যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সবসময় পুরস্কার দেন
জীবন কাহিনী
যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সবসময় পুরস্কার দেন
বলেছেন ভারনন ডানকম্ব
সেদিন রাতের খাবার খেয়ে অভ্যাস মতো আমি একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম। তারপর আমার স্ত্রী ইলিনকে জিজ্ঞেস করি, “আজ মিটিং কেমন হল?”
একটু ভেবে সে বলেছিল: “আজ মিটিংয়ে একটা চিঠি পড়া হয়েছে আর সেই চিঠিতে তোমার নামও ছিল। তোমাকে সাউন্ড সিস্টেম দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠির শেষের কথাগুলো এরকম ছিল: ‘যে ভাইয়েরা এই নতুন দায়িত্বগুলো পেয়েছেন তারা যদি সিগারেট খান, তাহলে তাদেরকে তাড়াতাড়ি সোসাইটিকে লিখে জানিয়ে দিতে হবে যে তারা এই দায়িত্ব নেবেন না।’” * এই কথা শুনে আমি বলি, “তাই নাকি! এই কথা বলেছে।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটটা ভেঙে ছাইদানিতে ফেলে দিই। “আমি বুঝতে পারছি না যে কেন আমাকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে আমি কখনও কোন কাজে না বলিনি আর এবারেও আমি না বলব না।” আমি মনে মনে ঠিক করি যে জীবনে আর কখনও সিগারেট ছুঁয়েও দেখব না। একজন খ্রীষ্টান ও একজন বাদক হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত আমার জীবনের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। কিছু ঘটনা আমাকে সিগারেট ছাড়তে সাহায্য করেছিল, সেই কথাই আমি আপনাদের বলছি।
আমার পরিবার
১৯১৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর কানাডার টরেন্টোতে আমার জন্ম। আমার বাবার নাম ছিল ভারনন এবং মার নাম ছিল লিলা। তারা দুজনেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অনেক পরিশ্রম করত ও আমাদের খুব ভালবাসত। আমরা মোট চার ভাই ও দুবোন ছিলাম আর আমিই ছিলাম সবার বড়। আমার পরেই ছিল ইয়র্ক, তারপর অরল্যানডো, ডগলাস, ইলিন ও কোরাল। আমার বয়স যখন মাত্র নয় বছর তখন মা আমাকে একটা বেহালা কিনে দেয় ও আমাকে হ্যারিস স্কুল অফ মিউজিক-এ ভর্তি করে দেয়। আমাদের খুব বেশি টাকাপয়সা ছিল না কিন্তু তারপরও বাবামা আমার স্কুলের বেতন ও যাওয়া-আসার খরচ জুগিয়েছিল। এরপর টরেন্টোর রয়াল কনসারভেটরি অফ
মিউজিক-এ আমি সংগীতের ওপর আরও পড়ালেখা করি এবং ১২ বছর বয়সে টরেন্টোর একটা বড় সংগীত মিলনায়তন, মেসে হলে গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। সেই প্রতিযোগিতায় আমি বিজয়ী হই এবং খুব সুন্দর একটা বেহালা উপহার পাই। ওই বেহালাটা রাখার জন্য কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা বড় বাক্স ছিল।পরে আমি পিয়ানো এবং বেস ভায়োলিন বাজাতেও শিখি। প্রায়ই আমরা কয়েকজন মিলে শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যায় ছোট ছোট পার্টিতে এবং ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানে যন্ত্রসংগীত বাজাতাম। এইরকম এক নাচের পার্টিতে গিয়েই ইলিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যে বছর আমি হাইস্কুল থেকে পাশ করেছি সেই বছর আমি বেশ কয়েকটা অর্কেস্ট্রা দলের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেছি। গ্র্যাজুয়েশন করার পর আমাকে ফার্দি মৌরি অর্কেস্ট্রায় ডাকা হয় আর সেখানে বেশ ভাল মাইনে ছিল। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত আমি ওই চাকরিই করি।
