সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ঘৃণা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে

ঘৃণা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে

ঘৃণা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে

“লোকেরা যারা একে অন্যকে ঘৃণা করে তারা একজন আরেকজনকে এমনকি জানে পর্যন্ত না।”—জেমস রাসেল লোভেল, প্রবন্ধকার ও কূটনীতিক।

 আজ সারা পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে ঘৃণা করে। ঘৃণার কথা বলতে গেলেই ইন্দোনেশিয়া, কোসোভো, লাইবেরিয়া, লিটিলটন আর সারাজেভোর মত দেশ ও নিও-নাৎসি, স্কিনহেড, হোয়াইট সুপ্রিমেসিষ্ট নামের সম্প্রদায়গুলোর কথা আমাদের মনে আসে যারা জাতপাত ধর্মবর্ণ নিয়ে লোকেদের ঘৃণা করেছে। চোখের সামনে কালো কয়লার মত ঝলসানো হাজার হাজার মৃতদেহগুলো ভেসে ওঠে।

কিন্তু একটা সময় ছিল যখন লোকেরা মনে করতো যে আমাদের সামনে এমন এক সময় আসবে যখন ঘৃণা, যুদ্ধ, অপরাধ আর থাকবে না। কিন্তু তাদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। যেমন ফ্রান্সের প্রয়াত রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ড্যানয়েল মিট্টরেন্ড তার যৌবনের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে বলেন: “সেই দিনগুলোতে আমরা এক নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখতাম আমরা আশা করতাম যে এমন সময় খুব শীঘ্রিই আসবে যখন সবাই একে অন্যের বন্ধু হবে, একে অন্যকে বিশ্বাস করবে; যে পৃথিবীতে সবাই শান্তিতে, আনন্দে, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকবে; যেখানে সবকিছু ভরপুর মাত্রায় থাকবে আর যেখানে কারও কোন বিপদ থাকবে না।” কিন্তু তার এই স্বপ্ন কি সত্যি হয়েছিল? তিনি দুঃখ করে বলেন যে: “আমাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।”

আর তার কারণ হল, মানুষে মানুষে ঘৃণা এত বেশি বেড়ে গিয়েছে যে তা চেপে রাখার আর কোন পথ নেই। দিনের পর দিন এটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে মানুষের মধ্যে ঘৃণা যেন বেড়েই চলেছে। এমন জায়গাতেও যেখানে লোকেরা একসময় ভাবত যে তাদের কোন বিপদ হবে না সেখানেও আজকে ঘৃণার কারণে এমন অপরাধ হয় যে তা আমাদের চিন্তার বাইরে। কিন্তু আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে আমি তো আমার ঘরে বা আমার দেশে নিশ্চিন্তে আছি। কিন্তু সত্যি বিষয়টা হল যে ঘৃণা আজ পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। রোজ আমরা ঘরে বসে টেলিভিশনে এর লক্ষ লক্ষ প্রমাণ পাই। আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে। এখন আসুন আমরা কয়েকটা ঘটনার বিষয় দেখি যা দেখায় যে ঘৃণা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

গত দশ বছরে লোকেদের দেশভক্তি এত বেশি বেড়ে যায় যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই হার্ভাড আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কেন্দ্রের পরিচালক যোসেফ এস. নাই, জুনিয়র বলেন যে, “জাতীয়তাবাদ লোকেদের মনের এত গভীরে ঢুকে পড়েছে যে বলার নয়! কিন্তু তবুও তা লোকেদের এক করতে পারেনি। জাতীয়তাবাদ বরং লোকেদের একে অন্যের থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আর এর কারণ হল যে লোকেরা শুধু নিজের দেশ ও জাতি নিয়েই চিন্তা করে। জাতীয়তাবাদ মানুষকে একে অন্যকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে।”

ঘৃণা যে রাষ্ট্রের মধ্যে বা প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে দেখা যায় তাই-ই নয়। একটা দেশের মধ্যেও ঘৃণা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যেমন কানাডার কথাই ধরা যাক। সেখানে যখন পাঁচ জন সাদা চামড়ার লোক একজন বৃদ্ধ শিখকে খুন করেছিল তখন এই ঘটনা “বলে দিয়েছিল যে কানাডা, যে দেশের জন্য লোকেরা মনে করত যে সেখানে কোনরকম ভেদাভেদ নেই সেই দেশেও এমন ঘটনা ঘটে আর এটা দেখায় যে আজ পৃথিবীতে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে লোকেদের মধ্যে ঘৃণা নেই।” জার্মানিতে একসময় জাতপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব বেশি ঘৃণা ছিল না কিন্তু ১৯৯৭ সালে হঠাৎ-ই তা ২৭ শতাংশ বেড়ে যায়। জার্মানির একজন নেতা ম্যানফ্রেট ক্যানথর বলেন, “এইরকম খবর খুবই দুঃখের।”

এক রিপোর্ট বলে যে উত্তর আলবানিয়ায় লোকেরা তাদের বাচ্চাদের ঘরের বাইরে পাঠাতে ভয় পায়, কারণ তাদের পারিবারিক শত্রুরা তাদের বাচ্চাদের মেরে ফেলবে। সেইজন্য প্রায় ৬০০০রেও বেশি বাচ্চারা বলতে গেলে ঘরে বন্দী হয়ে থাকে। এই পারিবারিক শত্রুতা “হাজার হাজার পরিবারগুলোর জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে।” যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অনুসন্ধান বিভাগের এক রিপোর্ট বলে, “১৯৯৮ সালে ঘৃণার কারণে ৭,৭৫৫টা অপরাধ করা হয়েছে আর এর অর্ধেকেরও বেশি হল জাতপাত নিয়ে লড়াই।” বাকি অপরাধের কিছু হয়েছিল জাতি ও ধর্মের কারণে আর কিছু বিকলাঙ্গদের প্রতি ঘৃণার কারণে।

এছাড়া শরণার্থীদের প্রতিও ঘৃণা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। আজ পৃথিবীতে প্রায় ২১ লক্ষেরও বেশি শরণার্থী আছে। আর দুঃখের বিষয় হল যে এই শরণার্থীদের ওপর অত্যাচার করায় যুবকেরা আগে রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের উসকায়। তারা এই যুবসমাজকে তাদের হাতের পুতুল করে রেখেছে। শরণার্থীদের প্রতি ঘৃণা কখনও কখনও খুব স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও লোকেরা মনে মনে তা পুষে রাখে। লোকেরা মনে করে যে বিদেশিদের ওপর বিশ্বাস করা যায় না। তারা তাদের জাতি, ধর্ম সংস্কৃতিকে নিচু নজরে দেখে আর মনে মনে তাদের বিষয়ে ভুল ধারণা গড়ে নেয়।

মানুষে মানুষে ঘৃণা কেন মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে? আর কীভাবে ঘৃণাকে শেষ করে দেওয়া যেতে পারে? পরের প্রবন্ধে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি পাবেন।

[২ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Cover, top: UN PHOTO ১৮৬৭০৫/J. Isaac

[৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Daud/Sipa Press