যিহোবা এক দীর্ঘসহিষ্ণু ঈশ্বর
যিহোবা এক দীর্ঘসহিষ্ণু ঈশ্বর
“সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW], স্নেহশীল ও কৃপাময় ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর এবং দয়াতে ও সত্যে মহান্।”—যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬.
১, ২. (ক) অতীতে কারা যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা থেকে উপকার পেয়েছিল? (খ) “দীর্ঘসহিষ্ণুতা” বলতে কী বোঝায়?
নোহের দিনের লোকেরা, মোশির সঙ্গে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো ইস্রায়েলীয়রা ও যীশু যখন পৃথিবীতে ছিলেন সেই সময়কার যিহুদিরা—সবাই-ই ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ছিল। কিন্তু প্রত্যেকেই যিহোবার একই গুণ থেকে উপকার পেয়েছিল আর তা হল দীর্ঘসহিষ্ণুতা। কারও কারও কাছে এর মানে ছিল তাদের জীবন। আর যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতার অর্থ আমাদের জীবনেও একই বিষয় বোঝাতে পারে।
২ দীর্ঘসহিষ্ণুতা কী? যিহোবা তা কখন দেখান এবং কেন? “দীর্ঘসহিষ্ণুতা” বলতে অন্যায় বা বিরক্ত করা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরে সহ্য করা ও সেইসঙ্গে কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলেও তা ভাল করা সম্ভব, এই আশা ছেড়ে না দেওয়াকে বোঝায়। অতএব, এই গুণের পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। এই গুণ বিশেষ করে ঝগড়া-বিবাদপূর্ণ পরিস্থিতির সূত্রপাত করেছে এমন ব্যক্তির মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রাখে। কিন্তু, দীর্ঘসহিষ্ণুতা বলতে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া বোঝায় না। দীর্ঘসহিষ্ণুতার উদ্দেশ্য যখন পূর্ণ হয় বা কোন অবস্থাকে নীরবে সহ্য করার পিছনে যখন কোন কারণ থাকে না, তখন দীর্ঘসহিষ্ণুতা শেষ হয়ে যায়।
৩. যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতার পিছনে কী উদ্দেশ্য রয়েছে আর এর সীমা কতখানি?
৩ মানুষ দীর্ঘসহিষ্ণু হতে পারে, কিন্তু এই গুণের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলেন যিহোবা। যখন থেকে পাপ, যিহোবা ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন থেকে আমাদের সৃষ্টিকর্তা ধৈর্য ধরে সহ্য করে এসেছেন এবং অনুতপ্ত মানুষরা যাতে তাঁর সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আবার ভাল করতে পারে সেইজন্য একটা ব্যবস্থা করেছেন। (২ পিতর ৩:৯; ১ যোহন ৪:১০) কিন্তু, দীর্ঘসহিষ্ণু হওয়ার পিছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেলে, তিনি স্বেচ্ছাচারী অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন ও বর্তমান দুষ্ট বিধিব্যবস্থার শেষ নিয়ে আসবেন।—২ পিতর ৩:৭.
ঈশ্বরের প্রধান গুণগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ
৪. (ক) ইব্রীয় শাস্ত্রে দীর্ঘসহিষ্ণুতার ধারণাকে কীভাবে প্রকাশ করা হয়েছে? (পাদটীকাও দেখুন।) (খ) ভাববাদী নহূম যিহোবার বিষয়ে কীভাবে বর্ণনা করেন এবং এর থেকে যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা সম্বন্ধে কী প্রকাশ পায়?