যিহোবাকে জানা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে বাবামা বাইবেলের সত্য জানতে পায়। বাবা তখন টরেন্টোর এক বাণিজ্যিক এলাকার একটা বড় দোকানে কাজ করত। দুপুরের খাবারের সময় সে অন্য দুজন কর্মচারীর আলোচনা শুনত, যারা বাইবেল ছাত্র (যিহোবার সাক্ষিদের তখন এই নামে ডাকা হতো) ছিলেন। বাবা বিকেলে বাসায় এসে তাদের কথা মাকে বলত। কয়েক বছর পর, ১৯২৭ সালে বাইবেল ছাত্ররা কানাডিয়ান ন্যাশনাল এক্সিবিশন এর ময়দানে একটা বড় সম্মেলন করে। সেই মাঠের পশ্চিম দিকের গেট থেকে আমাদের বাড়ি দুটো ব্লক পরে ছিল। আর সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকার ওহাইও থেকে আসা ২৫ জন আমাদের বাড়িতে থেকেছিল।
এরপর থেকে আ্যডা বেল্টসো নামে একজন বাইবেল ছাত্র মার কাছে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতে থাকেন এবং তাকে নতুন নতুন বইপত্রিকা দিতেন। একদিন তিনি মাকে জিজ্ঞেস করেন: “মিসেস ডানকম্ব, আমি তো বেশ কিছুদিন ধরে আপনাকে বইপত্রিকা দিচ্ছি। আপনি কি কখনও সেগুলো পড়ে দেখেছেন?” ছয় ছেলেমেয়েকে মানুষ করা যদিও চাট্টিখানি কথা ছিল না, তবুও মা সেদিন থেকেই ওই পত্রিকাগুলো পড়বেন বলে ঠিক করেন আর কখনও তিনি সেগুলো পড়া বাদ দেননি। কিন্তু, আমি সেই বইপত্রিকাগুলো ছুঁয়েও দেখতাম না। আমার মাথায় তখন কেবল গ্র্যাজুয়েশনের চিন্তা এবং আমি গানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
১৯৩৫ সালের জুন মাসে আমি ও ইলিন একটা এংলিকান গির্জায় গিয়ে বিয়ে করি। যেহেতু আমি ১৩ বছর বয়সে ইউনাইটেড গির্জা থেকে নাম কাটিয়ে নিয়ে আর কোন গির্জায় যোগ দিইনি, তাই তখন পর্যন্ত একজন যিহোবার সাক্ষি না হলেও আমি বিয়ের রেজিস্টারে ধর্মের জায়গায় নিজেকে একজন যিহোবার সাক্ষি লিখি।
আমরা দুজনেই বাচ্চা নেব বলে ঠিক করেছিলাম এবং আদর্শ বাবামা হতে চেয়েছিলাম। আর এই কারণে আমরা একসঙ্গে বাইবেলের নতুন নিয়ম পড়তে শুরু করি। আমাদের ভাল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, অন্যান্য বিষয়গুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আবারও একসঙ্গে পড়ার চেষ্টা করি কিন্তু একই সমস্যা দেখা দেয়। তারপর ১৯৩৫ সালের বড়দিনের সময় আমরা মায়ের কাছ থেকে বড়দিনের উপহার হিসেবে ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) বইটা পাই। সেটা পেয়ে আমার স্ত্রী বলেছিল: “এই বছর মা আমাদেরকে কী অদ্ভুত উপহার পাঠিয়েছেন।” কিন্তু আমি কাজে চলে যাবার পর সে বইটা পড়তে শুরু করে এবং সেটা পড়তে তার ভাল লাগে। তবে সে যে এই বইটা এত আগ্রহ নিয়ে পড়ত সেই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। আমরা বাবামা হতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাদের সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি। কারণ ১৯৩৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি আমাদের একটা মেয়ে হয় কিন্তু সে মারা যায়। আমাদের মেয়ের মৃত্যুতে আমরা অনেক বড় আঘাত পাই!
