলো বন্ধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। সরকারি সৈন্য যখন বিয়াফ্রানের সন্ত্রাসবাদীদের শহরের বাইরে পরাজিত করে, তখন পোর্ট হারকার্ট শহরে আমাদের সভা চলছিল। আমরা প্রার্থনা করে দ্রুত আমাদের সভা শেষ করি।

আমাদের প্রিয় ভাইদের যিহোবার প্রেমময় যত্নের বিষয়ে আশ্বস্ত করার এবং নিরপেক্ষতা ও একতার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য সেই সভাগুলোর বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল। নাইজেরিয়ার ভাইয়েরা সেই ভয়ংকর দ্বন্দ্বের সময়ে ধৈর্য ধরার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল। তারা প্রেম দেখানোর মাধ্যমে সেই জাতিগত হিংসা অতিক্রম করেছিল এবং খ্রিস্টীয় একতা বজায় রেখেছিল। সেই পরীক্ষার সময়ে তাদের পাশে থাকতে পারাটা সত্যিই এক বিশেষ সুযোগ ছিল!

১৯৬৯ সালে নিউ ইয়র্ক-এর ইয়াংকি স্টেডিয়ামে “পৃথিবীতে শান্তি” নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেটার সভাপতি ছিলেন ভাই মিল্টন জি. হেন্‌শেল আর আমি ওনার সহকারী ছিলাম। আমি ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। এটা সময়োপযোগী ছিল কারণ ১৯৭০ সালে আমরা নাইজেরিয়ার লাগোসে “প্রীতির পাত্র” নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত করি। গৃহযুদ্ধের ঠিক পরেই অনুষ্ঠিত হওয়া এই সম্মেলন একমাত্র যিহোবার আশীর্বাদের কারণেই সফল হয়। এটা এক নজিরবিহীন সম্মেলন ছিল কারণ এটা ১৭টা ভাষায় অনুষ্ঠিত হয় এবং এখানে ১,২১,১২৮ জন উপস্থিত হয়। ভাই নর ও ভাই হেন্‌শেল আর সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড থেকে আসা অতিথিরা এক বৃহৎ খ্রিস্টীয় বাপ্তিস্ম দেখেন। এই সম্মেলনে ৩,৭৭৫ জন ব্যক্তি বাপ্তিস্ম নেয়। পঞ্চাশত্তমীর পর থেকে সেই সময় পর্যন্ত এত লোক একসঙ্গে কখনোই বাপ্তিস্ম নেয়নি! সেই সম্মেলন সংগঠিত করার কাজে আমি সাহায্য করেছিলাম আর এটাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময় ছিল। প্রকাশকদের এভাবে বৃদ্ধি পাওয়াটা সত্যিই এক অসাধারণ বিষয় ছিল!

“প্রীতির পাত্র” নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১,২১,১২৮ জন ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিল, যেটা ১৭টা ভাষায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর এর অন্তর্ভুক্ত হল ইবো ভাষা

৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি নাইজেরিয়ায় কখনো কখনো একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে এবং পশ্চিম আফ্রিকায় একজন আঞ্চলিক অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করা উপভোগ করি। মিশনারিদের প্রতি যে-ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখানো হয়েছিল এবং তারা যে-উৎসাহ লাভ করেছিল, সেগুলোর জন্য তারা কতই-না কৃতজ্ঞ হয়েছিল! তাদের যে ভুলে যাওয়া হয়নি, এই বিষয়ে আশ্বস্ত করতে পারাটা, কতই-না আনন্দের এক বিষয় ছিল! এই কাজ আমাকে শিখিয়েছে যে, লোকেদের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখানো হল তাদের উন্নতি করতে সাহায্য করার এবং যিহোবার সংগঠনকে শক্তিশালী করার আর সেইসঙ্গে একতা বজায় রাখার চাবিকাঠি।

একমাত্র যিহোবার সাহায্যেই আমরা গৃহযুদ্ধ ও অসুস্থতার সময়ে টিকে থাকতে পেরেছি। যিহোবার আশীর্বাদ সবসময় লক্ষ করেছি। ওরিস বলে:

“আমাদের দু-জনেরই একাধিক বার ম্যালেরিয়া হয়। এক বার তো আমার স্বামীকে অচেতন অবস্থায় লাগোসের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে বলা হয় যে, ও আর বাঁচবে না কিন্তু ও বেঁচে যায়! ও যখন জ্ঞান ফিরে পায়, তখন ও ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে একজন পুরুষ নার্সকে জানায়, যিনি ওর যত্ন নিচ্ছিলেন। পরবর্তী সময়ে, বাইবেল সম্বন্ধে নওয়াম্‌বিউই নামে সেই নার্সের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার জন্য আমরা তার সঙ্গে দেখা করি। তিনি সত্য গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে আবায় একজন প্রাচীন হয়ে ওঠেন। আমিও অনেক ব্যক্তিকে সাহায্য করায় সফল হই, যার মধ্যে এমনকী গোঁড়া মুসলমানরাও রয়েছে, যারা যিহোবার অনুগত দাস হয়ে উঠেছে। নাইজেরিয়ার লোকেদের, তাদের সংস্কৃতি, তাদের রীতিনীতি ও তাদের ভাষা জানার আর সেইসঙ্গে ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা অনেক আনন্দ লাভ করেছি।”

