সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমি সাদাসিধে জীবন কাটিয়েছি

যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমি সাদাসিধে জীবন কাটিয়েছি

জীবন কাহিনী

যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমি সাদাসিধে জীবন কাটিয়েছি

ক্লারা গারবার মোয়ের দ্বারা কথিত

এখন আমার বয়স ৯২ বছর আর তাই হাঁটাচলা করতে আমার কষ্ট হয়, তবে আমার স্মরণশক্তি খুব ভাল। সেই ছেলেবেলা থেকে যিহোবাকে সেবা করার সুযোগ পেয়ে আমি তাঁর কাছে কতই না কৃতজ্ঞ! আমি খুবই সাদাসিধে জীবন কাটিয়েছি আর সেইজন্য যিহোবাকে সেবা করার এই বিশেষ সুযোগ আমি পেয়েছি।

 উনিশশো সাত সালের ১৮ই আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে ওহাইওর আ্যলিয়েন্সে আমার জন্ম হয় আর পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার বড়। আমার বয়স যখন আট বছর তখন একজন পূর্ণ-সময়ের বাইবেল ছাত্র সাইকেলে করে আমাদের খামারে আসেন। যিহোবার সাক্ষিদের তখন বাইবেল ছাত্র বলা হতো। আমার মা, লোরা গারবারের সঙ্গে দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলেন আর তাকে জিজ্ঞেস করেন যে সে কি জানে যে কেন দুষ্টতাকে এভাবে চলতে দেওয়া হচ্ছে। মাও অনেক দিন ধরে এই বিষয়টা নিয়েই ভাবছিল।

বাবা তখন গোলাঘরে কাজ করছিল, তাকে জিজ্ঞেস করে মা শাস্ত্র অধ্যয়ন (ইংরেজি) বইয়ের ছটা খণ্ড নিয়ে আসতে বলেছিল। মা বইগুলো পড়তে খুবই পছন্দ করত এবং বাইবেলের যে সত্য এতে বলা হয়েছিল তা মার ওপর খুব গভীর ছাপ ফেলেছিল। নতুন সৃষ্টি (ইংরেজি) নামের ষষ্ঠ খণ্ডটা মন দিয়ে পড়ে খ্রীষ্টানদের জন্য জলে ডুব দিয়ে বাপ্তিস্ম নেওয়া যে কতটা জরুরি তা মা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছিল। তাই যে কোনভাবেই বাইবেল ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল কিন্তু কোথায় তাদের পাওয়া যাবে তা না জানায়, মা বাবাকেই ১৯১৬ সালের মার্চ মাসের ওই ঠাণ্ডার মধ্যে খামারের ছোট্ট পুকুরেই তাকে বাপ্তিস্ম দিতে বলেছিল।

এর কিছুদিন পরই মা খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখতে পায় যেখানে বলা হয়েছিল যে আ্যলিয়েন্সে ডটারস্‌ অফ ভিটারান্স হলে একটা বক্তৃতা হবে। সেই বক্তৃতার শিরোনাম ছিল “বিভিন্ন যুগের জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা।” যেহেতু শাস্ত্র অধ্যয়ন বইয়ের প্রথম খণ্ড ও ওই বক্তৃতার শিরোনাম একই ছিল, তাই মা সেখানে যাবে বলে তখনই ঠিক করেছিল। একটা গাড়িকে ঘোড়ার সঙ্গে আটকে সেই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে আমরা পরিবারের সবাই মিলে প্রথমবারের মতো সভায় গিয়েছিলাম। এরপর থেকে আমরা প্রতি রবিবার ও বুধবারে ভাইদের বাড়িতে বাড়িতে যে সভা হতো সেখানে যেতাম। এর কিছুদিন পর মা আবারও খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর একজন প্রতিনিধির কাছে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। বাবা সবসময় তার খেতখামার নিয়ে ব্যস্ত থাকত কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে-ও বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিল এবং কয়েক বছর পর বাপ্তিস্ম নিয়েছিল।

যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের দেখা পাওয়া

১৯১৭ সালের ১০ই জুন, তখনকার প্রেসিডেন্ট ভাই জে. এফ. রাদারফোর্ড “জাতিগুলো কেন যুদ্ধ করে?” বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিতে আ্যলিয়েন্সে এসেছিলেন। আমার বয়স তখন নয় বছর ছিল আর বাবামা আমাকে ও আমার দুই ভাই উইলি ও চার্লস্‌কে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। একশ জনেরও বেশি লোক সেখানে এসেছিল। ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতার পর, সেখানে আসা প্রায় সবাই কলম্বিয়া থিয়েটারের বাইরে গিয়ে ছবি তুলেছিল। পরের সপ্তাহে ভাই এ. এইচ. ম্যাকমিলান ওই একই জায়গাতে “ঈশ্বরের আসন্ন রাজ্য” এই বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমাদের ছোট্ট শহরে ভাইদের পাওয়া আমাদের জন্য সত্যিই এক বিরাট সুযোগ ছিল আর আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম।

সেই সময়ের মনে রাখার মতো সম্মেলনগুলো

১৯১৮ সালে আ্যলিয়েন্স থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ওহাইওর আ্যটওয়াটারে আমি আমার প্রথম সম্মেলনে গিয়েছিলাম। মা সোসাইটির প্রতিনিধিকে আমার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমার বাপ্তিস্ম নেওয়ার মতো বয়স হয়েছিল কিনা। আমি মনে মনে স্থির করেছিলাম যে আমি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করব আর আমি নিজেকে তাঁর কাছে উৎসর্গ করেছিলাম, তাই আমাকে সেদিনই একটা বড় আপেল বাগানের কাছে এক পুকুরে বাপ্তিস্ম দেওয়া হয়েছিল। ভাইয়েরা কাপড় পালটানোর জন্য একটা তাঁবু খাটিয়েছিলেন আর আমি সেখানে কাপড় বদলে একটা মোটা নাইটগাউন পরে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার বাবামা ও আমি ট্রেনে চেপে ওহাইওর স্যান্ডাস্কিতে গিয়েছিলাম যেটা ছিল এরি হ্রদের কাছে। সেখানে আমরা ফেরি পার হয়ে সিডার পয়েন্টে গিয়েছিলাম, যেখানে সেই বিশেষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। নৌকা থেকে নেমেই জাহাজঘাটে আমরা একটা ছোট খাবারের দোকান দেখি। আমি সেখান থেকে একটা হেমবার্গার কিনেছিলাম, যা আমার জন্য সত্যিই একটা বড় বিষয় ছিল কারণ সেই সময় আমরা খুব কমই এমন দামি খাবার কিনতে পারতাম। এটা খেতে খুবই সুস্বাদু ছিল! আট দিনের সম্মেলনের সর্বোচ্চ উপস্থিতি ছিল ৭,০০০ জন। যেহেতু সেখানে কোন সাউন্ড সিস্টেম ছিল না তাই আমাকে খুবই মন দিয়ে শুনতে হয়েছিল।

এই সম্মেলনে প্রহরীদুর্গের সাথি পত্রিকা সুবর্ণ যুগ (এখন সচেতন থাক!) প্রথম বের হয়েছিল। যে সময়ে সম্মেলন হয়েছিল সেই সপ্তাহেই আমার স্কুল শুরু হওয়ার কথা ছিল। তাই সম্মেলনে যাওয়ায় আমার পুরো সপ্তা স্কুল কামাই হয়েছিল। কিন্তু আমার তাতে কোন দুঃখ ছিল না কারণ আমি সম্মেলন থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। সিডার পয়েন্ট ছুটি কাটানোর জায়গা আর তাই সম্মেলনে আসা লোকেদের রান্নাবান্না করার জন্য সেখানকার রেস্টুরেন্টের বাবুর্চিদের রাখা হতো কিন্তু সেই সময়ে এই বাবুর্চি ও বেয়ারারা কোন কারণে ধর্মঘট ডেকেছিলেন, তাই যে ভাইরা রান্না করতে জানতেন তারা সম্মেলনে আসা লোকেদের জন্য খাবার তৈরি করেছিলেন। এর পর থেকে অনেক বছর ধরে যিহোবার লোকেরা অধিবেশনে ও সম্মেলনে নিজেদের খাবার নিজেরাই তৈরি করতেন।