এই সময় আমাদের পরিবারের সবাই প্রচার করত এবং আমি শুনতে পাই যে বাবাই ছিল একমাত্র প্রচারক যে কিনা তখনও পর্যন্ত সান্ত্বনা (এখন সচেতন থাক!) পত্রিকার জন্য কোন গ্রাহক পায়নি। ওই মাসের প্রচারের জন্য লক্ষ্য ছিল গ্রাহক সংগ্রহ করা। যদিও আমি তখন পর্যন্ত সোসাইটির একটা বইপত্রিকাও পড়িনি কিন্তু বাবা কোন গ্রাহক পায়নি দেখে আমার খারাপ লাগে। সেইজন্য আমি বাবাকে বলেছিলাম: “বাবা, তুমি আমাকে গ্রাহক করে নাও, তাহলে তুমিও অন্য প্রচারকদের মতো হতে পারবে।” এরই মধ্যে গরম চলে আসে এবং অর্কেস্ট্রা দল শহরের বাইরে ছুটি কাটানোর জায়গাগুলোতে বাজানোর জন্য চলে যায়। সেখানেও ডাকযোগে সান্ত্বনা পত্রিকাগুলো আমার কাছে আসতে থাকে। এরপর শরৎ আসে এবং অর্কেস্ট্রা দল আবার টরেন্টোতে চলে আসে। আমাদের নতুন ঠিকানায়ও পত্রিকাগুলো আসতে থাকে কিন্তু আমি একটিবারের জন্যও সেগুলো খুলে দেখিনি। সেগুলো যেভাবে মোড়ানো ছিল সেভাবেই পড়ে থাকত।
একবার বড়দিনের ছুটিতে আমি দেখি যে অনেকগুলো পত্রিকা জমে গেছে আর তখন আমি মনে মনে বলি যে আমি যেহেতু এগুলো পয়সা দিয়ে কিনেছি, তাই আমার অন্তত এটুকু দেখা উচিত যে এগুলোতে কী আছে। প্রথম পত্রিকাটা খুলে আমি অবাক হয়ে যাই। এখানে রাজনৈতিক চক্রান্ত ও তখনকার দুর্নীতির কথা লেখা আছে। ওই পত্রিকা পড়ে আমি যা কিছু জানতে পারি, তা আমার সঙ্গের বাদকদের জানাতে শুরু করি। কিন্তু, আমি যা বলছিলাম সেগুলো আদৌ সত্যি কিনা সেই বিষয়ে তারা মথি ২৪:৪৫.
সন্দেহ করে আর তাই আমি সবার সামনে নিজের কথাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য সেই পত্রিকাগুলো নিয়মিত পড়তে থাকি। এভাবে নিজের অজান্তেই আমি যিহোবার কথা লোকেদের জানাতে শুরু করি। আর তখন থেকে আজ পর্যন্ত, আমি কখনও ‘বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান্ দাসদের’ তৈরি বাইবেলের বইপত্রিকাগুলো পড়া বন্ধ করিনি।—সপ্তাহের কাজের দিনগুলো যদিও খুব ব্যস্ততার মধ্যেই কাটত, তবুও আমি ইলিনকে নিয়ে রবিবারের মিটিংয়ে যেতে শুরু করি। ১৯৩৮ সালের এক রবিবারে মিটিংয়ে যাওয়ার পর দুজন বয়স্কা বোন আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানান ও তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলেছিলেন: “তুমি কি যিহোবার পক্ষ নিয়েছ? তুমি নিশ্চয়ই জান যে হর্মাগিদোন খুবই কাছে!” আমি জানতাম যে যিহোবাই হলেন একমাত্র সত্য ঈশ্বর আর নিশ্চিত হয়েছিলাম যে এটাই তাঁর সংগঠন। আমি এই সংগঠনের একজন হতে চেয়েছিলাম আর তাই ১৯৩৮ সালের ১৫ই অক্টোবর আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। তার ছমাস পর ইলিন বাপ্তিস্ম নেয়। আমি খুবই খুশি যে আমার পরিবারের সবাই বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার উপাসক হয়েছে।
ঈশ্বরের লোকেদের সঙ্গে ওঠাবসা করে আমি কত খুশিই না হয়েছিলাম! তাদের মাঝে থাকতে আমি খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। কোন কারণে মিটিংয়ে যেতে না পারলেও আমি সবসময় মিটিংয়ে কী হয়েছে, তা জানার চেষ্টা করতাম। শুরুতেই আমি যে রাতের কথা বলেছি, সেই রাতটাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এক বড় পরিবর্তন
১৯৪৩ সালের ১লা মে আমাদের জীবনে আরেকটা বড় পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা প্রথমবারের মতো ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে ঈশতান্ত্রিক নতুন জগৎ সম্মেলনে যোগ দিই। বিশ্বযুদ্ধের ওই ভয়ংকর সময়ে, যে যুদ্ধ কখনও শেষ হবে না বলেই মনে হয়েছিল, ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির তখনকার প্রেসিডেন্ট ভাই নর একটা আগ্রহজনক বক্তৃতা দিয়েছিলেন যেটার বিষয়বস্তু ছিল, “শান্তি—কি চিরস্থায়ী হতে পারে?” আজও আমাদের স্পষ্ট মনে আছে যে তিনি প্রকাশিত বাক্যের ১৭ অধ্যায় থেকে দেখিয়েছিলেন যে যুদ্ধের পর শান্তি আসবে আর তখন অনেক বড় প্রচার কাজ হবে।