৪ ইব্রীয় শাস্ত্রে দীর্ঘসহিষ্ণুতার ধারণাকে দুটো ইব্রীয় শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যার আক্ষরিক মানে হল “নাকের দৈর্ঘ্য” এবং বাইবেলে এটাকে “ক্রোধে ধীর” বলে অনুবাদ করা হয়েছে। * ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতার কথা বলতে গিয়ে ভাববাদী নহূম বলেছিলেন: “সদাপ্রভু ক্রোধে ধীর ও পরাক্রমে মহান্, এবং তিনি অবশ্য [পাপের] দণ্ড দেন।” (নহূম ১:৩) তাই, যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা দুর্বলতার কোন চিহ্ন নয় আর এটা এমন নয় যে, এর কোন সীমা নেই। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের একই সঙ্গে ক্রোধে ধীর ও শক্তিতে মহান হওয়ার বিষয়টা দেখায় যে, উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বিরত থাকার ফলেই তিনি দীর্ঘসহিষ্ণু। কাউকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে কিন্তু তিনি ইচ্ছে করে কাউকে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, যাতে অন্যায়কারী নিজেকে পালটানোর সুযোগ পায়। (যিহিষ্কেল ১৮:৩১, ৩২) অতএব, যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা তাঁর প্রেমেরই প্রকাশ এবং তা দেখায় যে, ক্ষমতা ব্যবহার করার সময় তিনি তাঁর প্রজ্ঞাকে কাজে লাগান।
৫. কীভাবে যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতার সঙ্গে তাঁর ন্যায়বিচারও কাজ করে থাকে?
৫ যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতার সঙ্গে তাঁর ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতা কাজ করে থাকে। তিনি মোশির কাছে নিজেকে “স্নেহশীল ও কৃপাময় ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর [“দীর্ঘসহিষ্ণু,” কিং জেমস ভারসন) এবং দয়াতে ও সত্যে মহান্” বলে প্রকাশ করেছেন। (যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬) বেশ কয়েক বছর পর, যিহোবার উদ্দেশে মোশি প্রশংসা গান করেছিলেন: “তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; তিনি বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই; তিনিই ধর্ম্মময় ও সরল।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) হ্যাঁ, যিহোবার করুণা, দীর্ঘসহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার এবং সরলতা একসঙ্গে আকাঙ্ক্ষিত ফল উৎপন্ন করে।
জলপ্লাবনের আগে যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা
৬. আদম ও হবার বংশধরদের প্রতি যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণুতার কোন্ উল্লেখযোগ্য প্রমাণ দেখিয়েছেন?
৬ এদনে আদম ও হবার বিদ্রোহ, প্রেমময় সৃষ্টিকর্তা যিহোবার সঙ্গে তাদের মূল্যবান সম্পর্ক চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। (আদিপুস্তক ৩:৮-১৩, ২৩, ২৪) এই বিচ্ছিন্নতা তাদের বংশধরদেরকে প্রভাবিত করেছিল, যারা উত্তরাধিকারসূত্রে পাপ, অসিদ্ধতা ও মৃত্যু পেয়েছে। (রোমীয় ৫:১৭-১৯) যদিও প্রথম মানব দম্পতি ইচ্ছাকৃতভাবে পাপ করেছিল কিন্তু তবুও, যিহোবা তাদেরকে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। পরে, তিনি প্রেম দেখিয়ে একটা ব্যবস্থা করেছিলেন, যার মাধ্যমে আদম ও হবার বংশধররা তাঁর সঙ্গে আবার সম্মিলিত হতে পারেন। (যোহন ৩:১৬, ৩৬) প্রেরিত পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন: “ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁহার নিজের প্রেম প্রদর্শন করিতেছেন; কারণ আমরা যখন পাপী ছিলাম, তখনও খ্রীষ্ট আমাদের নিমিত্ত প্রাণ দিলেন। সুতরাং সম্প্রতি তাঁহার রক্তে যখন ধার্ম্মিক গণিত হইয়াছি, তখন আমরা কত অধিক নিশ্চয় তাঁহা দ্বারা ঈশ্বরের ক্রোধ হইতে পরিত্রাণ পাইব। কেননা যখন আমরা শত্রু ছিলাম, তখন যদি ঈশ্বরের সহিত তাঁহার পুত্ত্রের মৃত্যু দ্বারা সম্মিলিত হইলাম, তবে সম্মিলিত হইয়া কত অধিক নিশ্চয় তাঁহার জীবনে পরিত্রাণ পাইব।”—রোমীয় ৫:৮-১০.
৭. জলপ্লাবনের আগে যিহোবা কীভাবে দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন আর জলপ্লাবনের আগের বংশকে ধ্বংস করা কেন ন্যায্য ছিল?
