দুঃসময়ে আমরা ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করতে শিখেছিলাম
দুঃসময়ে আমরা ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করতে শিখেছিলাম
রোজি মেজর দ্বারা কথিত
আমার প্রথম সন্তান যখন পাঁচ মাসের পেটে তখন আমার শাশুড়ী দেখেন যে আমার দুটো পা-ই বেশ ফুলে উঠেছে। ১৯৯২ সালের মার্চ মাসের সেই দিনে আমার স্বামী, জোয়ি ও আমার জানা ছিল না যে আমাদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে যা হবে যিহোবার ওপর আমাদের নির্ভরতার পরীক্ষা।
এক সপ্তাহ পর আমার ডাক্তার বলেন যে আমার রক্তচাপ খুব বেড়ে গেছে। তিনি আমাকে পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা বলায় আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষা করে ধরা পড়েছিল যে আমার প্রিকামসিয়া হয়েছে। আর এটা এমন একটা জটিল রোগ যা গর্ভাবস্থায় হয়। *
হাসপাতালের ডাক্তার আমাদের সরাসরি বলেন যে আমাকে ও বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে এখনই প্রসব করিয়ে ফেলতে হবে। আমার স্বামী এবং আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম যে “কিন্তু বাচ্চার বয়স যে এখনও ২৪ সপ্তাহও হয়নি!” আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। “এই অবস্থায় আমাদের বাচ্চা কীভাবে বেঁচে থাকবে?” ডাক্তার সদয়ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন ‘ঠিক আছে আমি কিছুটা সময় অপেক্ষা করব। কিন্তু আপনার অবস্থা যদি খারাপের দিকে যায় তাহলে প্রসব করাতেই হবে।’ এইভাবে তের দিন কেটে যায় কিন্তু আমার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। ডাক্তার আমার স্বামীকে ডেকে পাঠান এবং আমরা একেবারে নিরুপায় হয়ে প্রসব করানোর সিদ্ধান্ত নিই।
প্রসব
প্রসবের আগের দিন রাতে শিশু চিকিৎসক ডঃ ম্যাকনেইল আমাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং বুঝিয়ে বলেন যে সময়ের আগে জন্মানো শিশুকে নিয়ে আমাদের কোন্ কোন্ সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, যেমন মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে, ফুসফুস অপরিণত হওয়াতে ফিলিপীয় ৪:৭) পরের দিন সকালে সিজার করে আমাদের বাচ্চা হয়। সে মাত্র এক পাউন্ড ১০ আউন্স হয়েছিল। আমরা তার নাম রাখি যোয়েন শেলি।
ভালভাবে কাজ নাও করতে পারে এবং আরও অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। আমি “সমস্ত চিন্তার অতীত যে ঈশ্বরের শান্তি” তার জন্য প্রার্থনা করেছিলাম যাতে তা আমাকে শক্তি জোগায় আর যা কিছুই হোক না কেন, আমি যেন তা মেনে নিতে ও সামলে উঠতে পারি। (পাঁচ দিন পর আমি খালি হাতে ঘরে ফিরে আসি। আমার ছোট্ট মেয়েকে আমি হাসপাতালে যেখানে বিশেষ বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া হয় সেখানে রেখে আসি, সেখানে সে তার জীবনের জন্য লড়াই করছিল। দুই সপ্তাহ পর যোয়েনের নিউমোনিয়া হয়। আমরা খুব কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম যখন সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মাত্র একদিন পর তার পেটে ইনফেকশন হয় এবং তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। ছয়দিনের মধ্যে যোয়েন কিছুটা ভাল হয়ে ওঠে ও তার ওজনও বাড়তে থাকে। আমরা কী যে খুশী হয়েছিলাম তা বলার নয়! কিন্তু আমাদের সেই আনন্দ বেশি দিন টেকেনি। ডঃ ম্যাকনেইল আমাদের জানালেন যে যোয়েন রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। তিনি যোয়েনের রক্তকোষ তৈরি করার জন্য কৃত্রিম হরমোন ইরিথ্রপাইওটিন (ই.পি.ও) দেওয়ার পরামর্শ দেন। বাহামাসের যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিস নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনের হাসপাতাল তথ্য বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা খুব তাড়াতাড়ি করে ডঃ ম্যাকনেইলকে ই.পি.ও এনে দেন ও তা ব্যবহারের পদ্ধতি সম্বন্ধে সবচেয়ে সাম্প্রতিক তথ্য পাঠান এবং সেই মতো চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়।