তবে ভাই নর আগে যে বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন সেটা আমাদের মনে আরও বেশি ছাপ ফেলে যেটার বিষয়বস্তু ছিল, “যিপ্তহ ও তার মানত।” ওই বক্তৃতায় ভাই নর আরও বেশি ভাইবোনদের অগ্রগামীর কাজ করার জন্য অনুরোধ করেন। ইলিন ও আমি দুজন দুজনের দিকে তাকাই ও (আরও অনেকের সঙ্গে) একসঙ্গে বলি: “আমরা করব!” সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরিকল্পনা করতে শুরু করি যে এই জরুরি কাজটা কীভাবে করা যায়।
কানাডাতে ১৯৪০ সালের ৪ঠা জুলাই যিহোবার সাক্ষিদের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১৯৪৩ সালের ১লা মে থেকে আমরা অগ্রগামীর কাজ শুরু করি কিন্তু তখনও যিহোবার বিষয়ে প্রচার করা ও সোসাইটির বইপত্রিকা লোকেদের দেওয়া বেআইনি ছিল। খ্রীষ্টান হিসেবে আমরা শুধু কিং জেমস সংস্করণটা সঙ্গে করে নিতে পারতাম। মাত্র কয়েকদিন পরই আমরা প্রচার করার জন্য ওন্টারিওর প্যারি সাউন্ডে গিয়ে পৌঁছি আর সেখানে গিয়ে স্টুয়ার্ট ম্যান্ নামে একজন অভিজ্ঞ অগ্রগামীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। কানাডার শাখা অফিস এই ভাইকে আমাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছিল। নতুন ভাইবোনদের জন্য সোসাইটির কী এক প্রেমময় ব্যবস্থা! ভাই ম্যানের মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত আর তার ব্যবহার খুবই মিষ্টি ছিল। আমরা তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম আর তার সঙ্গে আমাদের সময় অনেক আনন্দে কেটেছে। সোসাইটি আমাদেরকে যখন হ্যামিলটন শহরে বদলি করে তখন আমাদের অনেকগুলো বাইবেল স্টাডি ছিল। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মতো বয়স পার হয়ে গেলেও কয়েকদিন পরই আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, আমি সেখানে যোগ দিইনি বলে ১৯৪৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে বিচার হওয়ার পর শাস্তি হিসেবে আমাকে সার্ভিস ক্যাম্পে পাঠানো হয়। যারা অস্ত্র হাতে নিতে অস্বীকার করত তাদেরকে সরকারের অন্যান্য কাজ করার জন্য সার্ভিস ক্যাম্পে পাঠানো হতো আর ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত আমি সেখানেই থাকি।
ছাড়া পাবার পর পরই আমি ও ইলিন ওন্টারিওর কর্নওয়ালে অগ্রগামীর কাজ করার চিঠি পাই। তার কিছুদিন পরই আমরা সোসাইটির আইন বিভাগ থেকে এক বিশেষ দায়িত্ব পেয়ে কুইবেকে চলে যাই। এই সময় কুইবেকে যিহোবার সাক্ষিদের ওপর প্রচণ্ড তাড়না চলছিল। আমি ভাইদের সাহায্য করার জন্য চারটে আদালতে যাই। ওই সময়টা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর ও বিশ্বাস-দৃঢ় করার মতো সময়।
১৯৪৬ সালে ক্লিভল্যান্ডে সম্মেলনের পর, আমি সীমা ও জেলায় জেলায় কাজ করার দায়িত্ব পাই আর এই কাজের ফলে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে সমুদ্র উপকূলের শহরগুলোতে যেতে হয়। সময় যেন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাচ্ছিল। ১৯৪৮ সালে আমরা ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ১১তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার ডাক পাই। আমাদের ক্লাসে মোট ১০৮ জন ছাত্রছাত্রী ছিল আর তাদের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন অভিষিক্ত খ্রীষ্টান। আমাদের ক্লাসের নির্দেশক ছিলেন ভাই আ্যলবার্ট শ্রোডার এবং ম্যাক্সওয়েল ফ্রেন্ড। অনেক দিন ধরে যিহোবাকে সেবা করছেন এমন ভাইবোনদের সঙ্গে সময় কাটানো এক সুন্দর ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল!