৭ নোহের দিনে যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন। জলপ্লাবনের একশ বছরেরও বেশি সময় আগে “ঈশ্বর পৃথিবীতে দৃষ্টিপাত করিলেন, আর দেখ, সে ভ্রষ্ট হইয়াছে, কেননা পৃথিবীস্থ সমুদয় প্রাণী ভ্রষ্টাচারী হইয়াছিল।” (আদিপুস্তক ৬:১২) কিন্তু, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যিহোবা মানবজাতির প্রতি দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “আমার আত্মা মনুষ্যদের মধ্যে নিত্য অধিষ্ঠান করিবেন না, তাহাদের বিপথগমনে তাহারা মাংসমাত্র; পরন্তু তাহাদের সময় এক শত বিংশতি বৎসর হইবে।” (আদিপুস্তক ৬:৩) ওই ১২০ বছরে বিশ্বস্ত নোহ সন্তান জন্ম দেওয়ার এবং ঈশ্বরের আদেশ অনুসারে জাহাজ বানানোর ও আসন্ন জলপ্লাবন সম্বন্ধে তার সময়ের লোকেদের সাবধান করার জন্য সময় পেয়েছিলেন। প্রেরিত পিতর লিখেছিলেন: “নোহের সময়ে, জাহাজ প্রস্তুত হইতে হইতে যখন ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতা বিলম্ব করিতেছিল, . . . সেই জাহাজে অল্প লোক, অর্থাৎ আটটী প্রাণ, জল দ্বারা রক্ষা পাইয়াছিল।” (১ পিতর ৩:২০) এটা ঠিক যে, কেবল নোহের পরিবার ছাড়া আর কেউই তার প্রচারের উদ্দেশ্য “বুঝিতে পারিল না।” (মথি ২৪:৩৮, ৩৯) কিন্তু, নোহকে জাহাজ বানাতে বলে এবং বেশ কয়েক দশক ধরে “ধার্ম্মিকতার প্রচারক” হিসেবে সেবা করতে দিয়ে, যিহোবা নোহের সময়ের লোকেদেরকে তাদের দৌরাত্ম্যপূর্ণ পথ সম্বন্ধে অনুতপ্ত হওয়ার ও তাঁকে সেবা করার জন্য তাঁর দিকে ফিরে আসার অনেক সুযোগ করে দিয়েছিলেন। (২ পিতর ২:৫; ইব্রীয় ১১:৭) ওই দুষ্ট বংশের পরিণাম হিসেবে যে ধ্বংস এসেছিল, তা পুরোপুরি ন্যায্য ছিল।
ইস্রায়েলের প্রতি লক্ষণীয় দীর্ঘসহিষ্ণুতা
৮. ইস্রায়েল জাতির প্রতি কীভাবে যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন?
৮ ইস্রায়েল জাতির প্রতি যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা ১২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছিল। ঈশ্বরের মনোনীত লোক হিসেবে ১,৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের ইতিহাসে বেশির ভাগ সময়ই ইস্রায়েলীয়রা ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতার সীমা কতখানি, তা পরীক্ষা করেছিল। মিশর থেকে অলৌকিকভাবে মুক্তি পাওয়ার কয়েক সপ্তার মধ্যেই তারা মূর্তিপূজায় রত হয়ে তাদের ত্রাণকর্তাকে চরম অসম্মান করেছিল। (যাত্রাপুস্তক ৩২:৪; গীতসংহিতা ১০৬:২১) পরের বছরগুলোতে মরুভূমির মধ্যে ইস্রায়েলীয়দের জন্য যিহোবা অলৌকিকভাবে যে খাবার জুগিয়েছিলেন সেই সম্বন্ধে তারা অভিযোগ করতে শুরু করেছিল, মোশি ও হারণের বিরুদ্ধে বচসা করেছিল, যিহোবার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, পৌত্তলিক উপাসকদের সঙ্গে ব্যভিচার করেছিল ও এমনকি বাল দেবতাকে পর্যন্ত উপাসনা করেছিল। (গণনাপুস্তক ১১:৪-৬; ১৪:২-৪; ২১:৫; ২৫:১-৩; ১ করিন্থীয় ১০:৬-১১) উপযুক্তভাবেই যিহোবা তাঁর লোকেদেরকে একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারতেন কিন্তু এর বদলে তিনি দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন।—গণনাপুস্তক ১৪:১১-২১.