আমাদের আবারও ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিডার পয়েন্ট যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, এবারে নয়দিনের সম্মেলনের জন্য আর সেখানে প্রায় ১৮,০০০ জনেরও বেশি লোক এসেছিল। এই সম্মেলনেই ভাই রাদারফোর্ড আমাদেরকে উৎসাহ দিয়েছিলেন যে “রাজা ও তাঁর রাজ্যের বিষয় ঘোষণা কর, ঘোষণা কর, ঘোষণা কর।” কিন্তু আমি বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই লোকেদেরকে ট্র্যাক্ট ও সুবর্ণ যুগ দিয়ে তা ঘোষণা করতে শুরু করে দিয়েছিলাম।

প্রচারের জন্য উপলব্ধিবোধ

১৯১৮ সালের প্রথম দিকে, আমি আশেপাশের খামারগুলোতে বাবিলনের পতন (ইংরেজি) ট্র্যাক্টটা দিয়েছিলাম। ঠাণ্ডার সময় হওয়ায় আমরা ঘরে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাতাম আর একটা সোপস্টোনকে গরম করে আমাদের গাড়িতে নিতাম, যাতে আমাদের পা গরম থাকে। আমরা মোটা কোট ও টুপি পরতাম কারণ আমাদের গাড়িতে শুধু ওপরে একটা ছাউনি ছিল আর দুপাশে পর্দা ছিল, কোন হিটার ছিল না। তবে সেই দিনগুলো খুবই আনন্দের দিন ছিল।

১৯২০ সালে রহস্য সমাপ্ত (ইংরেজি) এর বিশেষ সংস্করণ পত্রিকা আকারে বের হয়েছিল, যেটাকে তখন জেডজি বলা হতো। * আমার বাবামা ও আমি সেই পত্রিকা নিয়ে আ্যলিয়েন্সে ঘরে ঘরে প্রচারে যাওয়ার জন্য বের হতাম। তখন সবাই একা একা প্রচার করত, তাই একদিন আমি এমন একটা ঘরে গিয়েছিলাম যেখানে একটা বারান্দায় বেশ কয়েকজন লোক বসেছিলেন। আমার খুব ভয় ভয় করছিল কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলার পর একজন মহিলা বলেছিলেন: “ও কত সুন্দর করে ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল, তাই না” আর তিনি পত্রিকাও নিয়েছিলেন। ওইদিন আমি ১৩টা জেডজি অর্পণ করেছিলাম আর ওইদিনই প্রথম আমি ঘরে ঘরে অনেক সময় ধরে কথা বলেছিলাম।

আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন মার নিউমোনিয়া হয় আর এক মাসেরও বেশি সময় সে বিছানায় থাকে। আমার সবচেয়ে ছোট বোন হেজেল তখন একেবারে ছোট ছিল, তাই আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় আর আমাকে খামারের কাজ ও ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করতে হতো। এত কিছুর পরও আমাদের পরিবার বাইবেলের সত্যকে জীবনে সবচেয়ে প্রথমে স্থান দিয়েছিল আর আমরা কখনও সভায় যাওয়া বাদ দিইনি।

১৯২৮ সালে খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক সভায় যারা এসেছিলেন তাদের সবাইকে “সেই নয়জন কোথায়?” নামের একটা ট্র্যাক্ট দেওয়া হয়েছিল। এতে লূক ১৭:১১-১৯ পদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল, যেখানে বলা আছে যে দশজন কুষ্ঠরোগী যাদের যীশু অলৌকিকভাবে সুস্থ করেছিলেন তাদের মধ্যে শুধু একজন নম্রভাবে যীশুকে ধন্যবাদ জানাতে ফিরে এসেছিলেন। এটা আমার মনে খুব লেগেছিল। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম যে ‘যিহোবা আর যীশু আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি কি সত্যিই কৃতজ্ঞ?’

এরপর আমাদের ঘরের অবস্থা বেশ বদলে গিয়েছিল আর সেই সময় আমার স্বাস্থ্যও ভাল ছিল, আমার ঘাড়ে তেমন কোন দায়-দায়িত্বও ছিল না, তাই আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি ঘর থেকে দূরে কোথাও গিয়ে অগ্রগামী বা পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ শুরু করব। আমার বাবামা আমাকে তা করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিল। তাই আমার সঙ্গী এগ্নেস আ্যলেটা আর আমি আমাদের কার্যভার পেয়ে ১৯২৮ সালের ২৮শে আগস্ট রাত নয়টায় ট্রেনে উঠে বসি। বাইবেল আর বইপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের দুজনের কাছে মাত্র একটা সুটকেস আর একটা ছোট ব্যাগ ছিল। স্টেশনে আমার বোনেরা ও বাবামা কাঁদছিল আর আমরাও চোখের জল আটকাতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম যে আমি হয়তো আর কখনও তাদেরকে দেখতে পাব না কারণ আমরা মনে করতাম যে হর্‌মাগিদোন খুবই কাছে। পরদিন সকালে আমরা আমাদের কাজের জায়গা ক্যানটাকির ব্রুকস্‌ভিলে গিয়ে পৌঁছাই।

