জীবনকাহিনি
পরীক্ষার মধ্যে ধৈর্য বজায় রাখা আশীর্বাদ নিয়ে আসে
“তুই খুবই নিষ্ঠুর একজন বাবা,” সেই কেজিবি অফিসার বলেন। * “তুই তোর গর্ভবতী স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে ছেড়ে দিয়েছিস। কে তাদের খেতে দেবে? কে তাদের যত্ন নেবে? তোর কাজ ত্যাগ কর আর বাড়ি ফিরে যা!” আমি উত্তর দিই: “না, আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে আসিনি। আপনারা আমাকে গ্রেপ্তার করেছেন! আর আমার অপরাধ কী?” সেই অফিসার রাগান্বিত হয়ে উত্তর দেন: “সাক্ষি হওয়ার চেয়ে অন্য যেকোনো অপরাধ করা ভালো।”
১৯৫৯ সালে রাশিয়ার ইরকুটস্ক নামক শহরের একটা জেলে এই কথোপকথন হয়েছিল। আমি আপনাদের জানাতে চাই, কেন আমি ও আমার স্ত্রী মারিয়া ‘ধার্ম্মিকতার নিমিত্ত দুঃখভোগ করিবার’ জন্য প্রস্তুত ছিলাম এবং কীভাবে আমরা বিশ্বস্ততা বজায় রাখার জন্য আশীর্বাদ লাভ করেছিলাম।—১ পিতর ৩:১৩, ১৪.
১৯৩৩ সালে ইউক্রেনের জালাটনিকি নামে একটা গ্রামে আমার জন্ম হয়। ১৯৩৭ সালে আমার মাসি ও মেসো, যারা সাক্ষি ছিলেন, ফ্রান্স থেকে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং আমাদের ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটি-র দ্বারা প্রকাশিত সরকার (ইংরেজি) এবং মুক্তি (ইংরেজি) শিরোনামের বই দুটো দেন। আমার বাবা যখন সেই বই দুটো পড়েন, তখন ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস পুনরায় গড়ে ওঠে। দুঃখের বিষয় হল, ১৯৩৯ সালে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু, মারা যাওয়ার আগে তিনি মাকে বলেন: “এটাই সত্য। সন্তানদের এটা শেখাও।”
সাইবেরিয়া—প্রচারের জন্য এক নতুন ক্ষেত্র
১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে, কর্তৃপক্ষ সাক্ষিদের ইউএসএসআর-এর (সোভিয়েত ইউনিয়ন) পশ্চিমাঞ্চল থেকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠাতে শুরু করে। আমার মা ও ভাই গ্রিগোরির সাথে আমাকেও পশ্চিম ইউক্রেন থেকে বের করে দেওয়া হয়। ট্রেনে করে ৬,০০০ কিলোমিটারেরও (৩,৭০০ মাইল) বেশি পথ যাত্রা করার পর আমরা সাইবেরিয়ার টুলুন নামক শহরে এসে পৌঁছাই। দু-সপ্তাহ পর আমরা দাদা বগড্যান কাছাকাছি আনগ্যার্স্ক নামক শহরের একটা শিবিরে এসে পৌঁছান। তাকে ২৫ বছরের কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
আমার মা, গ্রিগোরি ও আমি টুলুনের আশেপাশে থাকা বসবাসের জায়গাগুলোতে প্রচার করি কিন্তু আমাদের প্রচার করার ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা জিজ্ঞেস করি, “এখানে এমন কেউ আছেন, যিনি গোরু বিক্রি করতে চান?” আমরা যখন সেইরকম কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাই, তখন আমরা সেই ব্যক্তির কাছে উল্লেখ করি যে, গোরুরা কত সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট। কিছুসময় পরই, আমরা সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে কথা বলতে শুরু করি। সেই সময়ের একটা খবরের কাগজে লেখা হয়েছিল যে, সাক্ষিরা গোরুর বিষয়ে জানতে চায় কিন্তু আমরা জানতাম, আমরা আসলে মেষের অনুসন্ধান করছি! আর আমরা সত্যিই মেষতুল্য ব্যক্তিদের খুঁজে পেয়েছিলাম! সেই বিস্তীর্ণ এলাকাগুলোতে নম্র ও অতিথিপরায়ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করা সত্যিই এক আনন্দের বিষয় ছিল। বর্তমানে, টুলুনে একটা মণ্ডলী রয়েছে, যেখানে ১০০-রও বেশি প্রকাশক সেবা করে।
যেভাবে মারিয়ার বিশ্বাস পরীক্ষিত হয়েছিল
আমার স্ত্রী মারিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্রেনে সত্য সম্বন্ধে শেখে। তার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন একজন কেজিবি অফিসার তাকে উৎপীড়ন করতে শুরু করেন এবং মারিয়াকে তার সঙ্গে আদি. ৩৯:১১, ১২, ২০) যে-ব্যক্তি গাড়ি চালিয়ে মারিয়াকে আদালত থেকে জেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি তাকে বলেন: “ভয় পাবেন না। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছে, যারা জেলে যায় ঠিকই, তবে তারা আত্মসম্মানের সঙ্গে ফিরে আসে।” এই কথাগুলো মারিয়াকে শক্তিশালী করে।
অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য জোর করেন। কিন্তু, মারিয়া দৃঢ়ভাবে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। একদিন বাড়ি ফিরে মারিয়া দেখে, সেই ব্যক্তিটা তার বিছানায় শুয়ে আছেন। মারিয়া সঙ্গেসঙ্গে পালিয়ে যায়। রাগান্বিত হয়ে সেই অফিসার মারিয়াকে হুমকি দেয় যে, যেহেতু মারিয়া একজন সাক্ষি, তাই তিনি তাকে কারাদণ্ড দেবেন আর সত্যি সত্যিই ১৯৫২ সালে, মারিয়াকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মারিয়া যোষেফের মতো অনুভব করেছিল, যাকে নিজের বিশ্বস্ততা বজায় রাখার জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। (১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মারিয়াকে রাশিয়ার গোরকি (বর্তমানে নিঝ্নি নোভগারাড) নামক শহরের কাছাকাছি একটা শ্রমশিবিরে কাজ করার আদেশ দেওয়া হয়। তাকে শিকড়সহ গাছ কাটার আদেশ দেওয়া হয় আর তা এমনকী হাড় হিম করে দেওয়ার মতো ঠাণ্ডার সময়েও। ফলে, সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু, ১৯৫৬ সালে তাকে মুক্ত করা হয় আর সে টুলুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
আমার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকা
টুলুনে একজন ভাই যখন আমাকে বলেন যে, একজন বোন সেখানে আসছেন, তখন আমি সেই বোনের সঙ্গে দেখা করার এবং তার জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য সাইকেলে করে বাস স্টপ পর্যন্ত যাই। প্রথম বার মারিয়াকে দেখেই আমার ওকে পছন্দ হয়ে যায়। ওর মন জয় করার জন্য আমাকে বেশ প্রচেষ্টা করতে হয় কিন্তু আমি সফল হই। ১৯৫৭ সালে আমরা বিয়ে করি। এক বছর পর আমাদের মেয়ে ইরিনার জন্ম হয়। কিন্তু, আমাদের মেয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫৯ সালে, আমাকে বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনাদি ছাপানোর জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। আমাকে ছ-মাস নিঃসঙ্গ কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়। মনের শান্তি বজায় রাখার জন্য আমি সবসময় প্রার্থনা করতাম, রাজ্যের গান গাইতাম এবং আমাকে যখন মুক্ত করা হবে, তখন আমি কীভাবে প্রচার করব, সেই বিষয়টা নিয়ে কল্পনা করতাম।
জেলে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় একজন তদন্তকারী চিৎকার করে বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি আমরা তোদের ইঁদুরের মতো পিষে ফেলব!” উত্তরে আমি তাকে বলি, “যিশু বলেছিলেন যে, রাজ্যের সুসমাচার সমস্ত জগতে প্রচার করা হবে আর কেউ এটাকে আটকাতে পারবে না।” এরপর, সেই তদন্তকারী তার পদ্ধতি পরিবর্তন করেন এবং আমাকে আমার বিশ্বাস অস্বীকার করানোর জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন, যেমনটা আমি শুরুতে উল্লেখ করেছি। যখন বিভিন্ন হুমকি কিংবা প্রলোভন, কোনোটাই কাজ করেনি, তখন আমাকে সারানস্ক্ নামক শহরের কাছাকাছি একটা শিবিরে সাত বছরের কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি দেওয়া হয়। সেই শিবিরে যাওয়ার পথে আমি জানতে পারি যে, আমাদের দ্বিতীয় মেয়ে ওলগার জন্ম হয়েছে। যদিও আমার স্ত্রী ও মেয়েরা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে ছিল, তবুও আমি এই বিষয়টা চিন্তা করে সান্ত্বনা লাভ করতাম যে, মারিয়া ও আমি যিহোবার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি।
বছরে একবার মারিয়া আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য সারানস্কে আসত, যদিও টুলুন থেকে সেখানে আসার ও ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনে ১২ দিন সময় লাগত। প্রতি বছর ও আমার জন্য এক জোড়া নতুন বুটজুতো নিয়ে আসত। সেই জুতোগুলোর নীচে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার সাম্প্রতিক কপিগুলো লুকানো থাকত। একবার, মারিয়া আমাদের ছোটো ছোটো দুই মেয়েকেও তার সঙ্গে করে নিয়ে আসে। সেই সময়টা আমার জন্য খুবই বিশেষ ছিল। আপনারা হয়তো কল্পনা করতে পারছেন, তাদের দেখে ও তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পেরে আমি কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম!