৯. বিচারক ও রাজাদের সময়ে যিহোবা কীভাবে দীর্ঘসহিষ্ণু ঈশ্বর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন?
৯ বিচারকদের শাসনের সময়ে, ইস্রায়েলীয়রা বারবার প্রতিমাপূজায় রত হয়েছিল। তারা এইরকম করেছিল বলে যিহোবা তাদেরকে শত্রুদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা যখন অনুতপ্ত হয়েছিল ও তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিল, তখন তিনি দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন ও তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য বিচারকদের ব্যবস্থা করেছিলেন। (বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ২:১৭, ১৮) রাজারা বেশ দীর্ঘ সময় শাসন করেছিলেন আর তাদের শাসনামলে হাতে গোনা মাত্র অল্প কয়েকজন রাজা যিহোবার প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি দেখিয়েছিলেন। এমনকি বিশ্বস্ত রাজাদের শাসনের সময়েও লোকেরা প্রায়ই সত্য উপাসনার সঙ্গে মিথ্যা উপাসনা মিশিয়ে ফেলত। আর তাদের অবিশ্বস্ততা সম্বন্ধে সাবধান করার জন্য যিহোবা যখন ভাববাদীদের পাঠাতেন, তখন লোকেরা সাধারণত কলুষিত যাজক ও মিথ্যা ভাববাদীদের কথাই শুনত। (যিরমিয় ৫:৩১; ২৫:৪-৭) সত্যি বলতে কী, ইস্রায়েলীয়রা যিহোবার বিশ্বস্ত ভাববাদীদেরকে তাড়না করেছিল আর এমনকি তাদের কাউকে কাউকে মেরেও ফেলেছিল। (২ বংশাবলি ২৪:২০, ২১; প্রেরিত ৭:৫১, ৫২) এত কিছু সত্ত্বেও, যিহোবা তাদের প্রতি দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়ে চলেছিলেন।—২ বংশাবলি ৩৬:১৫.
যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা শেষ হয়ে যায়নি
১০. যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা কখন এর সীমায় পোঁছায়?
১০ কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে, ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতার একটা সীমা আছে। সা.কা.পূ. ৭৪০ সালে, তিনি অশূরীয়দেরকে ইস্রায়েলের দশ বংশের রাজ্যকে ধ্বংস করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং এর অধিবাসীদেরকে নির্বাসনে যেতে দিয়েছিলেন। (২ রাজাবলি ১৭:৫, ৬) আর সা.কা.পূ. ৬০৭ সালে তিনি বাবিলনীয়দেরকে ইস্রায়েলের দুই বংশের রাজ্যকে আক্রমণ করতে এবং যিরূশালেম ও এর মন্দির ধ্বংস করতে দিয়েছিলেন।—২ বংশাবলি ৩৬:১৬-১৯.
১১. এমনকি বিচার ঘোষণা করার সময়েও যিহোবা কীভাবে দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন?
১১ কিন্তু, এমনকি ইস্রায়েল ও যিহূদার বিরুদ্ধে তাঁর বিচার ঘোষণা করার সময় যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণু হতে ভুলে যাননি। তাঁর ভাববাদী যিরমিয়ের মাধ্যমে যিহোবা তাঁর মনোনীত লোকেদের পুনর্স্থাপনের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “বাবিলের সম্বন্ধে সত্তর বৎসর সম্পূর্ণ হইলে আমি তোমাদের তত্ত্বাবধান করিব, এবং তোমাদের পক্ষে আমার মঙ্গলবাক্য সিদ্ধ করিব, তোমাদিগকে পুনর্ব্বার এই স্থানে ফিরাইয়া আনিব। আর আমি তোমাদিগকে আমার উদ্দেশ পাইতে দিব, . . . এবং আমি তোমাদের বন্দি-দশা ফিরাইব, এবং যে সকল জাতির মধ্যে ও যে সকল স্থানে তোমাদিগকে তাড়াইয়া দিয়াছি, সেই সকল স্থান হইতে তোমাদিগকে সংগ্রহ করিব।”—যিরমিয় ২৯:১০, ১৪.