আমরা এক বোর্ডিংহাউজে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম আর কয়েক টিন স্প্যাগেটি কিনে এনেছিলাম ও আমাদের জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়েছিলাম। রোজ আমরা দুজনে আলাদা আলাদা জায়গায় চলে যেতাম, একা একা প্রচার করতাম ও লোকেদের কাছ থেকে ১.৯৮ মার্কিন ডলার চাঁদা নিয়ে পাঁচটা বাঁধানো বই দিতাম। ধীরে ধীরে আমরা পুরো শহরে প্রচার শেষ করে ফেলেছিলাম আর এমন অনেক লোকেদের পেয়েছিলাম যারা বাইবেলের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।

প্রায় তিন মাসের মধ্যেই আমরা ব্রুকস্‌ভিল আর সেইসঙ্গে অগাস্টা শহরের সব জায়গাতে প্রচার করে ফেলি। তাই আমরা মেসভিল, প্যারিস ও রিচ্‌মন্ড শহরে প্রচার করার জন্য চলে যাই। পরের তিন বছরে আমরা ক্যানটাকির অনেক জায়গায় প্রচার করি যেখানে একটাও মণ্ডলী ছিল না। প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ও প্রচার কাজে সাহায্য করার জন্য ওহাইও থেকে আমাদের বন্ধুরা ও পরিবারের সদস্যরা আমাদের কাছে আসত। তারা গাড়ি চালিয়ে আমাদের এখানে এসে এক সপ্তা বা তারও বেশি সময় থেকে আমাদের সঙ্গে প্রচার করত।

মনে রাখার মতো অন্য সম্মেলনগুলো

১৯৩১ সালের ২৪-৩০শে জুলাই ওহাইওর কলম্বাসের সম্মেলনটা সত্যিই মনে রাখার মতো এক সম্মেলন ছিল। সেখানেই ঘোষণা করা হয়েছিল যে এখন থেকে আমাদেরকে যিহোবার সাক্ষি বলে ডাকা হবে, যে নাম বাইবেল থেকে নেওয়া হয়েছে। (যিশাইয় ৪৩:১২) এর আগে লোকেরা যখন জিজ্ঞেস করত আমরা কোন্‌ ধর্মের, তখন আমরা বলতাম, “আন্তর্জাতিক বাইবেল ছাত্র।” কিন্তু তা আমাদেরকে অন্যদের চেয়ে খুব একটা আলাদা করত না কারণ তখন অনেক ধর্মীয় দলগুলোই বাইবেল নিয়ে ঘাটাঘাটি করত।

পরে আমার সঙ্গী এগ্নেসের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমি একা হয়ে পড়ি; তাই যখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে যারা অগ্রগামীর কাজ করার জন্য সঙ্গী খুঁজছেন তারা যেন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হন, তা শুনে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম। সেখানে আমি বার্থা, এলসি গার্টি এবং বেসি এন্সমিংগারের দেখা পাই। তাদের দুটো গাড়ি ছিল আর তারা তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য আরেকজন অগ্রগামীকে খুঁজছিলেন। সেই সম্মেলন থেকেই আমরা সবাই একসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম, যদিও এর আগে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না।

গরমের সময় আমরা পুরো পেনসিলভানিয়ায় কাজ করতাম। তারপর যখন ঠাণ্ডা পড়ত তখন আমরা উত্তর ক্যারোলিনা, ভার্জিনিয়া ও ম্যারিল্যান্ডের দক্ষিণে কাজ করার জন্য সোসাইটির কাছে অনুরোধ করতাম, যে অঞ্চলগুলো কিছুটা গরম ছিল। বসন্তের সময় আমরা আবার উত্তরাঞ্চলে ফিরে আসতাম। তখনকার অগ্রগামী ভাইবোনেরা সাধারণত এরকমই করত। ১৯৩৪ সালে, জন বুথ ও রাডল্ফ আ্যবুলও এইরকম করতেন আর তারা রাল্ফ মোয়ের ও তার ছোট ভাই উইলার্ডকে তাদের সঙ্গে কেনটাকির হ্যাজার্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন।

