“খ্রীষ্টের মন” জানা
“খ্রীষ্টের মন” জানা
“‘কে প্রভুর [যিহোবার] মন জানিয়াছে যে, তাঁহাকে উপদেশ দিতে পারে?’ কিন্তু খ্রীষ্টের মন আমাদের আছে।”—১ করিন্থীয় ২:১৬.
১, ২. যিহোবা তাঁর বাক্যে যীশুর সম্বন্ধে কি বলা আরও বেশি জরুরি বলে মনে করেছিলেন?
যীশু দেখতে কেমন ছিলেন? তাঁর চুল, গায়ের রং, চোখের রং কেমন ছিল? তিনি লম্বা ছিলেন বা বেঁটে? রোগা ছিলেন বা মোটা? শত শত বছর ধরে শিল্পীরা নিজেদের কল্পনা মতো যীশু খ্রীষ্টের অনেক ছবি এঁকেছেন আর তাঁকে আলাদা আলাদাভাবে এঁকেছেন। তাদের কেউ কেউ তাঁকে স্বাস্থ্যবান ও হাসিখুশি ব্যক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন আবার কেউ কেউ দুর্বল ও একেবারে নিষ্প্রাণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন।
২ কিন্তু, যীশুর চেহারা কেমন ছিল সে বিষয়ে বাইবেলে কিছু লেখা নেই। কারণ যিহোবা যীশুর চেহারা নয় বরং তাঁর সম্বন্ধে অন্য কিছু বলাকে আরও বেশি জরুরি বলে মনে করেছিলেন আর তা হল যীশু খ্রীষ্টের স্বভাব, তিনি কী ধরনের ব্যক্তি ছিলেন। সুসমাচারের বইগুলো শুধু যীশু কী বলেছিলেন ও করেছিলেন তাই-ই বলে না বরং এই বইগুলোতে যীশু খ্রীষ্টের আবেগ, অনুভূতি ও তাঁর হৃদয়ের গভীরতাকে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে তিনি যা বলেছিলেন ও করেছিলেন তা কেন করেছিলেন আর কোন্ কথা ভেবে করেছিলেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা এই চারটে বই থেকে আমরা প্রেরিত পৌল যাকে “খ্রীষ্টের মন” বলেছিলেন সেই বিষয়ে জানতে পারি। (১ করিন্থীয় ২:১৬) যীশুর আবেগ, অনুভূতি ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। কেন? এর দুটো কারণ আছে।
৩. খ্রীষ্টের মন জেনে আমরা আসলে কী শিখি?
৩ প্রথমত, খ্রীষ্টের মন আমাদেরকে যিহোবার মনের এক আভাস দেয়। যীশু তাঁর পিতাকে এত ভালভাবে জানতেন, এত কাছ থেকে জানতেন যে তিনি বলতে পেরেছিলেন: “পুত্ত্র কে, তাহা কেহ জানে না, কেবল পিতা জানেন; আর পিতা কে, তাহা কেহ জানে না, কেবল পুত্ত্র জানেন, আর পুত্ত্র যাহার নিকটে তাঁহাকে প্রকাশ করিতে মানস করেন, সে জানে।” (লূক ১০:২২) তাই মনে হয় যেন যীশু এই কথাই বলতে চাইছিলেন, ‘তোমরা যদি জানতে চাও যে যিহোবা কেমন, তাহলে আমাকে দেখ।’ (যোহন ১৪:৯) এইজন্য সুসমাচারের এই চারটে বই পড়ে আমরা যখন দেখতে পাই যে যীশু কীভাবে ভাবতেন ও তাঁর অনুভূতি কেমন ছিল তখন আমরা আসলে শিখি যে যিহোবা কীভাবে ভাবেন ও তাঁর অনুভূতি কেমন। আর যখন আমরা এটা শিখব তখন আমরা ঈশ্বরের আরও কাছে আসব।—যাকোব ৪:৮.
৪. আমরা যদি সত্যি সত্যিই খ্রীষ্টের মতো কাজ করতে চাই, তাহলে প্রথমে আমাদের কী শিখতে হবে ও কেন?