আরও সমস্যা
কয়েক সপ্তাহ আমাদের খুবই উদ্বিগ্নতায় কাটে। যোয়েন তখন অন্ত্রের রোগ, সিজারের কারণে মাঝে মাঝে এপনিয়া (শ্বাসকষ্ট), হিমোগ্লোবিন কম এবং নিউমোনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম যে এর কোন একটা না হঠাৎ তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কিন্তু যোয়েন ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে। যোয়েনের বয়স তিন মাস হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তখনও সে হাসপাতালে ছিল আর তার ওজন মাত্র তিন পাউন্ড হয়েছিল। কিন্তু তখন জীবনে প্রথম বার সে অক্সিজেন ছাড়াই শ্বাস নিতে শুরু করে। তার হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে শুরু করে। ডাক্তার বলেছিলেন যে তার ওজন আরও এক পাউন্ড বাড়লে আমরা তাকে ঘরে নিয়ে যেতে পারব।
তিন সপ্তাহ পর যোয়েনের মারাত্মক শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও এর কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার অবস্থা খারাপের দিকেই যেতে থাকে আর বিশেষ করে তাকে খাওয়ানোর সময় এমন হতো। অবশেষে ধরা পড়ে যে যোয়েনের পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর মধ্যে ইনফেকশন হয়েছে। যার ফলে খাওয়ার পর তার খাদ্যনালী বন্ধ হতো না আর পাকস্থলি থেকে সব খাবার ফিরে এসে তার গলায় আটকে যেত। আর এই কারণেই তার শ্বাসনালী আটকে যেত ও সে নিশ্বাস নিতে পারত না।
অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে যোয়েন বাচ্চাদের বিভাগে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এই কারণে, সময়ের আগে জন্মানো অনেক বাচ্চা একে একে মারা যাচ্ছিল। এই দুর্বল অবস্থায় অনেক সময় ধরে যোয়েনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকতো। তাকে বাঁচানোর সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। শিশু চিকিৎসক আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ করেই সে শ্বাস নিতে শুরু করে। কিন্তু তারপরেই আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং আবারও তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয় আর আমরা ধরে নিই যে যোয়েন আর আমাদের সঙ্গে থাকবে না। কিন্তু সে বেঁচে গিয়েছিল এবং আমরা যিহোবার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম।
যিহোবার ওপর আরও বেশি করে নির্ভর করতে শেখা
যোয়েনের জন্মের আগে সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করার সময় আমাদের মনে হয়েছিল যেন আমাদের নৌকা ঘাটের কাছে এসে ডুবে গিয়েছে, যেখান থেকে আমরা সাঁতার কেটে সহজেই তীরে পৌঁছাতে পারব। কিন্তু তখন আমাদের সামনে যে পরিস্থিতি তা দেখে আমাদের মনে হয়েছিল যেন আমরা মাঝ সমুদ্রে পড়ে গিয়েছি, যেখান থেকে কোথাও কোন তীর দেখা যায় না। পিছনে ফিরে তাকিয়ে আমরা বুঝেছি যে যোয়েনের জন্মের আগে আমরা কোন কোন সময় আমাদের ওপর একটু বেশি নির্ভর করতাম। কিন্তু যোয়েনের বিষয়ে অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে যখন সমাধান মানুষের হাতের বাইরে চলে যায় তখন যিহোবার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে হয়। আমরা যীশুর পরামর্শ মতো চলতে শিখেছিলাম অর্থাৎ আমাদের শুধু সেই দিনের জন্যই ভাবা দরকার। (মথি ৬:৩৪) আমরা যিহোবার ওপর নির্ভর করতে শিখেছিলাম যে আমাদের ঠিক কী চেয়ে প্রার্থনা করতে হবে। আমরা বাইবেলের প্রজ্ঞা ও “পরাক্রমের উৎকর্ষ” এর জন্য যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম যা আমাদেরকে এইরকম কঠিন সমস্যাকে সামলে নিতে শক্তি জুগিয়েছিল।—২ করিন্থীয় ৪:৭.
সেই কঠিন সময়ে আমি প্রায়ই মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়তাম। আমি যোয়েনকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতাম না। আমার স্বামী জোয়ি আধ্যাত্মিক সাহায্য জুগিয়ে আমাকে সামলেছিলেন। এইজন্য আমি তার কাছেও কৃতজ্ঞ।
যোয়েন ঘরে আসে
যোয়েনের স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ভাল হতে থাকে। একদিন সে তার মুখ থেকে অক্সিজেন টিউবটা প্রায় সরিয়ে ফেলে। ডঃ ম্যাকনেইল মনে করেছিলেন যে যোয়েন এখন ঘরে যেতে পারে। আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না! আমরা তাকে ঘরে আনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলাম ও শিখে নিলাম যে কীভাবে তাকে টিউবে করে খাওয়াতে হবে। আমরা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছিলাম, হৃদস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাসের ওপর নজর রাখার জন্য একটা মনিটর ভাড়া নিয়েছিলাম। আর হঠাৎ করে কিছু ঘটলে কী করে জ্ঞান ফিরিয়ে আনা যায় সে সম্বন্ধে শিখেছিলাম। অবশেষে ১৯৯২ সালের ৩০শে অক্টোবর তারিখে যোয়েন ঘরে আসে। সে ২১২ দিন শিশুদের কক্ষে কাটিয়েছিল আর বলতে গেলে আমাদেরও প্রায় সেখানেই কাটাতে হয়েছিল।
প্রথম থেকেই পরিবারের লোকেরা ও যিহোবার সাক্ষিদের স্থানীয় মণ্ডলীর ভাইবোনেরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে প্রমাণ করেছিলেন যে আসলেই তারা যিহোবার কাছ থেকে এক আশীর্বাদ। তারা আমাদের ঘরদোর পরিষ্কার করে দিতেন, রান্না করে দিতেন, হাসপাতালে যেতে সাহায্য করতেন এবং যোয়েনের দেখাশোনা করতেন, যাতে আমি একটু ঘুমাতে পারি। এই সময়ে আমরা আমাদের ভাইবোনদের ব্যক্তিত্বের সেই সুন্দর দিকগুলো দেখতে পেরেছিলাম যা এতদিন আমাদের অজানা ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ কেউ আমাদের বলতেন যে কোন্ আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো তাদেরকে কঠিন সময়ে সাহায্য করেছিল।
আমাদের আজকের জীবন
যোয়েনের অনেক সমস্যা থাকায় তাকে ভালভাবে দেখাশোনা করার জন্য আমাদেরকে অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। যখন তার বয়স ১৯ মাস হয়েছিল তখন আমরা জানতে পেরেছিলাম মস্তিষ্কে ক্ষতি হওয়ার কারণে যোয়েন সেরিব্রাল পালসিতে ভুগছে। এরপর ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর অসুখের জন্য তার বড় একটা অপারেশন হয়। ১৯৯৭ সালে যোয়েন আবারও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু যখন তার খাবার পালটে দেওয়া হয়েছিল তখন সে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যগত সমস্যা তার শারীরিক বৃদ্ধিকে ধীর করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে একটা বিশেষ স্কুলে যাচ্ছে এবং ভাল করছে। সে হাঁটতে পারে না, খুব বেশি কথাও বলতে পারে না কিন্তু সে আমাদের সঙ্গে প্রত্যেকটা সভায় যায় এবং ঘরে ঘরে প্রচারে যেতে পারে। এখন সে এক হাসিখুশি মেয়ে।
এই কষ্টকর সময়গুলোতে যিহোবা আমাদের অনেক সান্ত্বনা দিয়েছেন। আমরা সংকল্প করেছি, যে কোন সমস্যাই আসুক না কেন, এমনকি যে সম্বন্ধে হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না, আমরা সবসময় যিহোবার ওপর নির্ভর করব ও “সদাপ্রভুতে আনন্দ করিব।” (হবক্কূক ৩:১৭, ১৮; উপদেশক ৯:১১) আমরা যিহোবার প্রতিজ্ঞাত পরমদেশ পৃথিবীর জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছি যেখানে আমাদের প্রিয় যোয়েন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করতে পারবে।—যিশাইয় ৩৩:২৪.
[পাদটীকাগুলো]
^ প্রিকামসিয়া হল এমন একটা রোগ যাতে একজন গর্ভবতী মহিলার ধমনীতে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয় আর এর ফলে তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ও সেইসঙ্গে গর্ভে এবং ভ্রুণে খুব কম রক্ত চলাচল হয়। এটা কেন ঘটে তার কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি কিন্তু প্রমাণ দেখায় যে এই রোগ বংশগত।
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমাদের মেয়ে যোয়েন
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও যোয়েন এক হাসিখুশি মেয়ে