আরেকটা শিক্ষণীয় বিষয় হল: বিদেশে আমাদের কার্যভারে উন্নতি করার জন্য আমাদের ভাই-বোনদের ভালোবাসতে শিখতে হবে, তা তাদের সংস্কৃতি আমাদের চেয়ে যত ভিন্নই হোক না কেন।

নতুন কার্যভার

নাইজেরিয়া বেথেলে সেবা করার পর আমরা ১৯৮৭ সালে ক্যারিবিয়ানের সেন্ট লুচিয়া নামে এক অপূর্ব দ্বীপে ক্ষেত্রের মিশনারি হিসেবে সেবা করার এক নতুন কার্যভার লাভ করি। এটা অনেক আনন্দদায়ক কার্যভার ছিল, তবে এখানে আমরা নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হই। আফ্রিকায় যেমন একজন পুরুষ অনেক মহিলাকে বিয়ে করে, সেটার বিপরীতে এখানে অর্থাৎ সেন্ট লুচিয়ায় দম্পতিরা বৈধভাবে বিয়ে না করেই একসঙ্গে বাস করে। ঈশ্বরের শক্তিশালী বাক্য আমাদের অনেক বাইবেল ছাত্রকে প্রয়োজনীয় রদবদল করতে অনুপ্রাণিত করে।

আমাদের ৬৮ বছরের বিবাহিত জীবনে কখনো ভালোবাসার অভাব দেখা যায়নি

আমরা যেহেতু বয়সের কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি, তাই পরিচালকগোষ্ঠী ২০০৫ সালে প্রেমের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ে আমাদের পাঠায়। আমি এখনও প্রতিদিন ওরিসের জন্য যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাই। ২০১৫ সালে, শেষ শত্রু মৃত্যু ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয় আর ওকে হারানোর যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা অনেক কঠিন। ও সত্যিই এক চমৎকার সাথি এবং প্রেমময় স্ত্রী ছিল। আমাদের ৬৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে কখনো ভালোবাসার অভাব দেখা যায়নি। আমরা বিবাহিত জীবনে ও মণ্ডলীতে, উভয় ক্ষেত্রেই সুখী হওয়ার যে-রহস্য খুঁজে পেয়েছি, সেটা হল মস্তকপদের প্রতি সম্মান দেখানো, মন থেকে ক্ষমা করা, নম্রতা বজায় রাখা এবং আত্মার ফল প্রদর্শন করা।

হতাশা অথবা নিরুৎসাহিতা যখন আমাদের ঘিরে ধরত, তখন আমরা যিহোবার সেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য চেয়ে তাঁর উপর নির্ভর করতাম। আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে ক্রমাগত মানিয়ে চলার মাধ্যমে দেখেছি, সাংগঠনিক পরিবর্তনগুলো সবসময়ই ভালো ফল নিয়ে এসেছে আর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো এক পরিবর্তন অপেক্ষা করে আছে!—যিশা. ৬০:১৭; ২ করি. ১৩:১১.

ত্রিনিদাদে ও টোবাগোতে যিহোবা আমার বাবা-মা ও অন্যদের কাজের উপর আশীর্বাদ করেছেন আর এর ফলাফল আমরা সাম্প্রতিক রিপোর্টে লক্ষ করতে পারি। ৯,৮৯২ জন সত্য উপাসনায় যোগ দিয়েছে। আরুবায় অনেকে আমার পুরোনো মণ্ডলীকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করেছে। এই দ্বীপে বর্তমানে ১৪টা উন্নতিশীল মণ্ডলী রয়েছে। নাইজেরিয়ায় সেই অল্পসংখ্যক প্রকাশক বৃদ্ধি পেয়ে ৩,৮১,৩৯৮-এ গিয়ে পৌঁছায়, যা সত্যিই এক বৃহৎ জনতা। আর সেন্ট লুচিয়া দ্বীপে ৭৮৩ জন যিহোবার রাজ্যকে সমর্থন করছে।

আমার বয়স এখন ৯০-এর কোঠায়। যারা যিহোবার গৃহে রোপিত, তাদের বিষয়ে গীতসংহিতা ৯২:১৪ পদ বলে: “তাহারা বৃদ্ধ বয়সেও ফল উৎপন্ন করিবে, তাহারা সরস ও তেজস্বী হইবে।” যিহোবার সেবায় আমি যে-জীবন অতিবাহিত করতে পেরেছি, সেটার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ। আমি যে-উত্তম আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার পেয়েছি, সেটা আমাকে পূর্ণরূপে যিহোবার সেবা করে যেতে উৎসাহিত করেছে। যিহোবা তাঁর অনুগত প্রেম দেখিয়ে আমাকে “[আমার] ঈশ্বরের প্রাঙ্গণে উৎফুল্ল” হওয়ার বা উন্নতি করার সুযোগ দিয়েছেন।—গীত. ৯২:১৩.

^ অনু. 18 ১৯৭২ সালের মার্চ ৮, সজাগ হোন! (ইংরেজি) পত্রিকার ২৪-২৬ পৃষ্ঠা দেখুন।