৪ দ্বিতীয়ত, খ্রীষ্টের মন জেনে আমরা খুব ভালভাবে ‘তাঁহার পদচিহ্নের অনুগমন’ করতে পারি। (১ পিতর ২:২১) কিন্তু যীশুকে অনুসরণ করার মানে শুধু তাঁর মতো কথা বলা বা তাঁর মতো কাজ করা নয়। খ্রীষ্টকে অনুকরণ করার জন্য তাঁর যেমন “ভাব” ছিল আমাদেরও সেই একই ভাব গড়ে তোলা দরকার, যেহেতু আমরা সেইরকমই কথা বলি ও কাজ করি যেমন আমরা চিন্তা করি ও অনুভব করি। (ফিলিপীয় ২:৫) অন্য কথায়, আমরা যদি সত্যি সত্যিই খ্রীষ্টের মতো কাজ করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রথমে তাঁর মতো করে চিন্তা করতে ও অনুভব করতে শিখতে হবে অর্থাৎ অসিদ্ধ মানুষ হিসেবে আমাদের প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। তাই, আসুন আমরা সুসমাচার লেখকদের চোখ দিয়ে খ্রীষ্টের মনকে দেখি। তবে তার আগে আমরা সেই পরিস্থিতিকে দেখব যা হয়তো যীশুর চিন্তা ও অনুভূতিতে ছাপ ফেলেছিল।
পৃথিবীতে মানুষ হয়ে আসার আগে তাঁর জীবন
৫, ৬. (ক) আমাদের কাছের বন্ধুবান্ধবরা আমাদের ওপর কেমন ছাপ ফেলতে পারে? (খ) পৃথিবীতে আসার আগে ঈশ্বরের প্রথমজাত পুত্র কাদের সঙ্গে ছিলেন আর তা তাঁর ওপর কেমন ছাপ ফেলেছিল?
৫ যাদের সঙ্গে আমরা খুব বেশি মেলামেশা করি আমাদের সেই কাছের বন্ধুবান্ধবরা আমাদের ওপর ছাপ ফেলে, তারা আমাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং কাজের ওপর ভাল বা খারাপ দুধরনের ছাপই ফেলতে পারে। * (হিতোপদেশ ১৩:২০) পৃথিবীতে আসার আগে যীশু স্বর্গে কাদের সঙ্গে ছিলেন তা একবার ভেবে দেখুন। যোহন তার বইয়ে বলেন যে পৃথিবীতে আসার আগে যীশু স্বর্গে “বাক্য” ছিলেন অর্থাৎ তিনি ঈশ্বরের মুখপাত্র ছিলেন। যোহন বলেন: “আদিতে বাক্য ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বরের কাছে ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বর ছিলেন। তিনি আদিতে ঈশ্বরের কাছে ছিলেন।” (যোহন ১:১, ২) যেহেতু ঈশ্বরের কোন শুরু নেই তাই “আদিতে” বাক্য ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন, এই কথায় বোঝা যায় যে ঈশ্বর যখন থেকে সৃষ্টির কাজ শুরু করেছিলেন তখন থেকেই যীশু তাঁর সঙ্গে ছিলেন। (গীতসংহিতা ৯০:২) যীশু হলেন “সমুদয় সৃষ্টির প্রথমজাত।” অতএব, অন্যান্য স্বর্গদূত ও এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টির আগেই ঈশ্বর তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন।—কলসীয় ১:১৫; প্রকাশিত বাক্য ৩:১৪.