রাল্ফের সঙ্গে এর আগে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিল আর আমরা ১৯৩৫ সালের ৩০শে মে থেকে ৩রা জুন পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসিতে যে সম্মেলন হয়েছিল সেখানে গিয়ে একে অন্যকে আরও ভালভাবে চিনি। রাল্ফ ও আমি বারান্দায় বসেছিলাম যখন “বিস্তর লোক” অথবা “বিরাট জনতা” বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছিল। (প্রকাশিত বাক্য ৭:৯-১৪) এর আগে পর্যন্ত আমরা মনে করতাম যে বিস্তর লোকের সদস্যরাও স্বর্গে যাবে, তবে তারা ১,৪৪,০০০ জনের চেয়ে কম বিশ্বস্ত। (প্রকাশিত বাক্য ১৪:১-৩) তাই আমি বিস্তর লোক হতে চাইনি!

ভাই রাদারফোর্ড যখন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে বিস্তর লোকেরা সেই বিশ্বস্ত লোকেদের দল যারা হর্‌মাগিদোন থেকে রক্ষা পেয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে, তখন অনেকে খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি বিস্তর লোকের সদস্যদের উঠে দাঁড়াতে বলেছিলেন। রাল্ফ উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু আমি বসেই ছিলাম। পরে, বিষয়গুলো আমার কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যায় আর তাই ১৯৩৫ সালেই আমি শেষ বারের মতো খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক সভায় প্রতীক রুটি ও দ্রাক্ষারস খেয়েছিলাম। কিন্তু মা ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রুটি ও দ্রাক্ষারস খেয়েছিল।

জীবন সঙ্গী

রাল্ফ ও আমি একে অন্যকে চিঠি লিখতাম। আমি নিউ ইয়র্কের লেক প্লাসিডে কাজ করতাম আর সে পেনসিলভানিয়ায়। ১৯৩৬ সালে সে একটা ছোট ট্রেইলার বানায় যেটাকে সে তার গাড়ির সঙ্গে জুড়ে নিতে পারত। সে পেনসিলভানিয়ার পটস্‌টাউন থেকে নিউ জার্সির নিউয়ার্কে ১৬-১৮ই অক্টোবর যে সম্মেলন হয়েছিল সেখানে সেটা নিয়ে আসে। একদিন সম্মেলনের শেষে সন্ধ্যেবেলায় আমরা কয়েকজন অগ্রগামী রাল্ফের নতুন ট্রেইলারটা দেখতে যাই। আমি ও রাল্ফ ট্রেইলারের ভিতরে ছোট বেসিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর হঠাৎই সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার কি ট্রেইলারটা পছন্দ হয়েছে?”

আমাকে হ্যাঁ বলে মাথা নাড়াতে দেখে সে আবার জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি এতে থাকতে চাও?”

আমি “হ্যাঁ” বলতেই সে আমাকে খুব মিষ্টি করে চুমু খেয়েছিল, যা আমি কখনও ভুলব না। কয়েকদিন পর আমরা বিয়ের কাগজপত্র বের করি। অক্টোবরের ১৯ তারিখে, সম্মেলনের পরদিন আমরা ব্রুকলিনে যাই ও ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির ছাপাখানা ঘুরে দেখি। তারপর আমরা কাজ করার জন্য এলাকা চাই। ভাই গ্রান্ট সুইটার সেই সময়ে এই বিভাগের দেখাশোনা করতেন আর তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে কারা এখানে কাজ করবে। রাল্ফ বলেছিল, “আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে আমরা দুজনে।”

ভাই সুইটার বলেছিলেন, “আপনারা যদি বিকেল পাঁচটার সময় আসতে পারেন, তাহলে আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারি।” তাই ওই দিন বিকেলে আমরা ব্রুকলিন হাইটসে একজন ভাইয়ের বাড়িতে বিয়ে করি। আমরা সেখানকার একটা রেস্টুরেন্টে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে খাওয়াদাওয়া করি আর তারপর রাল্ফের ট্রেইলারে থাকতে যাওয়ার জন্য গাড়ি চড়ে নিউ জার্সির নিউয়ার্কে রওনা দিই।