১২. মশীহের আগমনের বিষয়টা জড়িত থাকায় যিহুদি অবশিষ্টাংশদের যিহুদায় ফিরে আসা কীভাবে দেখিয়েছিল যে, তা ঈশ্বরের নির্দেশনায়ই হয়েছিল?
১২ নির্বাসিত যিহুদিদের মধ্যে থেকে এক অবশিষ্টাংশ যিহূদায় ফিরে এসেছিল এবং যিরূশালেমে পুনর্নির্মিত মন্দিরে যিহোবার উপাসনাকে আবার চালু করেছিল। যিহোবার উদ্দেশ্যগুলো পরিপূর্ণ করায় এই অবশিষ্টাংশরা “সদাপ্রভুর নিকট হইতে আগত শিশিরের ন্যায়” হবে, যা সতেজতা ও উন্নতি নিয়ে আসে। এছাড়াও তারা “বনপশুদের মধ্যে যেমন সিংহ” তেমনি সাহসী ও শক্তিশালী হবে। (মীখা ৫:৭, ৮) শেষের এই কথাগুলো হয়তো ম্যাকাবীয়দের যুগে পরিপূর্ণ হয়েছিল, যখন যিহুদিরা ম্যাকাবি গোত্রের অধীনে থেকে প্রতিজ্ঞাত দেশ থেকে তাদের শত্রুদের বের করে দিয়েছিল এবং যে মন্দির অপবিত্র হয়ে পড়েছিল সেটাকে আবার উৎসর্গ করেছিল। এভাবে ওই দেশ ও মন্দিরকে রক্ষা করা হয়েছিল, যাতে ঈশ্বরের পুত্র যখন মশীহ হিসেবে আসবেন, তখন অন্যান্য বিশ্বস্ত অবশিষ্টাংশরা তাঁকে স্বাগত জানাতে পারে।—দানিয়েল ৯:২৫; লূক ১:১৩-১৭, ৬৭-৭৯; ৩:১৫, ২১, ২২.
১৩. যিহুদিরা যিহোবার পুত্রকে হত্যা করা সত্ত্বেও, কীভাবে তিনি তাদের প্রতি দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন?
১৩ এমনকি যিহুদিরা যিহোবার পুত্রকে মেরে ফেলা সত্ত্বেও, তিনি সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়ে শুধু তাদেরকেই অব্রাহামের আত্মিক বংশের অংশ হওয়ার বিশেষ সুযোগ দিয়েছিলেন। (দানিয়েল ৯:২৭) * সা.কা. ৩৬ সালের আগে ও পরে কিছু যিহুদি এই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং এই জন্যই পৌল পরে বলেছিলেন “অনুগ্রহের নির্ব্বাচন অনুসারে অবশিষ্ট এক অংশ রহিয়াছে।”—রোমীয় ১১:৫.
১৪. (ক) সাধারণ কাল ৩৬ সালে কাদেরকে অব্রাহামের আত্মিক বংশের অংশ হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল? (খ) আত্মিক ইস্রায়েলের সদস্যদেরকে যিহোবা যেভাবে মনোনীত করেন, সেই বিষয়ে পৌল কীভাবে তার অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন?
১৪ সাধারণ কাল ৩৬ সালে, অব্রাহামের আত্মিক বংশের অংশ হওয়ার বিশেষ সুযোগ প্রথমবারের মতো সেই ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছিল, যারা যিহুদি বা ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছিলেন না। এছাড়াও, যারা এতে সাড়া দিয়েছিলেন তারা যিহোবার অপরিসীম দয়া ও দীর্ঘসহিষ্ণুতা লাভ করেছিলেন। (গালাতীয় ৩:২৬-২৯; ইফিষীয় ২:৪-৭) আত্মিক ইস্রায়েলের মোট সংখ্যা পূর্ণ করার জন্য যিহোবা করুণার সঙ্গে যে দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন তার পিছনে যে প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্য রয়েছে, এর প্রতি গভীর উপলব্ধি দেখাতে গিয়ে পৌল আনন্দের সঙ্গে বলেছিলেন: “আহা! ঈশ্বরের ধনাঢ্যতা ও প্রজ্ঞা ও জ্ঞান কেমন অগাধ! তাঁহার বিচার সকল কেমন বোধাতীত! তাঁহার পথ সকল কেমন অননুসন্ধেয়!”—রোমীয় ১১:২৫, ২৬, ৩৩; গালাতীয় ৬:১৫, ১৬.