৬ কিছু বিজ্ঞানীরা বলেন যে আমাদের এই মহাবিশ্ব প্রায় বারোশ কোটি বছরের পুরনো। এই হিসেব যদি অন্তত কিছুটাও ঠিক হয়, তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি যে আদমকে সৃষ্টি করার আগে ঈশ্বরের প্রথমজাত পুত্র যীশু কত যুগ যুগ, অগণিত বছর ধরে তাঁর পিতার কাছে ছিলেন। (মীখা ৫:২ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) এত সময় একসঙ্গে কাটানোর ফলে তাঁদের দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই এক গভীর ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পৃথিবীতে আসার আগে এই প্রথমজাত পুত্র যীশুকে ঈশ্বরের প্রজ্ঞার প্রতিরূপও বলা হয়েছে যিনি নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন: “আমি দিন দিন আনন্দময় ছিলাম, [যিহোবার] সম্মুখে নিত্য আহ্লাদ করিতাম।” (হিতোপদেশ ৮:৩০) ভালবাসার উৎস, যিহোবা ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর পুত্র অগণিত বছর কাটিয়েছিলেন তাই নিশ্চয়ই তাঁর পুত্রের ওপর তিনি গভীর ছাপ ফেলেছিলেন! (১ যোহন ৪:৮) পুত্র তাঁর পিতার চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং পথকে জেনেছিলেন ও সেই মতো কাজ করেছিলেন যা অন্য আর কেউ করতে পারত না।—মথি ১১:২৭.
পৃথিবীতে যীশুর জীবন ও অন্য পরিস্থিতিগুলো
৭. ঈশ্বরের প্রথমজাত পুত্রের পৃথিবীতে আসার একটা কারণ কী ছিল?
৭ ঈশ্বরের পুত্রকে আরও কিছু শিখতে হয়েছিল কারণ যিহোবা চেয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র একজন দয়ালু, করুণাময় মহাযাজক হোন যিনি “আমাদের দুর্ব্বলতাঘটিত দুঃখে দুঃখিত হইতে পারেন।” (ইব্রীয় ৪:১৫) তাই তিনি একজন মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন যেন তিনি মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে বুঝতে পারেন, অনুভব করতে পারেন আর আমাদের দুর্বলতাঘটিত দুঃখে দুঃখিত হতে পারেন। এখন একজন মানুষ হওয়ার পর যীশু এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন যেগুলো আগে স্বর্গে থাকতে তিনি শুধু দেখেছিলেন, কখনও অনুভব করেননি। পৃথিবীতে এসে তিনি অনুভব করেছিলেন যে মানুষের আবেগ কী ও অনুভূতি কেমন। কখনও কখনও তিনিও ক্লান্ত হতেন, তাঁর পিপাসা পেত এবং খিদে পেত। (মথি ৪:২; যোহন ৪:৬, ৭) শুধু তাই-ই নয় তাঁকে সবধরনের দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। আর তা করেই তিনি “আজ্ঞাবহতা শিক্ষা করিলেন” আর এভাবেই মহাযাজক হওয়ার জন্য তিনি পুরোপুরি যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন।—ইব্রীয় ৫:৮-১০.
৮. পৃথিবীতে যীশুর প্রথম দিকের জীবন সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি?
৮ কিন্তু এই পৃথিবীতে যীশু আর কোন্ কোন্ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন? তাঁর ছেলেবেলা সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের খুব বেশি কিছু জানায় না। শুধু মথি এবং লূকই তাঁর জন্মের সময়কার কিছু ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন। সুসমাচারের লেখকেরা জানতেন যে পৃথিবীতে আসার আগে যীশু স্বর্গে ছিলেন। আর এর থেকেই বোঝা যায় যে পৃথিবীতে তাঁর সাড়ে তিন বছরের জীবনে তিনি কী ধরনের ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তবুও যীশু একজন পুরোপুরি মানুষ ছিলেন। সিদ্ধ হলেও তাঁকে তাঁর ছেলেবেলা, বাল্যকাল, কৈশোর ও যুবক হওয়া পর্যন্ত অনেক কিছু শিখতে হয়েছিল। (লূক ২:৫১, ৫২) বাইবেল যীশুর প্রথম দিকের জীবন সম্বন্ধে কিছু বিষয় বলে যে বিষয়গুলো তাঁর ওপর ছাপ ফেলেছিল।
৯. (ক) আমরা কী করে বলতে পারি যে যীশু এক গরিব পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন? (খ) তিনি কেমন অবস্থায় বড় হয়েছিলেন?