একদিন ব্রুকলিন থেকে ভাই নর আমাদের দেখতে আসেন। তার বক্তৃতায়, জাপানি ভাষা শিখতে আগ্রহী এমন ২৫ জন ভাইবোনকে তিনি হাত তোলার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তা শুনে ১০৮ জন ভাইবোনই হাত উঠিয়েছিলেন! তাই প্রেসিডেন্টকেই বাছাই করতে হয় যে কারা কারা জাপানি ভাষা শিখবে। আমি মনে করি যিহোবা তাকে সাহায্য করেছিলেন কারণ তিনি খুব ভালভাবে কাজটা করতে পেরেছিলেন। যে ২৫ জনকে বাছাই করা হয়েছিল তাদের অনেকে এবং পরে আরও অন্যান্যরা জাপানে কাজ শুরু করেছিলেন আর তাদের কেউ কেউ এখনও তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাদের অনেকের বয়স হয়ে গেছে কিন্তু এখনও তারা সেখানে আছেন। আবার কেউ কেউ যেমন লয়েড ও মেলবা ব্যারি জাপান থেকে অন্যান্য কাজের দায়িত্বও পেয়েছিলেন। লয়েড ব্যারি গত বছর মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত পরিচালক গোষ্ঠীর একজন সদস্য ছিলেন। যিহোবা তাদের সবাইকে যে পুরস্কার দিয়েছেন তাদের সঙ্গে আমরাও আনন্দ করি।
গ্র্যাজুয়েশনের দিন আমাদেরকে জ্যামাইকায় কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কুইবেকে তখনও মামলার শুনানি সংক্রান্ত সমস্যা চলতে থাকায় আমাদেরকে আবারও কানাডায় ফিরে আসার জন্য বলা হয়।
আরও বেশি গানবাজনা!
অগ্রগামীর কাজ করার জন্য আমি গানবাজনা করা ছেড়েই দিয়েছিলাম কিন্তু আমি ছাড়লে কী হবে, গানবাজনা আমাকে ছাড়েনি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ও তার সচিব মিলটন হেনসেল টরেন্টোর ম্যাপল লিফ্ গার্ডেন্স হলে আসেন। ভাই নর “আপনারা যখন ভাবছেন তার চেয়েও দেরিতে!” বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন আর সেটা শুনে সবাই খুব উৎসাহ পেয়েছিল। প্রথমবারের মতো আমাকে ওই সম্মেলনের সংগীত দলকে পরিচালনা দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। রাজ্যের পরিচর্যা গান বই (ইংরেজি, ১৯৪৪) থেকে আমরা কিছু পরিচিত গানের জন্য স্বরলিপি তৈরি করেছিলাম। ভাইয়েরা এগুলো খুবই পছন্দ করেছিল। শনিবার বিকেলে প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর আমরা রবিবারের প্রোগ্রামের জন্য মহড়া দিচ্ছিলাম। আমি দেখতে পাই যে ভাই হেনসেল আমাদের দিকেই আসছেন, তাই আমি বাজানো বন্ধ করে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এখানে আপনাদের দলে কতজন বাদক আছে?” আমি বলি, “সব মিল প্রায় ৩৫ জন হবে।” তখন তিনি বলেন, “আগামী গরমের সময় নিউ ইয়র্কে এর দ্বিগুণ লোক পাবেন।”
কিন্তু, গরমের আগেই আমাকে ব্রুকলিন বেথেলে ডাকা হয়েছিল। কোন একটা কারণে প্রথমে ইলিন আমার সঙ্গে আসতে পারেনি। ১২৪, কলম্বিয়া হাইটসের নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, তাই আমাকে পুরনো বিল্ডিংয়ে একটা ছোট রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। ওই ছোট রুমে আমার সঙ্গে দুজন অভিষিক্ত ভাই ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন প্যান ও অন্যজন ছিলেন কার্ল ক্লেইন। তাদের কাউকেই আমি আগে চিনতাম না। এক রুমে তিনজন থাকায় কি কোন সমস্যা হয়নি? হ্যাঁ হয়েছিল। কিন্তু আমরা একে অন্যের সঙ্গে খুব ভালভাবে মানিয়ে নিয়েছিলাম। বয়স্ক ভাইদের অনেক ধৈর্য ও সহ্য