সেখান থেকে অল্প কিছুদিন পর, আমরা ভার্জিনিয়ার হেথসভিলের পথে রওনা হই। বিয়ের পর এটাই ছিল আমাদের প্রথম কার্যভার। আমরা প্রথমে নর্দাম্বারল্যান্ড অঞ্চলে ও পরে পেনসিলভানিয়ার ফালটন ও ফ্রাঙ্কলিন অঞ্চলে কাজ করেছিলাম। ১৯৩৯ সালে রাল্ফকে আঞ্চলিক অধ্যক্ষের কাজ করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়, যেখানে আমাদেরকে পালা করে বিভিন্ন মণ্ডলী পরিদর্শন করতে হতো। আমরা তিনেশি অঞ্চলের অনেক মণ্ডলীতে সেবা করেছিলাম। এর পরের বছর আমাদের ছেলে আ্যলেনের জন্ম হয় আর সেইজন্য ১৯৪১ সালে আমাদেরকে আঞ্চলিক কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর আমাদেরকে বিশেষ অগ্রগামী করে ভার্জিনিয়ার ম্যারিওনে পাঠানো হয়েছিল। তখন বিশেষ অগ্রগামীদের মাসে ২০০ ঘন্টা করে প্রচার করতে হতো।

রদবদল করা

১৯৪৩ সালে, আমার মনে হয় যে আমার বিশেষ অগ্রগামীর কাজ ছেড়ে দেওয়া দরকার। ছোট্ট ট্রেইলারে থেকে ছোট বাচ্চাকে দেখাশোনা করা, খাবার বানানো, ঘরদোর পরিষ্কার, কাপড়চোপড় কাচাধোওয়া করে আমি প্রতি মাসে মাত্র ৬০ ঘন্টা প্রচার করতে পারতাম। তাই আমি অগ্রগামীর কাজ করা বন্ধ করে দিই কিন্তু রাল্ফ বিশেষ অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে গিয়েছিল।

১৯৪৫ সালে আমরা ওহাইওর আ্যলিয়েন্সে চলে যাই আর প্রায় নয় বছর ধরে যে ট্রেইলারটা আমাদের ঘর ছিল সেটা বিক্রি করে দিই এবং আমার বাবামার কাছে তাদের খামার বাড়িতে চলে আসি। এখানেই সামনের বারান্দায় আমাদের মেয়ে রেবেকার জন্ম হয়। রাল্ফ শহরে পার্টটাইম চাকরি নেয় আর নিয়মিত অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে যায়। আমি খামারে কাজ করতাম কারণ আমি চাইনি যে রাল্ফ অগ্রগামীর কাজ ছেড়ে দিক আর তাই আমি তাকে আমার সাধ্যমতো সাহায্য করতাম। যদিও আমার বাবামা বিনা পয়সায় আমাদের জমি ও ঘর দিতে চেয়েছিল কিন্তু রাল্ফ তা নিতে রাজি হয়নি। আসলে সে ভারমুক্ত থাকতে চেয়েছিল যাতে আমরা রাজ্যের কাজকে আমাদের জীবনে প্রথমে রাখতে পারি।

১৯৫০ সালে, আমরা আবারও পেনসিলভানিয়ার পটস্‌টাউনে ফিরে যাই ও সেখানে ২৫ মার্কিন ডলারে একটা বাড়ি ভাড়া নিই। পরের ৩০ বছরে সেই ঘরের ভাড়া বেড়ে মাত্র ৭৫ ডলার হয়েছিল। আমরা অনুভব করতাম যে যিহোবা আমাদের জীবনকে সাদাসিধে রাখার জন্য সাহায্য করছিলেন। (মথি ৬:৩১-৩৩) রাল্ফ সপ্তাহে তিনদিন লোকেদের চুল কেটে দিত। প্রতি সপ্তাহে আমরা আমাদের দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতাম, সভায় যেতাম এবং পরিবারের সবাই মিলে রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করতাম। রাল্ফ সেখানকার মণ্ডলীর পরিচালক অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করত। আমাদের জীবনকে সাদাসিধে রেখে আমরা যিহোবার সেবায় অনেক কিছু করতে পেরেছিলাম।