৯ যীশু এক গরিব পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর জন্মের চল্লিশ দিন পর যোষেফ ও মরিয়ম মন্দিরে যা উৎসর্গ করেছিলেন তার থেকেই এটা বোঝা যায়। হোমবলির জন্য একটা মেষশাবক এবং পাপার্থক বলির জন্য একটা কপোতশাবক অথবা ঘুঘু না এনে তারা “এক জোড়া ঘুঘু কিম্বা দুই কপোতশাবক” নিয়ে এসেছিলেন। (লূক ২:২৪) মোশির ব্যবস্থায় গরিব লোকেরা এইরকম উৎসর্গ করতে পারতেন। (লেবীয় পুস্তক ১২:৬-৮) পরে এই পরিবার আরও বড় হয়েছিল। অলৌকিকভাবে যীশুর জন্মের পর যোষেফ ও মরিয়মের আরও প্রায় ছয়জন ছেলেমেয়ে হয়েছিল। (মথি ১৩:৫৫, ৫৬) অতএব, যীশু এক বড় পরিবারে মানুষ হয়েছিলেন আর তাদের অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না।
১০. কী দেখায় যে মরিয়ম ও যোষেফ ঈশ্বরকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন ও ভয় করতেন?
১০ যীশুর বাবামা ঈশ্বরকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন, তারা ঈশ্বরকে ভয় করতেন আর তারা দুজনেই যীশুকে মানুষ করে তুলেছিলেন। তাঁর মা মরিয়ম ঈশ্বরকে খুবই ভালবাসতেন। তাই স্বর্গদূত গাব্রিয়েল তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন: “মঙ্গল হউক; প্রভু [যিহোবা] তোমার সহবর্ত্তী।” (লূক ১:২৮) যোষেফও একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। প্রতি বছর তিনি বিশ্বস্তভাবে যিরূশালেমে নিস্তারপর্ব পালন করতে যেতেন যদিও যিরূশালেম তার ঘর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল। মরিয়মও তার সঙ্গে যেতেন যদিও ব্যবস্থা শুধু পুরুষদের যাওয়ার কথা বলেছিল। (যাত্রাপুস্তক ২৩:১৭; লূক ২:৪১) যীশুর ১২ বছর বয়সে এইরকমই এক পর্ব থেকে ফেরার পথে যীশু তাদের সঙ্গে না থাকায় যোষেফ ও মরিয়ম হন্যে হয়ে যীশুকে খুঁজতে লাগেন আর পুরো যিরূশালেম মন্দির খোঁজার পর তারা যীশুকে মন্দিরে ধর্মগুরুদের মাঝে দেখতে পান। বাবামাকে চিন্তিত হতে দেখে যীশু বলেছিলেন: “আমার পিতার গৃহে আমাকে থাকিতেই হইবে, ইহা কি জানিতে না?” (লূক ২:৪৯) বালক যীশুর মনে ‘পিতা’ এই শব্দটায় নিশ্চয়ই অনেকখানি ভালবাসা মিশে ছিল। তাঁর বাবামা হয়তো তাঁকে বলেছিলেন যে যিহোবা হলেন তাঁর সত্যিকারের পিতা। কিন্তু তবুও তাঁর পালক পিতা যোষেফও নিশ্চয়ই খুব ভালভাবে পিতার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর যিহোবা নিশ্চয়ই তাঁর প্রিয় পুত্রকে লালন-পালন করার দায়িত্ব একজন কড়া অথবা নির্দয় লোককে দেবেন না!
১১. যীশু কোন্ কাজ শিখেছিলেন আর সেই সময়ে এই কাজ করতে গিয়ে কী কী করতে হতো?
