১৯১৮—এক-শো বছর আগে
উনিশ-শো আঠারো সালে ১ জানুয়ারি প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় বলা হয়েছিল: “১৯১৮ সাল কী নিয়ে আসবে?” ইউরোপে তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল কিন্তু এই বছরের প্রথম দিকে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলো মনে করিয়ে দেয় যে, বাইবেল ছাত্র ও সমগ্র মানবজাতির জন্য ভালো কিছু আসতে চলেছে।
বিশ্বব্যাপী শান্তিস্থাপনের চেষ্টা
১৯১৮ সালে ৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে তার বক্তৃতায় এমন ১৪টা উপায় সম্বন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, যেগুলো তিনি মনে করেছিলেন যে, ‘ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তিস্থাপনের’ জন্য অপরিহার্য। তিনি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে কূটনীতি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার, মজুত অস্ত্রশস্ত্র কমানোর এবং “বড়ো ও ছোটো রাজ্যগুলোর সমানভাবে” উপকারের জন্য “জেনারল আ্যসোসিয়েশন অভ্ নেশন্স” বা “জাতিগণের সাধারণ সংঘ” স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তার “চোদ্দোটা উপায়” পরে রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠন করতে এবং ভার্সাইল চুক্তি আলোচনা করতে ব্যবহৃত হয় আর এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।
বিরোধীদের পরাজয়
আগের বছরে অশান্ত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও, * ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি-র বার্ষিক বিজনেস মিটিংয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলোর কারণে বাইবেলের ছাত্রদের কাছেও মনে হয় যে, শান্তি একেবারে নিকটে।
১৯১৮ সালে ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই মিটিংয়ে, কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাদের আগে বেথেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তারা সংগঠনের মধ্যে ক্ষমতা লাভ করতে চেয়েছিল। একজন বিশ্বস্ত ভ্রমণ অধ্যক্ষ, রিচার্ড এইচ. বারবার প্রার্থনার মাধ্যমে মিটিং শুরু করেন। আগের বছরের কাজের রিপোর্ট পড়ার পর, পরিচালক পদের বার্ষিক নির্বাচন শুরু হয়। ভাই বারবার, জোসেফ রাদারফোর্ড ও অন্যান্য ছয় জন ভাইকে মনোনীত করেন। এরপর একজন উকিল, যিনি বিরোধীদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তিনিও অন্যান্য সাত জন ভাইকে মনোনীত করেন আর সেই ভাইদের মধ্যে তারাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদের আগে বেথেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। বিরোধী পক্ষ বিপুল ভোটে পরাজিত হয় আর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা ভাই রাদারফোর্ড ও অন্যান্য ছয় জন ভাইকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত করেন।
উপস্থিত ভাইদের মধ্যে অনেকেই এই মিটিংকে “আগের সম্মেলনগুলোর চেয়ে আরও বেশি ঈশ্বরের অনুমোদন রয়েছে এমন এক সম্মেলন” হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু, তাদের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল।
উন্মোচিত রহস্য বইয়ের প্রতিক্রিয়া
বাইবেল ছাত্ররা বেশ কিছু মাস ধরে উন্মোচিত রহস্য (ইংরেজি) নামক বইটা বিতরণ করে আসছিল। এই বইটাতে যে বাইবেলের সত্য রয়েছে, তা জেনে সৎহৃদয়ের পাঠকরা বইটার প্রতি ইতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কানাডার একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ ই.এফ.ক্রিস্ট, এমন একজন দম্পতির কথা উল্লেখ করেন, যারা মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে উন্মোচিত রহস্য বইটা পড়ে শেষ করে ও সত্য গ্রহণ করে। তিনি বলেন: “স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই সম্পূর্ণভাবে জগৎ থেকে পৃথক হয় ও ক্রমাগত উন্নতি করে।”
একজন ব্যক্তি এই বইটা পাওয়া মাত্রই এটার মধ্যে যে তথ্য রয়েছে, তা তার বন্ধুদের জানান। এই তথ্য সেই ব্যক্তিকে “আঘাত” করে। তিনি বলেন: “আমি থার্ড আ্যভিনিউ নামক একটা রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম আর আমার কাঁধে হঠাৎ কিছু একটা আঘাত করে আর আমি ভাবলাম, মনে হয় একটা ইট এসে পড়ল কিন্তু জানেন সেটা কী ছিল? সেটা ছিল ‘উন্মোচিত রহস্য’। আমি বইটা বাড়ি নিয়ে যাই আর পুরোটা পড়ে শেষ করি। . . . তারপর আমি জানতে পারি, যে-ব্যক্তি বইটা রাগ করে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন . . . তিনি
ছিলেন খ্রিস্টীয় জগতের একজন প্রচারক . . . খ্রিস্টীয় জগতের প্রচারকদের উপদেশ ও অন্যান্য কাজের চেয়েও, যে-বইটা প্রচারক জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, সেই বইটা পড়ে আরও বেশি সংখ্যক লোক সত্য জানতে পেরেছে। . . . এই প্রচারকের রাগের কারণে এখন আমরা ঈশ্বরের প্রশংসা করি।”সেই প্রচারকের প্রতিক্রিয়া কোনো নতুন কিছু ছিল না। কানাডার কর্মকর্তারা এই বইটা ১৯১৮ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধ করে আর তারা অভিযোগ করে যে, এই বইটা যুদ্ধে যাওয়া থেকে লোকেদের বিরত করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে ইন্ধন জোগায়। এর অল্পসময় পরেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা একই অভিযোগ করে। সরকারি কর্মচারীরা বেথেলে এবং নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়ার অফিসে সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী ভাইদের বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজে পাওয়ার জন্য তল্লাশি চালায়। ১৯১৮ সালে ১৪ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অভ্ জাসটিস উন্মোচিত রহস্য বইটা নিষিদ্ধ করে আর দাবি করে যে, এই বইটা লোকেদের যুদ্ধে যেতে নিরুৎসাহিত করে, যেটা এস্পায়ওনেজ আ্যক্ট নামক আইনের বিরুদ্ধে।
জেলে বন্দি!
