আমাদের আর্কাইভ থেকে
“কোনো রাস্তাই দুর্গম কিংবা অনেক দীর্ঘ নয়”
ভ্রমণক্লান্ত দু-জন ব্যক্তি ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে ধুলোবালিপূর্ণ একটা ট্রাক ধীরে ধীরে চালিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পৌঁছেছিলেন। এর এক বছর আগে তারা এই শহর থেকে বের হয়েছিলেন এবং সেই মহাদেশের প্রত্যন্ত ও এবড়োখেবড়ো এলাকার মধ্য দিয়ে ১৯,৩০০ কিলোমিটারেরও (১২,০০০ মাইলেরও) বেশি পথ ভ্রমণ করেছিলেন। এই ব্যক্তিরা কোনো আবিষ্কারক অথবা দুঃসাহসী অভিযাত্রী ছিলেন না। আর্থার উইলিস এবং বিল নুল্যান্ডস্ ছিলেন এমন উদ্যমী অগ্রগামী, যারা বিশাল অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার নিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।
১৯২০-এর দশকের শেষের দিক পর্যন্ত, অস্ট্রেলিয়ার অল্পসংখ্যক বাইবেল ছাত্র * মূলত উপকূলীয় বিভিন্ন শহর ও এগুলোর আশেপাশের এলাকায় প্রচার করেছিল। দেশের মধ্য ভাগ জনবিরল ও অনুর্বর ছিল আর এই এলাকার আকার যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি। তবে, ভাইয়েরা একটা বিষয় মনে রেখেছিল আর তা হল, যিশুর অনুসারীরা তাঁর সম্বন্ধে “পৃথিবীর প্রান্ত পর্য্যন্ত” সাক্ষ্য দেবে এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকাও এর অন্তর্ভুক্ত। (প্রেরিত ১:৮) কিন্তু কীভাবে তারা এত বিশাল এক কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিল? যিহোবা তাদের প্রচেষ্টায় আশীর্বাদ করবেন এই বিষয়ে যেহেতু তাদের পুরোপুরি আস্থা ছিল, তাই তারা যথাসাধ্য করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল।
অগ্রগামীরা পথ তৈরি করে দিয়েছিল
১৯২৯ সালে, কুইন্সল্যান্ড ও অষ্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের দুটো মণ্ডলী দেশের মধ্য ভাগে প্রচার করার জন্য কিছু উন্নত মানের মোটরচালিত ভ্যান নির্মাণ করেছিল, যেগুলো ভ্রাম্যমাণ বাড়ির মতো ছিল। এই ভ্যানগুলো বলিষ্ঠ অগ্রগামীরা চালাত কারণ তারা খারাপ রাস্তার মধ্য দিয়েও চালাতে পারত আর সেগুলো নষ্ট হয়ে গেলে মেরামত করতে পারত। এই অগ্রগামীরা এমন অনেক জায়গায় গিয়েছিল, যে-জায়গাগুলোতে আগে কখনো সাক্ষ্য দেওয়া হয়নি।
অগ্রগামীদের মধ্যে যাদের গাড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারা সাইকেলে চড়ে প্রত্যন্ত এলাকায় যেত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৩২ সালে ২৩ বছর বয়সি ভাই বেনেট ব্রিকেল, কুইন্সল্যান্ডের রকহ্যাম্পটন থেকে যাত্রা শুরু করে পাঁচ মাস ধরে সেই প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচার করেছিলেন। তার সাইকেলে তিনি কয়েকটা কম্বল, জামাকাপড়, খাবারদাবার ও অনেক বইপত্র বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাইকেলের চাকা যখন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি সেটা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে গিয়েছিলেন আর এই নির্ভরতা বজায় রেখেছিলেন, যিহোবা তাকে নির্দেশনা দেবেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য শেষ ৩২০ কিলোমিটার (২০০ মাইল) পথ অতিক্রম করার সময় তিনি সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এমন এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, যে-এলাকায় লোকেরা আগে জলের অভাবে মারা গিয়েছিল। এরপর ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভাই
ব্রিকেল অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সাইকেল, মোটর সাইকেল ও গাড়ি চালিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি আদিবাসীদের কাছে প্রচার করার পথ খুলে দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন মণ্ডলী গঠন করতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি সেই প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অনেক সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন আর সেখানকার লোকেরা তাকে অনেক সম্মান করত।প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাটিয়ে ওঠা
অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে পৃথিবীর জনবিরল মহাদেশগুলোর মধ্যে একটা আর বিশেষভাবে প্রত্যন্ত এলাকায় খুব কম লোক বসবাস করে। তাই, যিহোবার লোকেরা সেই মহাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় লোকেদের খুঁজে পাওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মনোভাব দেখিয়েছিল।
অগ্রগামী ভাই স্টুয়ার্ট কেলটি এবং উইলিয়াম টরিংটন এই ধরনের দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে তারা বিশাল সিম্পসন মরুভূমি পার হয়ে এলিস স্প্রিং নামে একটা শহরে প্রচার করার জন্য গিয়েছিলেন, যে-শহরটা সেই মহাদেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তাদের ছোটো গাড়িটা যখন একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তখন তারা উটের পিঠে চড়ে প্রচার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন, এমনকী ভাই কেলটির একটা পা কাঠের হওয়া সত্ত্বেও! অগ্রগামীরা তাদের প্রচেষ্টার ফল লাভ করেছিলেন, যখন প্রত্যন্ত এলাকার একটা রেলস্টেশনে একজন হোটেল মালিকের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। চার্লস বার্নহার্ট নামে সেই ব্যক্তি সত্য গ্রহণ করেছিলেন, তার হোটেল বিক্রি করে দিয়েছিলেন এবং ১৫ বছর ধরে একা একা অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি অঞ্চল ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে অগ্রগামীর কাজ করেছিলেন।
বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করার জন্য সেই সময়ের অগ্রগামীদের নিশ্চিতভাবেই সাহস ও দৃঢ় মনোবল বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের প্রচার অভিযানের সময়ে শুরুতে উল্লেখিত ভাই আর্থার উইলিস এবং বিল নুল্যান্ডস্ একবার ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) পথ অতিক্রম করার জন্য দু-সপ্তাহ ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। কারণ ভারী বৃষ্টির ফলে মরুভূমি কর্দমাক্ত সমুদ্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কখনো কখনো, প্রখর রোদের তাপে বালির পাহাড়ের উপর দিয়ে ট্রাক ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা ঘেমে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারা পাথুরে উপত্যকা ও বালিময় নদীগর্ভের উপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায়ই তাদের ট্রাক নষ্ট হয়ে যেত আর তখন তারা কয়েক দিন ধরে পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল চালিয়ে কাছাকাছি কোনো শহরে যেতেন আর এরপর ট্রাক মেরামতের যন্ত্রাংশ না আসা পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে থাকতেন। এই ধরনের দুর্দশার মধ্যেও তারা এক ইতিবাচক মনোভাব বজায় রেখেছিলেন। স্বর্ণযুগ (ইংরেজি) পত্রিকায় ছাপানো একটা বিবৃতি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভাই আর্থার উইলিস এভাবে মন্তব্য করেছিলেন: “তাঁর সাক্ষিদের জন্য কোনো রাস্তাই দুর্গম কিংবা অনেক দীর্ঘ নয়।”
দীর্ঘসময়ের একজন অগ্রগামী ভাই চার্লস হেরিস বলেছিলেন, প্রত্যন্ত এলাকার একাকিত্ব ও শারীরিক কষ্ট আসলে তাকে যিহোবার আরও নিকটবর্তী করেছে। তিনি আরও বলেছিলেন: “যতদূর সম্ভব কম জিনিসপত্র নিয়ে জীবনযাপন করতে পারলে, তা আরও ভালো। যিশু যদি প্রয়োজনের সময় খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর জন্য ইচ্ছুক হতে পারেন, তা হলে আমাদের কার্যভার পালন করতে গিয়ে প্রয়োজন হলে আমাদেরও আনন্দের সঙ্গে একই বিষয় করতে হবে।” আর অনেক অগ্রগামী সেটাই করেছিল। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কারণে, সুসমাচার সেই মহাদেশের প্রত্যেক প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এবং অসংখ্য ব্যক্তি ঈশ্বরের রাজ্যের পক্ষ নিতে পেরেছিল।
^ অনু. 4 বাইবেল ছাত্ররা ১৯৩১ সালে যিহোবার সাক্ষি নাম গ্রহণ করেছিল।—যিশা. ৪৩:১০.