১১ যীশু যখন নাসরতে ছিলেন তখন সম্ভবত তাঁর পালক পিতা যোষেফের কাছ থেকে তিনি ছুতোর মিস্ত্রির কাজ শিখেছিলেন। যীশু এই কাজে এতটাই নিপূণ হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁকেও লোকেরা “সূত্রধর” বলে ডাকত। (মার্ক ৬:৩) বাইবেলের সময়ে ছুতোর মিস্ত্রিরা ঘর বানাতো, আসবাবপত্র (যেমন টেবিল, স্টুল, বেঞ্চ) এবং চাষবাসের কাজে লাগে এমন জিনিসপত্র তৈরি করত। সা.কা দ্বিতীয় শতাব্দীতে জাস্টিন মারটায়ার তার ডায়ালগ উইথ ট্রাইফো বইয়ে যীশুর বিষয়ে লিখেছিলেন: “যীশু যখন পৃথিবীতে ছিলেন তখন তিনি ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করতেন আর তিনি লাঙল ও জোয়াল তৈরি করতেন।” এই কাজ সহজ ছিল না কারণ তখন ছুতোর মিস্ত্রিরা সম্ভবত কাঠ কিনতে পারত না। তাই তাকে জঙ্গলে গিয়ে গাছ ঠিক করতে হতো, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেটা কাটতে হতো ও সেই কাঠ বাড়িতে নিয়ে আসতে হতো। তাই যীশু জানতেন যে পরিবারের ভরণপোষণ করা, খরিদ্দারদের সঙ্গে দর কষাকষি করা আর ঘরসংসার চালানো কত কঠিন।
১২. আমরা কীভাবে বলতে পারি যে যোষেফ যীশুর মৃত্যুর আগেই মারা গিয়েছিলেন আর এর ফলে যীশুর ওপর কী কী দায়-দায়িত্ব এসেছিল?
১২ পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় যীশুর ওপর তাঁর পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল কারণ যীশুর মৃত্যুর আগেই যোষেফ মারা গিয়েছিলেন বলে মনে হয়। * ১৯০০ সালের ১লা জানুয়ারি সংখ্যার জায়ন্স ওয়াচ টাওয়ার বলেছিল: “পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায় যে যীশু বালক থাকতেই যোষেফ মারা গিয়েছিলেন আর তাই তাঁকে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করতে হয়েছিল। বাইবেলেও এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় কারণ বাইবেলে যীশুকে ছুতোর মিস্ত্রি বলা হয়েছে এবং তাঁর মা ও ভাইদের কথা অনেকবার বলা আছে কিন্তু যোষেফের সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। (মার্ক ৬:৩) . . . তাই মনে হয় যে [লূক ২:৪১-৪৯ পদে লেখা] ঘটনার সময় থেকে যীশুর বাপ্তিস্ম পর্যন্ত অর্থাৎ আমাদের প্রভুর আঠারো বছরের জীবনে তিনি পরিবারের দায়-দায়িত্ব পালন করেছিলেন।” মরিয়ম জানতেন যে স্বামী হারানোর দুঃখ কতখানি আর যীশু ও তাঁর ভাইবোনেরা বাবা হারানোর কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন।
১৩. যীশু যখন তাঁর প্রচার কাজ শুরু করেছিলেন তখন তাঁর কেন এমন গভীর জ্ঞান, বুদ্ধি এবং অনুভূতি ছিল যা আর কারোর ছিল না?