শক্তি ছিল। আমি চেষ্টা করেছিলাম যাতে তাদের কোনরকম অসুবিধা না হয়! ঈশ্বরের আত্মা কী করতে পারে সেই বিষয়ে আমি এক মূল্যবান বিষয় শিখেছিলাম। ভাই ক্লেইনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ও তার সঙ্গে কাজ করে আমি অনেক আশীর্বাদ পেয়েছি! তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন ও অনেক সাহায্যও করেছিলেন। আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছিলাম ও ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা খুব কাছের বন্ধু ছিলাম।
১৯৫০, ১৯৫৩, ১৯৫৫ এবং ১৯৫৮ সালে ইয়াংকি স্টেডিয়ামের সম্মেলনগুলোতে সংগীত পরিচালনায় সাহায্য করা আমার জন্য এক বিরাট সুযোগ ছিল। এছাড়া, ১৯৬৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনার রোজ বোল হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভাই আল ক্যাভেলিনের সঙ্গে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়াও একটা বড় সুযোগ ছিল। ১৯৫৩ সালে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে সম্মেলনে, রবিবার জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার আগে যন্ত্রসংগীতের প্রোগ্রাম হয়েছিল। এরিক ফ্রস্ট দর্শকদের সঙ্গে এডিথ
শিমিওনিক্কে (পরে ভিগ্যান্ট) পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি “সাক্ষিরা, এগিয়ে চলুন!” গানটা গেয়েছিলেন আর আমরা যন্ত্রসংগীত বাজিয়েছিলাম। এই গানের স্বরলিপি ভাই এরিক ফ্রস্ট রচনা করেছিলেন। তারপর, প্রথমবারের মতো আফ্রিকার ভাইবোনদের মিষ্টি গান শুনে আমরা খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মিশনারি ভাই হ্যারি আরনট উত্তর রোডেশিয়া (এখন জাম্বিয়া) থেকে একটা সুন্দর টেপ রেকর্ডিং নিয়ে এসেছিলেন। এর জন্য পুরো স্টেডিয়ামের লোকেরাই গান শুনতে পেয়েছিল।১৯৬৬ সালের গানবই রেকর্ড করা
আপনাদের কি গোলাপি রঙের ইংরেজি গানবইয়ের কথা মনে আছে, যেটার নাম ছিল “মন থেকে গান ও বাদ্য করুন”? এই বইটা যখন প্রায় শেষের দিকে, ভাই নর তখন বলেন যে “আমরা কয়েকটা গান রেকর্ড করব। আমি চাই আপনারা অল্প কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করবেন, শুধু কয়েকটা বেহালা ও কয়েকটা বাঁশি।” বেথেলের কিংডম হলই হবে আমাদের স্টুডিও কিন্তু এটা ব্যবহার করলে কিছু অসুবিধাও হবে। কিংডম হলে রেকর্ডিং করলে পর্দা ছাড়া দেওয়াল, টাইলস্ বসানো মেঝে এবং ধাতব চেয়ারে শব্দ প্রতিধ্বনিত হবে। এই অসুবিধাগুলো দূর করতে কে আমাদের সাহায্য করবে? কেউ একজন বলেছিলেন: “টমি মিচেল! তিনি এবিসি নেটওয়ার্ক স্টুডিওতে কাজ করেন।” আমরা ভাই মিচেলের সঙ্গে দেখা করি আর তিনি খুশি মনে আমাদের সাহায্য করতে রাজি হন।
রেকর্ডিংয়ের প্রথম দিন, শনিবার সকালে আমরা সবাই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম আর বাদ্যকারদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের মধ্যে একজন ভাইয়ের হাতে আমি একটা বড় পিতলের বাঁশির বাক্স দেখি। আমি দেখতে পাই যে ওই ভাই তার বাঁশিটা বাক্স থেকে বের করেন, তারপর এটার স্লাইডকে ঠিক জায়গায় বসান ও বাজানোর জন্য তৈরি হন। ওই ভাই-ই ছিলেন টম মিচেল আর প্রথম দিকে তিনি কিছু অপূর্ব সুর তৈরি করেছিলেন। তিনি বাঁশিকেই বেহালার মতো সুর করে বাজিয়েছিলেন! আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ‘এই ভাইকে আমাদের নিতেই হবে!’ ভাই নর তাতে কোন আপত্তি করেননি।