নতুন জায়গা ও নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা
১৯৬৬ সালে, আমাকে শ্রমশিবির থেকে মুক্ত করা হয় আর আমি ও আমার পরিবার কৃষ্ণ সাগরের কাছাকাছি আরমাভির নামক শহরে চলে যাই। সেখানে আমাদের দুই ছেলে ইয়ারাস্লাভ ও পাভেলের জন্ম হয়।
কিছুসময় পরই, কেজিবি অফিসাররা বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনা খুঁজে বের করার জন্য আমাদের বাড়ি তল্লাশি করতে শুরু করে। তারা সমস্ত জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে, এমনকী গোরুর খাবারের মধ্যেও। এইরকম রোমীয় ১২:২১.
এক তল্লাশি করার সময়, অফিসাররা গরমের কারণে ঘেমে গিয়েছিল আর তাদের পোশাক ধূলোয় ভরে গিয়েছিল। তাদের দেখে মারিয়ার মায়া হয় কারণ তারা কেবল আদেশ পালন করছিল। মারিয়া তাদের জুস খেতে দেয় আর তাদের পোষাক থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলার জন্য একটা ব্রাশ, একটা পাত্রে জল ও গামছা এনে দেয়। পরবর্তী সময় যখন কেজেবি প্রধান সেখানে আসেন, তখন অফিসাররা যে-সদয় ব্যবহার লাভ করেছে, সেই বিষয়ে তাকে জানায়। চলে যাওয়ার সময় সেই প্রধান আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং আমাদের বিদায় জানিয়ে হাত নাড়েন। আমরা এটা দেখে আনন্দিত হই যে, আমরা যখন ক্রমাগত ‘উত্তমের দ্বারা মন্দকে পরাজয় করিবার’ চেষ্টা করি, তখন ভালো ফলাফল লাভ করা যায়।—বহু তল্লাশি সত্ত্বেও আমরা আরমাভিরে প্রচার করা চালিয়ে যাই। এ ছাড়া, আমরা আমাদের পাশের শহর কুরগানিন্স্কে প্রকাশকদের একটা ছোট্ট দলকে শক্তিশালী করার কাজেও সাহায্য করি। এটা খুবই আনন্দদায়ক যে, বর্তমানে আরমাভিরে ছ-টা মণ্ডলী রয়েছে এবং কুরগানিন্স্কে চারটে মণ্ডলী রয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে, এমন সময় এসেছিল যখন আমরা যিহোবাকে আমাদের সর্বোত্তমটা দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু, আমরা যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ কারণ তিনি বিশ্বস্ত ভাইদের ব্যবহার করে আমাদের সংশোধন করেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিলেন। (গীত. ১৩০:৩) এ ছাড়া, এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে সেবা করাও আমাদের জন্য এক গুরুতর পরীক্ষা ছিল, যারা আসলে কেজিবি-র গুপ্তচর ছিল কিন্তু আমাদের অজান্তেই মণ্ডলীর অংশ হয়ে উঠেছিল। তাদের দেখে উদ্যোগী বলে মনে হতো আর তারা পরিচর্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত। কেউ কেউ এমনকী সংগঠনে দায়িত্বভার লাভ করেছিল। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ পেয়েছিল।
১৯৭৮ সালে, মারিয়ার বয়স যখন ৪৫ বছর, তখন ও আবার গর্ভবতী হয়। যেহেতু ও গুরুতর হৃদরোগে ভুগছিল, তাই ডাক্তাররা এটা ভেবে ভয় পেয়ে যায় যে, এই সন্তানের কারণে মারিয়ার জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। তাই, তারা মারিয়াকে গর্ভপাত করানোর বিষয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করে। মারিয়া এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, কয়েক জন ডাক্তার একটা সিরিঞ্জ নিয়ে সারা হাসপাতালে মারিয়ার পিছন পিছন ঘুরতে থাকে আর কোনোভাবে ওকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার চেষ্টা করে, যাতে ও এক অপরিণত শিশুর জন্ম দেয়। মারিয়া ওর গর্ভের শিশুকে রক্ষা করার জন্য হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসে।