১৩ তাই এটা খুবই স্পষ্ট যে যীশুর জীবন খুব সহজ ছিল না। বরং সাধারণ মানুষের জীবনে যে দুঃখকষ্টগুলো আসে তা তিনি ভোগ করেছিলেন। তারপর, সা.কা. ২৯ সাল থেকে তিনি সেই দায়িত্বগুলো পালন করতে শুরু করেছিলেন যা ঈশ্বর তাঁকে দিয়েছিলেন। ওই বছরের শরৎকালে তিনি জলে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন এবং তাঁকে ঈশ্বরের আত্মিক পুত্র হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়েছিল। যীশুর বাপ্তিস্মের পর ‘স্বর্গ খুলিয়া গিয়াছিল’ যার মানে ছিল যে মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসার আগে স্বর্গে তিনি যেভাবে জীবনযাপন করতেন তার সবকিছু তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল আর সেইসঙ্গে তাঁর আগেকার চিন্তাধারা ও অনুভূতিও তাঁর মনে এসেছিল। (লূক ৩:২১, ২২) তাই যীশু যখন তাঁর প্রচার কাজ শুরু করেছিলেন তখন তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। পৃথিবীতে আর কারোর এমন গভীর জ্ঞান, বুদ্ধি এবং অনুভূতি ছিল না যা তাঁর ছিল। এইজন্যই সুসমাচার লেখকেরা যীশুর প্রচার কাজের কথাই লিখেছিলেন। কিন্তু তবুও তারা যীশুর সমস্ত কথা ও কাজের বিষয়ে লিখতে পারেননি। (যোহন ২১:২৫) কিন্তু ঈশ্বর তাদের দিয়ে যা কিছুই লিখিয়েছেন সেগুলো আমাদেরকে সর্বমহান পুরুষ যিনি এই পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন তাঁর মনের এক ঝলক বা আভাস দেয়।
যীশু কেমন ব্যক্তি ছিলেন
১৪. সুসমাচারের বইগুলো থেকে কীভাবে জানা যায় যে যীশু একজন কোমল ও দরদি ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর গভীর অনুভূতি ছিল?
১৪ সুসমাচারের বইগুলো থেকে যীশুর যে ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে তা দেখায় যে তিনি একজন কোমল ও দরদি ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর গভীর অনুভূতি ছিল। তিনি অনেক বার আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেছিলেন: যখন তিনি কোন কুষ্ঠ রোগীকে দেখেছিলেন তিনি করুণাবিষ্ট হয়েছিলেন (মার্ক ১:৪০, ৪১); যে লোকেরা তাঁর কথা শোনেনি তাদের জন্য তিনি দুঃখ করেছিলেন (লূক ১৯:৪১, ৪২); লোভী পোদ্দারদের প্রতি তিনি ন্যায্য রাগ দেখিয়েছিলেন। (যোহন ২:১৩-১৭) সহানুভূতি দেখিয়ে যীশু চোখের জল ফেলেছিলেন আর তিনি তাঁর আবেগকে লুকিয়েও রাখেননি। তাঁর প্রিয় বন্ধু লাসার যখন মারা যান তখন লাসারের বোন মরিয়মের কান্না তাঁকে এতটাই ব্যথা দিয়েছিল যে তিনি নিজেও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি, সবার সামনে তিনি কেঁদেছিলেন।—যোহন ১১:৩২-৩৬.
১৫. অন্যদেরকে যীশু যেভাবে দেখতেন ও তাদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করতেন তার থেকে কীভাবে যীশুর কোমল অনুভূতি দেখতে পাওয়া যেত?
১৫ অন্যদেরকে যীশু যেভাবে দেখতেন ও তাদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করতেন তাতেই যীশুর কোমল অনুভূতি দেখতে পাওয়া যেত। তিনি গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার জন্য অনেক কিছু করেছিলেন ও তাদেরকে ‘আপন আপন প্রাণের জন্য বিশ্রাম’ দিয়েছিলেন। (মথি ১১:৪, ৫, ২৮-৩০) কখনও এমন হয়নি যে কোন পীড়িত লোকের জন্য তাঁর সময়ের অভাব হয়েছে তা সে রক্তস্রাবগ্রস্ত স্ত্রীলোকই হোক যে তাঁর বস্ত্র ছুঁয়েছিল বা সেই অন্ধ ভিখারিই হোক যে কোনমতেই চুপ করতে চায়নি। (মথি ৯:২০-২২; মার্ক ১০:৪৬-৫২) যীশু অন্যদের ভাল গুণগুলো দেখেছিলেন এবং তাদের প্রশংসা করেছিলেন; তবে দরকারে তিনি শাসন করতেও পিছপা হননি। (মথি ১৬:২৩; যোহন ১:৪৭; ৮:৪৪) সেই সময়ে স্ত্রীলোকেদের খুব বেশি মর্যাদা দেওয়া হতো না কিন্তু যীশু তাদেরকে মর্যাদা দিয়েছিলেন ও তাদের সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করেছিলেন। (যোহন ৪:৯, ২৭) আর সেই জন্য কিছু স্ত্রীলোকেরা তাদের সম্পদ দিয়ে তাঁর সেবা করেছিলেন।—লূক ৮:৩.