আমাদের দলে কিছু প্রেমময় ও হাসিখুশি ভাইবোনেরা ছিলেন। দলের সবাই-ই খুব ভাল ও হাসিখুশি ছিলেন! রেকর্ডিং করা খুবই কঠিন একটা কাজ ছিল কিন্তু তারপরেও কেউ কোনরকম অভিযোগ করেননি। রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর সবাই খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলেন; আর যারা সেই কাজ করেছিলেন তারা সবাই একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আমরা সকলে সেই সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম আর যিহোবার আশীর্বাদে কাজটা ভালভাবে শেষ করতে পেরেছিলাম।
আরও বড় বড় কিছু সুযোগ
অনেক বছর ধরে আমি পূর্ণ-সময়ের কাজ করে চলেছি। আমি প্রায় ২৮ বছর ধরে সীমা ও জেলা অধ্যক্ষের কাজ করেছি আর প্রত্যেকটা কাজ করেই আমি আনন্দ পেয়েছি। এর পরের পাঁচ বছর আমি ওন্টারিওতে নরভাল এসেম্বলি হল দেখাশোনার কাজ করেছি। প্রতি সপ্তায় সীমা অধিবেশন ও সেইসঙ্গে বিদেশি ভাষায় জেলা সম্মেলনগুলোর কাজে আমি ও ইলিন খুবই ব্যস্ত ছিলাম। ১৯৭৯/৮০ সালে আর্কিটেক্ট ও ইঞ্জিনিয়াররা এসেম্বলি হলে বসে হালটন হিল্সে সোসাইটির শাখা অফিস বানানোর প্ল্যান তৈরি করেছিলেন। এসেম্বলি হলে কাজ করার পর আমি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ব্রুকলিনে গানের ওপর কাজ করার জন্য আবারও ডাক পাই।
আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ১৯৯৪ সালের ১৭ই জুন, আমাদের ৫৯তম বিবাহবার্ষিকীর এক সপ্তা পর মারা যায়। আমরা একসঙ্গে ৫১ বছর ধরে অগ্রগামীর কাজ করেছি।
আমি যখন আমার জীবনের অনেক ঘটনার কথা চিন্তা করি, আমার মনে পড়ে যে কীভাবে বাইবেল আমাকে সবচেয়ে ভাল পথ দেখিয়েছে। মাঝে মাঝে আমি ইলিনের বাইবেল পড়ি আর তার মনে যে পদগুলো দাগ কেটেছে, সেগুলো দেখে আনন্দ পাই। সে মাঝে মাঝে পুরো পদ, পদের কয়েকটা শব্দ এবং শুধু একটা শব্দে দাগ দিয়ে রেখেছে। ইলিনের মতো আমার মনেও কিছু কিছু পদ অনেক দাগ কেটেছে। ১৩৭ গীতের কিছু কথা আমার মনে পড়ে, যেটা যিহোবার কাছে করা একটা সুন্দর প্রার্থনা: “যিরূশালেম, যদি আমি তোমাকে ভুলে যাই, তবে আমি যেন আর কখনও বীণা বাজাতে না পারি! যদি আমি তোমাকে মনে না করি, যদি আমি তোমাকে আমার পরমানন্দ হতে বেশি ভাল না বাসি, তাহলে আমি যেন আর কখনও গান গাইতে না পারি।” (গীতসংহিতা ১৩৭:৫, ৬, টুডেজ ইংলিশ ভারসান) যদিও আমি গানবাজনা ভালবাসি, তবুও বিশ্বস্তভাবে যিহোবাকে সেবা করেই আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। কারণ যিহোবা আমাকে এক পরিপূর্ণ ও সুখী জীবন পুরস্কার দিয়েছেন।
[পাদটীকা]
^ ১৯৭৩ সালের ১লা জুনের প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি)-এ বুঝিয়ে বলা হয়েছিল যে সেই সময়ের পর থেকে বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার সাক্ষি হওয়ার আগেই, কেন একজনকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে।
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৪৭ সালে ইলিনের সঙ্গে
[৩০ পৃষ্ঠার চিত্র]
অনেক আগে রেকর্ডিং করার সময়