ডিপার্টমেন্ট অভ্ জাসটিস ১৯১৮ সালে ৭ মে অনুমতি পায়, যেন জোভানি ডিসিকা, জর্জ ফিশার, আলেকজান্ডার ম্যাকমিলান, রবার্ট মার্টিন, ফ্রেডরিক রবিসন, জোসেফ রাদারফোর্ড, উইলিয়াম ভ্যান আ্যমবার্গ ও ক্ল্যাটন উডওয়ার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে “অবৈধভাবে, বেআইনিভাবে ও ইচ্ছাকৃতভাবে কর্তৃপক্ষকে অমান্য করা ও অনুগত না থাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিকবাহিনী ও নৌবাহিনীতে অংশ না নেওয়ার” জন্য অভিযোগ করা হয়। ১৯১৮ সালে ৩ জুন তাদের বিচার শুরু হয়, কিন্তু তাদের যে দোষী সাব্যস্ত করা হবে, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই ছিল না। কেন?
তাদের বিরুদ্ধে যে এস্পায়ওনেজ আ্যক্ট নামক আইন অমান্য করার অভিযোগ আনা হয়, সেই আইনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উকিল “অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এক কার্যকরী অস্ত্র” বলে উল্লেখ করেন। “সততা, উত্তম মনোভাব ও সঠিক উদ্দেশ্য” নিয়ে যারা প্রকাশনা বের করেছিল, তাদের সুরক্ষার জন্য এস্পায়ওনেজ আ্যক্ট-এ এক পরিবর্তন আসতে চলেছিল কিন্তু ১৯১৮ সালে ১৬ মে কংগ্রেস তা বাতিল করে দেয়। উন্মোচিত রহস্য তাদের আলোচনার এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ছিল। এই বই সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস বলে: “এই ধরনের অপপ্রচারের সবচেয়ে বিপদজনক উদাহরণগুলোর মধ্যে একটা হল ‘উন্মোচিত রহস্য’ . . . এই বইয়ের একমাত্র প্রভাব হল সৈনিকদের দেশের প্রতি আনুগত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে প্ররোচিত করা ও সামরিকবাহিনীতে . . . যোগ না দেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া।”
১৯১৮ সালে ২০ জুন, এক জুরিবোর্ড এই আট জন ভাইকে তাদের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করে। পরের দিন, বিচারক সেই আট জন ভাইকে দণ্ডাজ্ঞা সুপারিশ করেন। তিনি বলেন: “এই ব্যক্তিরা যে-ধর্মীয় অপপ্রচার জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন ও ছড়িয়ে দিয়েছেন . . . তা একদল জার্মান সৈন্যবাহিনীর চেয়েও বেশি বিপদজনক। . . . এদের শাস্তি মারাত্মক হওয়া উচিত।” দুই সপ্তাহ পর, এই আট জন ভাইকে জর্জিয়ার আটলান্টার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং শাস্তি হিসেবে ১০ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
প্রচার কাজ ক্রমাগত চলতে থাকে
এই সময়ে, বাইবেল ছাত্ররা চরম বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। ফেডরল ব্যুরো অভ্ ইনভেস্টিগেশন-এর (এফবিআই) তাদের কাজকর্মের উপর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তল্লাশি চালায় এবং আমাদের ভাইয়েরা যে
প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল, তা প্রমাণ করার জন্য হাজার হাজার নথিপত্র প্রস্তুত করে।এফবিআই-এর কাছে লেখা একটা চিঠিতে ফ্লোরিডার অরল্যানডোর পোস্টমাস্টার লিখেছিলেন: “[এই বাইবেল ছাত্ররা] শহরের মধ্যে ঘরে ঘরে প্রচার করেছে এবং এই কাজ বেশিরভাগ সময় রাতের বেলায় করা হয়েছে . . . যত বিরোধিতাই আসুক না কেন তারা প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে চায়।”
সামরিক বিভাগের একজন কর্নেল এফবিআইকে, ভাই ফ্রেডরিক ডব্লিউ. ফ্রাঞ্জের কাজকর্ম সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে বলেছিলেন আর সেই ভাই পরে পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে সেবা করেছিলেন। কর্নেল লিখেছিলেন: “এফ. ডব্লিউ. ফ্রাঞ্জ ‘উন্মোচিত রহস্য’ বইটার হাজার হাজার কপি বিক্রি করার সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত ছিলেন।”
চার্লস ফেকেল, যিনি পরে পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে সেবা করেন, তিনিও চরম তাড়নার মুখোমুখি হন। উন্মোচিত রহস্য বিতরণ করার জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং জেলে থাকার সময় তার চিঠিপত্রের উপর নজর রাখা হয়। চার্লস ফেকেলকে মেরিল্যান্ডের বল্টিমোরে এক মাস ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা হয় ও তাকে একজন “অস্ট্রিয়ার বিদেশি শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার জিজ্ঞাসাবাদকারীদের সাহসের সঙ্গে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি ১ করিন্থীয় ৯:১৬ পদের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে বলা আছে: “ধিক্ আমাকে, যদি আমি সুসমাচার প্রচার না করি।” *
উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করা ছাড়াও, বাইবেল ছাত্ররা আন্তরিকতার সঙ্গে আটলান্টা জেলে বন্দি ভাইদের মুক্ত করার জন্য একটা আবেদনপত্র বিতরণ করে। আ্যনা কে. গার্ডনার স্মরণ করে বলেন: “আমরা সবসময় কিছু না কিছু করতে ব্যস্ত ছিলাম। ভাইয়েরা যখন জেলে ছিল, তখন আমাদের প্রথম কাজ ছিল স্বাক্ষর জোগাড় করা। আমরা ঘরে ঘরে গিয়েছিলাম আর হাজার হাজার স্বাক্ষর জোগাড় করেছিলাম। যাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল, তাদের বলেছিলাম: এই ব্যক্তিরাই হল প্রকৃত খ্রিস্টান আর তাদের অন্যায়ভাবে জেলে রাখা হয়েছে।”
বিভিন্ন সম্মেলন
এই কঠিন সময়ে ভাই-বোনদের আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য বার বার সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রহরীদুর্গ বলে: “সেই বছরে চল্লিশটারও বেশি . . . সম্মেলনের আয়োজন করা হয় . . . এই সমস্ত সম্মেলন থেকে উত্তম রিপোর্ট পাওয়া যায়। আগে, সমস্ত সম্মেলনের আয়োজন গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে বা শরৎকালের শুরুর দিকে করা হতো; কিন্তু এখন তা বছরের প্রত্যেক মাসে করা হয়।”
সৎহৃদয়ের ব্যক্তিরা তখনও সুসমাচারের প্রতি সাড়া দিচ্ছিল। ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলনে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০০ জন আর ৪২ জন বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। যারা বাপ্তিস্ম নিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন অল্পবয়সি ছেলে ছিল আর তার ঈশ্বরের প্রতি “এমন এক উপলব্ধিবোধ ও বিশ্বাস ছিল, যা জগতের অনেক বয়স্ক লোকের মধ্যেও ছিল না।”
এরপর কী হয়?
১৯১৮ সালের শেষের দিকে বাইবেল ছাত্ররা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়। ব্রুকলিনের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয় ও বিশ্বপ্রধান কার্যালয় পেনসিলভানিয়ার পিটস্বার্গ-এ সরানো হয়। নেতৃত্বদানকারীরা যখন জেলে ছিল, তখন ১৯১৯ সালে ৪ জানুয়ারি সংগঠনের বাকি সদস্যরা আরেকটা বার্ষিক সভার আয়োজন করে। এরপর কী ঘটে?
আমাদের ভাই-বোনেরা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। কাজের ফলাফল সম্বন্ধে তারা এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, ১৯১৯ সালের বার্ষিক শাস্ত্রপদ বাছাই করা হয়েছিল: “যে কোন অস্ত্র তোমার বিপরীতে গঠিত হয়, তাহা সার্থক হইবে না।” (যিশা. ৫৪:১৭) তারা হঠাৎ এক পুরোপুরিভাবে পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল। এই নতুন পরিস্থিতি তাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করবে এবং সামনে যে-প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে, সেগুলোর জন্য তাদের শক্তিশালী করবে।