১৬. কী দেখায় যে জীবন ও বস্তুগত বিষয়কে যীশু সঠিকভাবে দেখেছিলেন?
১৬ জীবনকে যীশু সঠিকভাবে দেখতেন। ধনসম্পদ তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল না। আমরা জানি যে বস্তুগত জিনিস তাঁর কাছে খুব অল্পই ছিল কারণ তিনি বলেছিলেন যে তাঁর “মস্তক রাখিবার স্থান নাই।” (মথি ৮:২০) কিন্তু তিনি অন্যদের খুশি করার জন্য অনেক কিছু করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে তিনি এক বিবাহভোজে গিয়েছিলেন যেখানে স্বাভাবিকভাবেই গানবাজনা ও আনন্দ করা হতো আর তিনি সেখানে ওই আনন্দকে মাটি করার জন্য যাননি। যীশু সেখানে তাঁর প্রথম আশ্চর্য কাজ করেছিলেন। দ্রাক্ষারস যখন ফুরিয়ে গিয়েছিল তখন তিনি জলকে উত্তম দ্রাক্ষারসে পরিণত করেছিলেন, যে পানীয় “মর্ত্ত্যের চিত্তানন্দ-জনক” ছিল। (গীতসংহিতা ১০৪:১৫; যোহন ২:১-১১) ফলে সেই বিবাহভোজ বন্ধ হয়ে যায়নি এবং বর-কনেকেও কোনরকম লজ্জায় পড়তে হয়নি। জীবনকে যে তিনি সঠিকভাবে দেখতেন তা তাঁর প্রচার কাজের সময়ে ঘটা আরও অনেক ঘটনা থেকে দেখা যায়, যে সময়ে তিনি যিহোবার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন।—যোহন ৪:৩৪.
১৭. যীশু একজন মহান শিক্ষক ছিলেন তাতে কেন অবাক হওয়ার কিছুই নেই আর তিনি কীভাবে শিক্ষা দিতেন?
১৭ যীশু ছিলেন মহান শিক্ষক। রোজকার জীবনের ঘটনাগুলোকে নিয়ে তিনি লোকেদের শেখাতেন, যে বিষয়গুলো সকলে খুব ভাল করে জানত। (মথি ১৩:৩৩; লূক ১৫:৮) তিনি যেভাবে শিখিয়েছিলেন তা ছিল অসাধারণ—খুবই স্পষ্ট, একেবারে সহজ আর বাস্তব। কিন্তু তিনি যা শিখিয়েছিলেন তা ছিল এর চেয়েও বড় বিষয়। তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর শ্রোতারা যিহোবার চিন্তা, অনুভূতি ও পথকে জানুক।—যোহন ১৭:৬-৮.
১৮, ১৯. (ক) যীশু তাঁর পিতাকে কীভাবে প্রকাশ করেছিলেন? (খ) পরের প্রবন্ধে কোন্ বিষয়ে আলোচনা করা হবে?