আমার জীবন সঙ্গীকে হারানো

১৯৮১ সালের ১৭ই মে আমরা কিংডম হলে বসে জনসাধারণের বক্তৃতা শুনছিলাম। রাল্ফের শরীর খারাপ লাগছিল তাই সে হলের পিছন দিকে চলে যায় আর পরিচারককে দিয়ে আমাকে এক টুকরো কাগজে লিখে পাঠায় যে সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আমি খুব অবাক হয়ে যাই কারণ রাল্ফ এর আগে কখনও এমন করেনি তাই আমি এক ভাইকে বলেছিলাম, তিনি যেন দয়া করে আমাকে গাড়ি করে তাড়াতাড়ি একটু বাসায় পৌঁছে দেন। এক ঘন্টার মধ্যেই রাল্ফ স্ট্রোকে মারা যায়। সেদিন সকালে প্রহরীদুর্গ অধ্যয়নের পর মণ্ডলীতে ঘোষণা করা হয়েছিল যে রাল্ফ আর নেই।

সেই মাসে রাল্ফ প্রায় ৫০ ঘন্টা প্রচার করেছিল। সে ৪৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা করেছিল। সে একশ জনেরও বেশি লোকের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করেছিল যারা বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলেন। এত বছর ধরে আমরা অনেক ত্যাগস্বীকার করেছি কিন্তু যে সমস্ত আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ আমরা পেয়েছি তার কাছে তা কিছুই নয়।

আমার সুযোগগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ

১৮ বছর ধরে আমি একাই রয়েছি, একাই সভায় যাই, যতটা করতে পারি প্রচার করি এবং ঈশ্বরের বাক্য অধ্যয়ন করি। এখন আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। আমার কাছে অল্প কিছু আসবাবপত্র আছে আর ইচ্ছে করেই আমি টেলিভিশন কিনিনি। তবে আমার জীবনে কোন অভাব নেই এবং আমি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ধনী। আমার বাবামা ও আমার দুই ভাই তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল আর আমার দুই বোন বিশ্বস্তভাবে সত্যের পথে চলছে।

আমি খুবই খুশি যে আমার ছেলে আ্যলেন খ্রীষ্টান প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে। অনেক বছর সে কিংডম হল ও অধিবেশন হলের সাউন্ড সিস্টেম দেখাশোনার কাজ করেছে এবং গরমের সময়ের সম্মেলনগুলোর সাউন্ড সিস্টেমও দেখাশোনা করেছে। তার স্ত্রী নিষ্ঠার সঙ্গে যিহোবাকে সেবা করে যাচ্ছে আর তাদের দুই ছেলে প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে। আমার মেয়ে রেবেকা ক্যারেস ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা করেছে, যার মধ্যে চার বছর সে ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয়েও কাজ করেছে। সে ও তার স্বামী ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ কাজ করেছে।

যীশু বলেছিলেন যে রাজ্য হল এক গুপ্ত ধন কিন্তু তা পাওয়া যায়। (মথি ১৩:৪৪) আমি কৃতজ্ঞ যে আমার পরিবার অনেক বছর আগে ওই গুপ্তধন পেয়েছিল। কতই না খুশির কথা যে ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি যিহোবার সেবা করতে পেরেছি আর এর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই! আবার যদি আমি নতুন জীবন পাই, তাহলে আবারও আমি এই জীবনই বেছে নেব কারণ ‘ঈশ্বরের দয়া জীবন হইতেও উত্তম।’—গীতসংহিতা ৬৩:৩.

[পাদটীকাগুলো]

^ রহস্য সমাপ্ত হল শাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন বইয়ের ধারাবাহিক খণ্ডগুলোর সপ্তম খণ্ড। প্রথম ছয়টা খণ্ড চার্লস টেজ রাসেল লিখেছিলেন। রহস্য সমাপ্ত বইটা রাসেলের মৃত্যুর পর ছাপা হয়েছিল।

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯১৭ সালে ওহাইওর আ্যলিয়েন্সে আমরা ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতা শুনেছিলাম

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

রাল্ফ যে ট্রেইলার বানিয়েছিল সেটার সামনে রাল্ফের সঙ্গে

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

আজকে আমি ও আমার দুই ছেলেমেয়ে