কেজিবি আমাদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেয়। আমরা এস্টোনিয়ায় তালিন নামক শহরের কাছাকাছি একটা গ্রামে চলে যাই, যেটা সেইসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। আগে উল্লেখিত সেই ডাক্তারদের অনুমানের বিপরীতে, তালিনে মারিয়া এক সুস্থ-সবল ছেলের জন্ম দেয়। আমরা তার নাম রাখি ভিটালি।
পরে, আমরা এস্টোনিয়া থেকে রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত নিয়েজলোবনায়ায় বাস করার জন্য চলে আসি। আমরা সতর্কতার সঙ্গে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভ্রমণের এলাকাগুলোতে প্রচার করতাম, যেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকেরা বেড়াতে আসত। তারা সুস্বাস্থ্য লাভ করার জন্য সেখানে বেড়াতে আসত কিন্তু অনেকেই অনন্তজীবনের আশা নিয়ে ফিরে যেত!
আমাদের সন্তানদের যিহোবাকে ভালোবাসতে শেখানো
আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যিহোবার প্রতি প্রেম ও তাঁকে সেবা করার আকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলার চেষ্টা করি। আমরা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এমন ভাইদের আমন্ত্রণ জানাতাম, যারা আমাদের সন্তানদের উপর উত্তম প্রভাব ফেলত। আমার ভাই গ্রিগোরি, যে ১৯৭০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করেছিল, প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসত। গ্রিগোরি আমাদের বাড়িতে এলে আমরা সবাই তা উপভোগ করতাম কারণ সে খুবই আনন্দপূর্ণ ব্যক্তি ছিল এবং রসিকতা করতে ভালোবাসত। আমাদের বাড়িতে যখন অতিথিরা আসত, তখন প্রায়ই আমরা বাইবেলভিত্তিক বিভিন্ন খেলা খেলতাম আর এর ফলে, আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে বাইবেলের ঐতিহাসিক বিবরণগুলোর প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল।
১৯৮৭ সালে, আমাদের ছেলে ইয়ারাস্লাভ, লাটভিয়ার রিগা নামক শহরে চলে যায়, যেখানে সে আরও খোলাখুলিভাবে প্রচার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু, সে যখন সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে প্রত্যাখ্যান করে, তখন তাকে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং সেই সময়ের মধ্যে তাকে ন-টা ভিন্ন জেলে রাখা হয়। আমি তাকে আমার কারাবাসের অভিজ্ঞতার বিষয়ে যা বলি, তা তাকে ধৈর্য ধরতে সাহায্য করে। পরবর্তী সময়, সে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করে। ১৯৯০ সালে আমাদের ১৯ বছর বয়সি ছেলে পাভেল, যে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করত, জাপানের উত্তর দিকে সাখালিন নামক একটা দ্বীপে গিয়ে তার সেবা চালিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। প্রথমে, আমরা তাকে সেখানে যেতে দিতে চাইনি। সেই দ্বীপে মাত্র ২০ জন প্রকাশক ছিল আর আমরা সেখান থেকে ৯,০০০ কিলোমিটারেরও (৫,৫০০ মাইল) বেশি দূরে বাস করতাম। কিন্তু, অবশেষে আমরা রাজি হই আর সেটা সত্যিই এক উত্তম সিদ্ধান্ত ছিল। সেই দ্বীপের লোকেরা ঈশ্বরের রাজ্যের বার্তার প্রতি সাড়া দেয়। কয়েক বছরের মধ্যেই সেখানে আটটা মণ্ডলী গড়ে ওঠে। পাভেল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সাখালিনে সেবা করে। সেইসময়, কেবল আমাদের সবচেয়ে ছোটো ছেলে ভিটালি আমাদের সঙ্গে থাকত। ছোটোবেলা থেকেই সে বাইবেল পড়তে ভালোবাসত। ১৪ বছর বয়সে, সে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করে আর আমি দু-বছর তার সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করি। সেটা সত্যিই এক দারুণ সময় ছিল! ১৯ বছর বয়সে, ভিটালি বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার সুযোগ পায় আর সে তার কার্যভারের এলাকায় চলে যায়।