১৮ প্রায়ই দৃষ্টান্ত দিয়ে যীশু তাঁর পিতাকে এত ভালভাবে প্রকাশ করেছিলেন যা ভোলার নয়। ঈশ্বর করুণাময় বলতে গিয়ে তিনি করুণা দেখান তা বলা এক বিষয় আর তাঁকে একজন ক্ষমাবান পিতার সঙ্গে তুলনা করা আরেক বিষয়, যিনি তার ছেলের ফিরে আসায় এতই খুশি হন যে ‘দৌড়িয়া গিয়া তাহার গলা ধরিয়া তাহাকে চুম্বন করিতে থাকেন।’ (লূক ১৫:) তখনকার অন্ধ ধর্মীয় নেতারা যারা সাধারণ লোকেদের নিচু চোখে দেখত, তাদের ভুল দেখিয়ে দিয়ে যীশু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর পিতা যিহোবা এমন একজন ঈশ্বর যাঁর কাছে সহজেই যাওয়া যায়, যিনি অহংকারী ফরিশীদের লোক দেখানো প্রার্থনা নয় কিন্তু নম্র করগ্রাহীদের প্রার্থনা শোনেন। ( ১১-২৪লূক ১৮:৯-১৪) যীশু বলেছিলেন যে তিনি এমন একজন ঈশ্বর যিনি মানুষের কথা চিন্তা করেন, যিনি একটা ছোট্ট চড়ুই পাখির বিষয়েও খেয়াল রাখেন। তাই যীশু তাঁর শিষ্যদের সাহস জুগিয়ে বলেছিলেন, “ভয় করিও না, তোমরা অনেক চড়াই পাখী হইতে শ্রেষ্ঠ।” (মথি ১০:২৯, ৩১) তাই খুব সহজেই বোঝা যায় যে কেন লোকেরা যীশু যেভাবে ‘উপদেশ’ দিতেন তা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেত আর তাঁর কাছে আসত। (মথি ৭:২৮, ২৯) আর এমনকি একবার ‘অনেক লোকেরা’ না খেয়েই যীশুর সঙ্গে তিন দিন পর্যন্ত ছিলেন!—মার্ক ৮:১, ২.
১৯ যিহোবা তাঁর বাক্যে আমাদেরকে খ্রীষ্টের মন কী তা জানিয়েছেন আর তাই আমরা কতই না কৃতজ্ঞ, আমরা তাঁকে কতই না ধন্যবাদ জানাতে চাই! কিন্তু, কীভাবে আমরা খ্রীষ্টের মন জানতে পারি আর অন্যদের সঙ্গে ব্যবহারে তা দেখাতে পারি? এই বিষয়টাই পরের প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
[পাদটীকাগুলো]
^ প্রকাশিত বাক্য ১২:৩, ৪ পদ পড়লে বোঝা যায় যে স্বর্গদূতেদের ওপরও তাদের সঙ্গীরা ছাপ ফেলেন। এই পদে শয়তানকে ‘প্রকাণ্ড নাগ’ বলা হয়েছে আর সে অন্যান্য “নক্ষত্র” অর্থাৎ স্বর্গদূতদের ওপর এতখানিই ছাপ ফেলতে পেরেছিল যে তারাও তার সঙ্গে মিলে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।—ইয়োব ৩৮:৭ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।
^ যোষেফের কথা শেষবারের মতো সেই ঘটনায় পাওয়া যায় যখন ১২ বছরের যীশু মন্দিরে ধর্মগুরুদের সঙ্গে ছিলেন। যীশু কান্না নগরে তাঁর প্রচার কাজ শুরু করেছিলেন। সেই সময় তিনি এক বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন আর সেখানেও যোষেফ ছিলেন বলে কিছু বলা নেই। (যোহন ২:১-৩) সা.কা. ৩৩ সালে যখন যীশুকে যাতনাদণ্ডে দেওয়া হয়েছিল তখনও তিনি মরিয়মের দেখাশোনা করার ভার তাঁর প্রিয় প্রেরিত যোহনের ওপর দিয়েছিলেন। যোষেফ যদি তখন জীবিত থাকতেন, তাহলে যীশুর তা করা দরকার হতো না।—যোহন ১৯:২৬, ২৭.
আপনার কি মনে আছে?
• “খ্রীষ্টের মন” ভালভাবে জানা কেন জরুরি?
• পৃথিবীতে মানুষ হয়ে আসার আগে যীশু কাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন?
• পৃথিবীতে যীশু সরাসরি কোন্ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন?
• যীশুর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে সুসমাচারের বইগুলো কী বলে?
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু এক বড় পরিবারে মানুষ হয়েছিলেন আর তাদের অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না
[১২ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
বারো বছর বয়সী যীশুর জ্ঞান ও উত্তর শুনে ধর্মগুরুরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন