জীবনকাহিনি
আমাদের প্রতি ‘সদাপ্রভু সদয় আচরণ করিয়াছেন’
আমার স্ত্রী ড্যানিয়েলা ও আমি সবেমাত্র একটা হোটেলে ঢুকেছি আর তখনই সেখানকার রিসেপশনিস্ট আমাকে বলেন, “আপনি দয়া করে বর্ডারের পুলিশকে ফোন করবেন?” এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই আমরা আফ্রিকার গাবোন দেশে এসে পৌঁছেছিলাম, যেখানে ১৯৭০-এর দশকে আমাদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
যেহেতু ড্যানিয়েলা সবসময় খুব সতর্ক থাকত, তাই ও সঙ্গেসঙ্গে চারপাশের পরিস্থিতি লক্ষ করে আর আমার কানে ফিসফিস করে বলে, “পুলিশকে ফোন করতে হবে না, ওরা ইতিমধ্যেই চলে এসেছে!” ঠিক আমাদের পিছনেই একটা গাড়ি এসে হোটেলের সামনে দাঁড়ায়। কয়েক মিনিট পর আমাদের দু-জনকেই গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ভালো যে, ড্যানিয়েলা আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল বলে আমি সেখানে থাকা একজন ভাইকে কিছু কাগজপত্র দিয়ে দেওয়ার মতো সময় পেয়েছিলাম।
পুলিশ স্টেশনে আমাদের নিয়ে যাওয়ার সময়ে আমি চিন্তা করি, এটা কতই-না আনন্দের এক বিষয় যে, আমি এমন এক স্ত্রী পেয়েছি, যে খুবই সাহসী এবং যিহোবা ও তাঁর সংগঠনের বিষয়ে চিন্তিত। এটা হল এমন অনেক ঘটনার মধ্যে কেবল একটা, যখন ড্যানিয়েলা ও আমি একটা দল হিসেবে কাজ করেছি। আসুন, আমি ব্যাখ্যা করি যে, কীভাবে আমরা এমন দেশগুলোতে ভ্রমণ করতে শুরু করেছিলাম, যেখানে আমাদের প্রচার কাজের উপর সীমা আরোপ করা হয়েছিল।
যিহোবা সদয়ভাবে আমার চোখ খুলে দেন
১৯৩০ সালে, উত্তর ফ্রান্সের একটা ছোট্ট শহর ক্রোয়্যায় এক ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক পরিবারে আমার জন্ম হয়। আমার পরিবার প্রতি সপ্তাহে মিশায় যোগ দিত এবং আমার বাবা গির্জার সঙ্গে বেশ জড়িত ছিলেন। তবে, আমার বয়স যখন প্রায় ১৪ বছর, তখন একটা ঘটনা গির্জার কপটতার প্রতি আমার চোখ খুলে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্স জার্মান সেনার দখলে ছিল। আমাদের পাদরি তার বক্তৃতাগুলোতে নিয়মিতভাবে আমাদের উৎসাহিত করতেন যেন আমরা ভিশি শহরের নাৎসি সমর্থক সরকারকে সমর্থন করি। আমরা তার বক্তৃতাগুলো শুনে হতবাক হয়ে যাই। ফ্রান্সের অন্যান্য অনেকের মতো আমরাও গোপনে বিবিসি রেডিও শুনতাম, যেটাতে মিত্রবাহিনীর খবর সম্প্রচারিত হতো। এরপর, আমাদের পাদরি হঠাৎই পক্ষ বদলান এবং ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিত্রবাহিনী অগ্রসর হওয়ার বিষয়টা উদ্যাপন করার জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশে ধন্যবাদ দেওয়ার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। আমি এই কপটতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। এটা পাদরিদের উপর আমার আস্থাকে দুর্বল করে দেয়।
যুদ্ধের অল্পসময় পরই আমার বাবা মারা যান। আমার দিদির ইতিমধ্যেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর ও বেলজিয়ামে থাকত, তাই আমি আমার মায়ের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি। আমি কাপড়ের কারখানায় চাকরি পাই। আমার কর্মকর্তা ও তার ছেলেরা ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন। যদিও তাদের কোম্পানিতে কাজ করে আমি এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ লাভ করতে পারতাম, তবে শীঘ্রই আমি এক পরীক্ষার মুখোমুখি হই।
আমার দিদি সিমোন একসময় যিহোবার সাক্ষি হয় এবং ১৯৫৩ সালে ও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। দিদি ওর বাইবেল ব্যবহার করে দক্ষতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে যে, নরকাগ্নি, ত্রিত্ব ও আত্মার অমরত্ব সম্বন্ধে ক্যাথলিক গির্জার শিক্ষাগুলো আসলে মিথ্যা। প্রথমে,
আমি তর্ক করি যে, দিদি ক্যাথলিক বাইবেল ব্যবহার করছে না। কিন্তু, শীঘ্রই আমি দৃঢ়প্রত্যয়ী হই যে, ও আমাকে সত্য কথাই বলছে। পরে একসময়, দিদি আমাকে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার কয়েকটা পুরোনো সংখ্যা এনে দেয় আর আমি রাতে আমার শোয়ার ঘরে আগ্রহের সঙ্গে সেগুলো পড়ি। খুব তাড়াতাড়ি আমি বুঝতে পারি, এটাই সত্য। তারপরও, আমি ভয় পাই যে, আমি যদি যিহোবার পক্ষ নিই, তা হলে আমি আমার চাকরি হারাব।কয়েক মাস পর্যন্ত আমি নিজে নিজেই বাইবেল ও প্রহরীদুর্গ পত্রিকার প্রবন্ধগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করি। পরিশেষে আমি একটা কিংডম হলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেই মণ্ডলীর প্রেমময় পরিবেশ সত্যিই আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে। আমি একজন অভিজ্ঞ ভাইয়ের সঙ্গে ছ’মাস ধরে বাইবেল অধ্যয়ন করার পর ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাপ্তিস্ম নিই। শীঘ্রই, আমার মা আর বোনও সাক্ষি হয় এবং এতে আমি খুবই আনন্দিত হই।
পূর্ণসময়ের সেবায় যিহোবার উপর নির্ভর করা
দুঃখের বিষয় হল আমার মা ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই মারা যান। আমি সেই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। ফিরে আসার পর আমার আর কোনো পারিবারিক দায়িত্ব না থাকায় আমি আমার চাকরি ছেড়ে দিই এবং অগ্রগামী সেবা শুরু করি। এই সময়ে আমি একজন উদ্যোগী অগ্রগামী, বোন ড্যানিয়েলা দোলির সঙ্গে বাগ্দান করি আর ১৯৫৯ সালের মে মাসে আমরা বিয়ে করি।
ড্যানিয়েলা তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ব্রিটানি নামে এক গ্রাম্য এলাকায় তার পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করেছিল। ওর সেই ক্যাথলিক এলাকায় প্রচার করার ও গ্রাম্য এলাকাগুলোতে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহসের প্রয়োজন হতো। ঠিক আমার মতোই, ওর মধ্যে এক গভীর তৎপরতার মনোভাব ছিল; আমরা জানতাম না, শেষ কতটা নিকটে রয়েছে। (মথি ২৫:১৩) ওর আত্মত্যাগমূলক মনোভাব আমাদের পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় হাল ছেড়ে না দিতে সাহায্য করেছিল।
আমাদের বিয়ের কয়েক দিন পরই আমাদের সীমার কাজে কার্যভার দেওয়া হয়। আমরা আরও সাদাসিধেভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করি। আমরা প্রথম যে-মণ্ডলীতে যাই, সেখানে ১৪ জন প্রকাশক ছিল এবং ভাইদের কাছে আমাদের থাকতে দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। তাই, আমরা কিংডম হলের মঞ্চে তোশক পেতে ঘুমাই। যদিও এটা খুব-একটা আরামদায়ক কিংবা ভালো ছিল না কিন্তু এটা আমাদের মেরুদণ্ডের জন্য দারুণ ছিল!
আমাদের ব্যস্ত তালিকা সত্ত্বেও ড্যানিয়েলা ভ্রমণ কাজের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছিল। প্রায়ই, ওকে প্রাচীনদের কোনো অপরিকল্পিত সভার কারণে আমাদের ছোট্ট গাড়িতে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করতে হতো কিন্তু ও কখনো অভিযোগ করেনি। আমরা সীমার কাজে মাত্র দু-বছর কাটাই আর সেই সময়ের মধ্যে আমরা শিখি যে, এক বিবাহিত দম্পতির জন্য খোলাখুলিভাবে একে অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময় করা এবং একটা দল হিসেবে কাজ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।—উপ. ৪:৯.
আমরা নতুন কার্যভার উপভোগ করি
১৯৬২ সালে আমাদের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে গিলিয়েড স্কুল-এর ৩৭তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই কোর্সটা ১০ মাসের ছিল। ১০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কেবল ১৩টা দম্পতি ছিল, তাই আমরা যে একসঙ্গে এই স্কুলে যোগ দিতে পেরেছি, সেটাকে এক বিশেষ সুযোগ হিসেবে দেখেছিলাম। এখনও আমার এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করার কথা মনে পড়ে, যাদের প্রচুর বিশ্বাস ছিল যেমন, ভাই ফ্রেডরিক ফ্রাঞ্জ, ভাই ইউলিসিস গ্লাস ও ভাই আ্যলেক্জ্যান্ডার এইচ. ম্যাকমিলান।
আমাদের প্রশিক্ষণের সময়ে আমাদের বিভিন্ন বিষয় ভালোভাবে লক্ষ করার দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য জোরালো পরামর্শ দেওয়া হয়। কোনো কোনো শনিবারে, ক্লাস শেষ হওয়ার পর দুপুর বেলায় আমাদের
প্রশিক্ষণের অংশ ছিল নিউ ইয়র্ক সিটিতে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা। আমরা জানতাম, আমরা যা যা দেখেছি, সেই বিষয়ে সোমবারে আমাদের একটা লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। প্রায়ই, শনিবার সন্ধ্যায় আমরা প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসতাম কিন্তু আমাদের টুর গাইড, একজন বেথেলকর্মী, আমাদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন যেন আমরা সেই লিখিত পরীক্ষার জন্য মূল বিষয়গুলো মনে রাখতে পারি। একবার শনিবারে আমরা সারা দুপুর শহরে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াই। আমরা একটা পর্যবেক্ষণাগারে যাই, যেখানে আমরা উল্কা ও উল্কাপিণ্ড সম্বন্ধে শিখি। এরপর, আমরা আমেরিকান মিউজিয়াম অভ্ ন্যাচারাল হিস্ট্রি-তে যাই আর সেখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের কুমির সম্বন্ধে শিখি। বেথেলে ফিরে আসার পর আমাদের টুর গাইড আমাদের জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে, উল্কা ও উল্কাপিণ্ডের মধ্যে পার্থক্য কী?” ড্যানিয়েলা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই ও উত্তর দেয়, “উল্কাপিণ্ডের আরও লম্বা দাঁত আছে!”আমাদের যখন ফ্রান্সের শাখা অফিসে কার্যভার দেওয়া হয়, তখন আমরা অবাক হয়ে যাই। আমরা সেখানে ৫৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে একসঙ্গে কাজ করি। ১৯৭৬ সালে আমাকে শাখা কমিটির কোঅর্ডিনেটর হিসেবে নিযুক্ত করা হয় আর এর পাশাপাশি, আমাকে আফ্রিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের এমন দেশগুলোতে ভ্রমণ করার কার্যভার দেওয়া হয়, যেখানে আমাদের প্রচার কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা কিংবা সীমা আরোপ করা হয়েছিল। এভাবেই আমরা গাবোনে ভ্রমণ করি, যেখানে আমাদের শুরুতে উল্লেখিত সেই অভিজ্ঞতা হয়। সত্যি বলতে কী, কখনো কখনো আমি মনে করতাম, আমার এই অপ্রত্যাশিত দায়িত্বগুলো পালন করার জন্য যোগ্যতা নেই। কিন্তু, ড্যানিয়েলার সমর্থনের কারণে আমি মনে করেছিলাম, আমি যেকোনো কার্যভার পালন করতে পারব।
আমরা একসঙ্গে এক মহাপরীক্ষার মুখোমুখি হই
প্রথম থেকেই আমাদের বেথেলে সেবা করতে খুব ভালো লাগত। ড্যানিয়েলা গিলিয়েড-এ যাওয়ার আগে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ইংরেজি ভাষা শিখেছিল। ও আমাদের প্রকাশনার অনুবাদ কাজে এক দক্ষ অনুবাদক হয়ে ওঠে। আমরা বেথেলে সেবা করে প্রচুর পরিতৃপ্তি লাভ করতাম, তবে মণ্ডলীর কাজগুলোতে অংশ নেওয়া আমাদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। আমার এখনও মনে আছে, আমি ও ড্যানিয়েলা রাতের বেলায় প্যারিসের মেট্রো ধরে ফিরে আসার সময়ে ক্লান্ত থাকতাম, কিন্তু একইসময়ে আমরা খুবই আনন্দিত হতাম যে, আমরা একসঙ্গে কয়েকটা উন্নতিশীল বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করেছি। তবে দুঃখের বিষয়, ড্যানিয়েলার স্বাস্থ্য হঠাৎই পরিবর্তিত হয়ে যায় আর ও আগের মতো সক্রিয় জীবনযাপন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
১৯৯৩ সালে ওর ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে। ওকে খুবই কষ্টদায়ক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। ওকে অপারেশন করাতে ও প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি নিতে হয়। পনেরো বছর পর ওর আবার ক্যান্সার ধরা পরে আর এবার, সেটা আরও বেশি গুরুতর প্রকৃতির হয়। তবে, ও ওর কার্যভারকে এত ভালোবাসত যে, যখনই ওর পরিস্থিতি একটু ঠিক হতো, তখনই ও আবার কাজ করতে শুরু করত।
ড্যানিয়েলার গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও আমরা কখনো বেথেল ছাড়ার কথা চিন্তা করিনি। তবে, অসুস্থ অবস্থায় বেথেলে সেবা করার ফলে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসে, বিশেষভাবে যদি অন্যেরা এটা না জানে যে, আপনার অবস্থা কতটা গুরুতর। (হিতো. ১৪:১৩) এমনকী ড্যানিয়েলার বয়স যখন ৭০-এর কোঠার শেষের দিকে ছিল, তখনও ওর মুখের মিষ্টতা ও সৌন্দর্য দেখে বোঝাই যেত না যে, ওর শারীরিক অবস্থা কতটা খারাপ। ও নিজের পরিস্থিতির কারণে ভেঙে পড়েনি। এর পরিবর্তে, ও অন্যদের সাহায্য করার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল। ও জানত, কষ্টে থাকা লোকেদের কথা মন দিয়ে শুনলে, সেটা তাদের প্রচুর সাহায্য করে। (হিতো. ১৭:১৭) ড্যানিয়েলা কখনো পরামর্শদাতা হওয়ার দাবি করেনি; তবে, ও নিজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অনেক বোনকে সাহায্য করেছিল, যাতে তারা ক্যান্সারকে ভয় না করে।
এর পাশাপাশি, আমাদের নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়। ড্যানিয়েলা যখন পূর্ণসময় কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন ও আমাকে আরও বেশি উপায়ে সাহায্য করার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। তাই, ও আমার জীবনকে আরও বেশি সহজ করে তোলার হিতো. ১৮:২২.
জন্য অনেক কিছু করে আর এর ফলে, আমি ৩৭ বছর ধরে শাখা কমিটির কোঅর্ডিনেটর হিসেবে সেবা করে যেতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, ও সব কিছু প্রস্তুত করে রাখত, যাতে আমরা প্রতিদিন আমাদের রুমে দুপুরের খাবার খেতে পারি ও একসঙ্গে একটু বিশ্রাম নিতে পারি।—উদ্বিগ্নতার সঙ্গে প্রতিদিন মোকাবিলা করা
ড্যানিয়েলা সবসময় জীবনের বিষয়ে খুবই ইতিবাচক ছিল আর ও বেঁচে থাকতে চাইত। এরপর, তৃতীয় বার ওর ক্যান্সার ধরা পড়ে। আমাদের মনে হয় যেন আমাদের সমস্ত শক্তি হারিয়ে গিয়েছে। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি ওকে এতটা দুর্বল করে দিত যে, কখনো কখনো ও ঠিকমতো হাঁটতেও পারত না। আমি এটা দেখে খুবই কষ্ট পাই যে, আমার প্রিয় স্ত্রী, যে একসময় দক্ষ অনুবাদক ছিল, কথা বলার সময়ে শব্দ হারিয়ে ফেলত।
যদিও আমরা নিজেদের দিশেহারা বলে মনে করি, তা সত্ত্বেও আমরা ক্রমাগত প্রার্থনা করি এবং এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হই যে, যিহোবা কখনো আমাদের শক্তির অতিরিক্ত কষ্ট ভোগ করতে দেবেন না। (১ করি. ১০:১৩) যিহোবা তাঁর বাক্যের, বেথেলের চিকিৎসাকর্মীদের আর আমাদের ভাই-বোনদের প্রেমময় সমর্থনের মাধ্যমে যে-সাহায্য প্রদান করেন, সেটার জন্য আমরা সবসময় কৃতজ্ঞতা বজায় রাখার চেষ্টা করি।
আমরা প্রায়ই যিহোবার কাছে এই বিষয়ে নির্দেশনা চাইতাম যে, আমাদের কোন চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। একবার, ড্যানিয়েলার কোনো চিকিৎসা হচ্ছিল না। যে-ডাক্তার ২৩ বছর ধরে ড্যানিয়েলার চিকিৎসা করেছিলেন, তিনি ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না যে, কেন ড্যানিয়েলা প্রতি বার কেমোথেরাপি নেওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আমাদের অন্য কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি সম্বন্ধে বলতে পারেননি। আমাদের মনে হয়েছিল যেন আমাদের সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভেবে পাচ্ছিলাম না, কী করব। এরপর, ক্যান্সারের অন্য একজন ডাক্তার ড্যানিয়েলার যত্ন নিতে রাজি হন। এটা এমন ছিল যেন যিহোবা আমাদের উদ্বিগ্নতাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে আমাদের জন্য পথ বের করে দিয়েছিলেন।
আমরা দিনের চিন্তা দিনেই করার মাধ্যমে উদ্বিগ্নতার সঙ্গে লড়াই করতে শিখি। যিশু যেমন বলেছিলেন, “দিনের কষ্ট দিনের জন্যই যথেষ্ট।” (মথি ৬:৩৪) ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা ও রসিকতা করাও আমাদের সাহায্য করেছিল। উদাহরণ স্বরূপ, একবার যখন ড্যানিয়েলা দু-মাস ধরে কেমোথেরাপি নিতে পারেনি, তখন ও হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিল, “জানো, আমার কখনো নিজেকে এত সুস্থ বলে মনে হয়নি!” (হিতো. ১৭:২২) কষ্ট ভোগ করা সত্ত্বেও ও জোরগলায় রাজ্যের নতুন গানগুলো প্র্যাকটিস করতে ভালোবাসত।
ওর ইতিবাচক মনোভাব আমাকে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছিল। সত্যি বলতে কী, আমাদের বিয়ের পর থেকে ৫৭ বছর ধরে ও আমার যাবতীয় প্রয়োজনের যত্ন নিয়েছিল। ও এমনকী আমাকে এটাও দেখাতে চায়নি যে, কীভাবে ডিম ভাজতে হয়! তাই, যখন পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, ও কিছুই করতে পারছে না, তখন আমাকে বাসন ধোয়া ও কাপড় কাচা আর সেইসঙ্গে কয়েকটা সহজ রান্না শিখতে হয়। এটা করতে গিয়ে আমি বেশ কয়েকটা কাঁচের গ্লাস ভেঙেছি কিন্তু আমি ওকে খুশি করার জন্য বিভিন্ন কাজ করে খুবই আনন্দিত হতাম। *
যিহোবার প্রেমপূর্ণ দয়ার কারণে আমি খুবই কৃতজ্ঞ
আমি যখন পিছনে ফিরে তাকাই, তখন দেখি যে, স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও বার্ধ্যক্যের কারণে আমাদের যে-সমস্ত সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেগুলো থেকে আমি কিছু উপকারজনক শিক্ষা লাভ করেছি। প্রথমত, আমাদের কখনো এতটা ব্যস্ত হওয়া উচিত নয় যে, আমরা আমাদের প্রিয় সাথিকে মূল্যবান হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হই। জীবনে আমাদের যখন পূর্ণ শক্তি থাকে, তখন আমাদের অবশ্যই সেই বছরগুলোর সদ্ব্যবহার করে আমাদের প্রিয়জনদের যত্ন নিতে হবে। (উপ. ৯:৯) দ্বিতীয়ত, আমাদের ছোটোখাটো বিষয়গুলো নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়; কারণ এমনটা করলে আমরা সেই আশীর্বাদগুলো লক্ষ করতে পারব না, যেগুলো আমরা প্রতিদিন উপভোগ করে থাকি।—হিতো. ১৫:১৫.
আমি যখন পূর্ণসময়ের সেবায় আমাদের জীবনের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি, তখন আমাকে এটা স্বীকার করতেই হয়, যিহোবা আমাদের এত আশীর্বাদ করেছেন যে, সেটা আমাদের কল্পনার বাইরে। আমার অনুভূতিও সেই গীতরচকের মতো একই, যিনি বলেছিলেন: “সদাপ্রভু তোমার মঙ্গল [“আমার প্রতি সদয় আচরণ,” NW] করিয়াছেন।”—গীত. ১১৬:৭.
^ অনু. 32 এই প্রবন্ধ প্রস্তুত করার সময়ে বোন ড্যানিয়েলা বোকার্ট মারা যান। মারা যাওয়ার সময়ে তার বয়স ছিল ৭৮ বছর।