১৯৫২ সালে একজন কেজিবি অফিসার মারিয়াকে বলেছিলেন: “তোমার বিশ্বাস অস্বীকার করো, না হলে তোমাকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। তুমি যখন বের হয়ে আসবে, তখন তুমি বুড়ি হয়ে যাবে আর তোমার পাশে কেউ থাকবে না।” কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটেনি। আমরা আমাদের অনুগত ঈশ্বর যিহোবার, আমাদের সন্তানদের আর সেইসঙ্গে আমরা যে-বহুসংখ্যক লোককে সত্য খুঁজে পেতে সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা লাভ করেছি। আমাদের সন্তানরা যে-সমস্ত জায়গায় সেবা করেছে, মারিয়া ও আমি সেই জায়গাগুলোতে যাওয়ার সুযোগ লাভ করেছি। আমরা সেই ব্যক্তিদের চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার অনুভূতি দেখেছি, যাদেরকে আমাদের সন্তানরা যিহোবা সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করেছে।
যিহোবার মঙ্গলভাবের জন্য কৃতজ্ঞ
১৯৯১ সালে যিহোবার সাক্ষিদের কার্যকলাপকে বৈধ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রচার কাজের প্রতি আমাদের উদ্যোগকে নবীনীকৃত করে তোলে। আমাদের মণ্ডলী এমনকী একটা বাস কেনে, যাতে আমরা সপ্তাহের প্রতিটা ছুটির দিনে আশেপাশের শহর ও গ্রামগুলোতে গিয়ে প্রচার করতে পারি।
আমি খুবই খুশি যে, ইয়ারাস্লাভ ও তার স্ত্রী আলিয়োনা এবং পাভেল ও তার স্ত্রী রাইয়া বেথেলে সেবা করে আর ভিটালি ও তার স্ত্রী স্ভেটলানা সীমার কাজে সেবা করে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো মেয়ে ইরিনা ও তার পরিবার জার্মানিতে বাস করে। তার স্বামী ভ্লাডিমির ও তিন ছেলে, সবাই প্রাচীন হিসেবে সেবা করে। আমাদের মেয়ে ওলগা এস্টোনিয়ায় বাস করে এবং নিয়মিতভাবে আমাকে ফোন করে। দুঃখের বিষয় হল, ২০১৪ সালে আমি আমার প্রিয় স্ত্রী মারিয়াকে মৃত্যুতে হারাই। আমি ওকে পুনরুত্থানে আবারও দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি! বর্তমানে আমি বেলগোরাড নামক শহরে বাস করি এবং এখানকার ভাইয়েরা আমাকে অনেক সাহায্য করে।
এত বছর ধরে যিহোবাকে সেবা করার সময় আমি শিখেছি যে, বিশ্বস্ততা বজায় রাখার জন্য আমাদের কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হয় কিন্তু যিহোবা এর বিনিময়ে যে-মনের শান্তি প্রদান করেন, সেটার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা করা যায় না। মারিয়া ও আমি দৃঢ় থাকার ফলে আমাদের কল্পনার চেয়ে আরও বেশি আশীর্বাদ লাভ করেছি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর পতন হওয়ার আগে এখানকার প্রকাশকদের সংখ্যা ছিল কেবল ৪০,০০০-রের একটু বেশি। কিন্তু এখন, যে-দেশগুলো পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, সেগুলোতে ৪,০০,০০০-রও বেশি প্রকাশক রয়েছে! এখন আমার বয়স ৮৩ বছর আর আমি একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করে যাচ্ছি। যিহোবার সাহায্যের ফলে আমি সবসময় ধৈর্য ধরার শক্তি লাভ করেছি। যিহোবা আমাকে প্রচুররূপে পুরস্কৃত করেছেন।—গীত. ১৩:৫, ৬.
^ অনু. 4 সোভিয়েত রাষ্ট্র নিরাপত্তা কমিটি-কে রাশিয়ান ভাষায় সংক্ষেপে কেজিবি বলা হয়।