তাঁর নামের জন্য দীর্ঘসহিষ্ণুতা
১৫. ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখানোর মূল কারণটা কী আর কোন্ বিচার্য বিষয়টা মীমাংসা করার জন্য সময়ের দরকার ছিল?
১৫ কেন যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখান? মূলত তাঁর পবিত্র নামকে মহিমান্বিত ও তাঁর সার্বভৌমত্বের সত্যতাকে প্রতিপাদন করার জন্য তিনি তা দেখিয়ে থাকেন। (১ শমূয়েল ১২:২০-২২) যিহোবা তাঁর সার্বভৌমত্বকে যেভাবে কাজে লাগান সেই বিষয়ে শয়তান যে নৈতিক বিচার্য বিষয় তুলেছিল, সেটা সমস্ত সৃষ্টির কাছে সন্তোষজনকভাবে মীমাংসা করার জন্য সময়ের দরকার ছিল। (ইয়োব ১:৯-১১; ৪২:২, ৫, ৬) তাই, তাঁর লোকেরা যখন মিশরে নির্যাতিত হচ্ছিল, তখন ফরৌণকে যিহোবা বলেছিলেন: “আমি এই জন্যই তোমাকে স্থাপন করিয়াছি, যেন আমার প্রভাব তোমাকে দেখাই ও সমস্ত পৃথিবীতে আমার নাম কীর্ত্তিত হয়।”—যাত্রাপুস্তক ৯:১৬.
১৬. (ক) যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা কীভাবে তাঁর নামের জন্য প্রজা প্রস্তুত করেছিল? (খ) যিহোবার নাম কীভাবে পবিত্র হবে এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের সত্যতা কীভাবে প্রতিপাদন করা হবে?
১৬ প্রেরিত পৌল যখন ঈশ্বরের পবিত্র নামকে মহিমান্বিত করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতার ভূমিকা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তখন তিনি ফরৌণকে বলা যিহোবার কথাগুলো উদ্ধৃতি করেছিলেন। আর এর পরপরই পৌল লিখেছিলেন: “ইহাতেই বা কি?—যদি ঈশ্বর আপন ক্রোধ দেখাইবার ও আপন পরাক্রম জানাইবার ইচ্ছা করিয়া, বিনাশার্থে পরিপক্ব ক্রোধপাত্রদের প্রতি বিপুল সহিষ্ণুতায় ধৈর্য্য করিয়া থাকেন, এবং [এই জন্য করিয়া থাকেন,] যেন সেই দয়াপাত্রদের উপরে আপন প্রতাপ-ধন জ্ঞাত করেন, যাহাদিগকে প্রতাপের নিমিত্ত পূর্ব্বে প্রস্তুত করিয়াছেন, আর যাহাদিগকে আহ্বান করিয়াছেন, কেবল যিহূদীদের মধ্য হইতে নয়, পরজাতিদেরও মধ্য হইতে আমাদিগকেই করিয়াছেন। যেমন তিনি হোশেয়-গ্রন্থেও বলেন, ‘যাহারা আমার প্রজা নয়, তাহাদিগকে আমি নিজ প্রজা বলিব।’” (রোমীয় ৯:১৭, ২২-২৫) যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণু ছিলেন বলেই বিভিন্ন জাতির মধ্যে থেকে তিনি “আপন নামের জন্য . . . এক দল প্রজা” গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। (প্রেরিত ১৫:১৪) তাদের মস্তক যীশু খ্রীষ্টের অধীনে এই ‘পবিত্র প্রজাগণ’ সেই রাজ্যের উত্তরাধিকার হবেন, যে রাজ্যকে যিহোবা তাঁর মহা নামকে পবিত্র করার এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের সত্যতা প্রতিপাদন করার জন্য কাজে লাগাবেন।—দানিয়েল ২:৪৪; ৭:১৩, ১৪, ২৭; প্রকাশিত বাক্য ৪:৯-১১; ৫:৯, ১০.
যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা পরিত্রাণ নিয়ে আসে
১৭, ১৮. (ক) কী করলে আমরা নিজেদের অজান্তেই যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতার জন্য তাঁকে দোষ দিতে পারি? (খ) যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতাকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?
১৭ মানবজাতি প্রথম যখন পাপে পতিত হয়েছিল, তখন থেকে আজ পর্যন্ত যিহোবা নিজেকে একজন দীর্ঘসহিষ্ণু ঈশ্বর হিসেবে দেখিয়ে আসছেন। তাঁর দীর্ঘসহিষ্ণুতার কারণেই তিনি জলপ্লাবনের আগে লোকেদেরকে সাবধান করে দেওয়ার ও পরিত্রাণের জন্য একটা জাহাজ বানাতে সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁর ধৈর্য যখন শেষ সীমায় পৌঁছেছিল, তখন জলপ্লাবন এসেছিল। একইভাবে আজকে, যিহোবা প্রচুর দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছেন এবং কেউ কেউ যতখানি ধারণা করেছিল, এর চেয়ে আরও বেশি দিন ধরে চলছে। তাই বলে হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্য এটা কোন কারণ নয়। হাল ছেড়ে দিলে দীর্ঘসহিষ্ণুতার জন্য ঈশ্বরেরই সমালোচনা করা হবে। পৌল জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তাঁহার মধুর ভাব ও ধৈর্য্য ও চিরসহিষ্ণুতারূপ ধন কি হেয়জ্ঞান করিতেছ? ঈশ্বরের মধুর ভাব যে তোমাকে মনপরিবর্ত্তনের দিকে লইয়া যায়, ইহা কি জান না?”—রোমীয় ২:৪.
১৮ আমাদের মধ্যে কেউই জানি না যে, পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরের অনুমোদন পেতে হলে কতদূর পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘসহিষ্ণুতার দরকার হবে। পৌল আমাদেরকে পরামর্শ দেন, “সভয়ে ও সকম্পে আপন আপন পরিত্রাণ সম্পন্ন কর।” (ফিলিপীয় ২:১২) প্রেরিত পিতর সহ খ্রীষ্টানদের লিখেছিলেন: “প্রভু নিজ প্রতিজ্ঞা বিষয়ে দীর্ঘসূত্রী নহেন—যেমন কেহ কেহ দীর্ঘসূত্রিতা জ্ঞান করে—কিন্তু তোমাদের পক্ষে তিনি দীর্ঘসহিষ্ণু; কতকগুলি লোক যে বিনষ্ট হয়, এমন বাসনা তাঁহার নাই; বরং সকলে যেন মনপরিবর্ত্তন পর্য্যন্ত পঁহুছিতে পায়, এই তাঁহার বাসনা।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—২ পিতর ৩:৯.
১৯. কোন্ উপায়ে আমরা যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা থেকে উপকার পেতে পারি?
১৯ তাই, আসুন যিহোবা বিভিন্ন বিষয়কে যেভাবে মীমাংসা করেন, তাতে আমরা অধৈর্য হয়ে না পড়ি। এর বদলে, আসুন আমরা পিতরের পরামর্শ মেনে চলি এবং “আমাদের প্রভুর দীর্ঘসহিষ্ণুতাকে পরিত্রাণ জ্ঞান” করি। কাদের জন্য পরিত্রাণ? আমাদের নিজেদের ও সেইসঙ্গে এমন অগণিত ব্যক্তিদের জন্য, যারা এখনও “রাজ্যের . . . সুসমাচার” শোনেনি। (২ পিতর ৩:১৫; মথি ২৪:১৪) এটা আমাদেরকে যিহোবা কতটা উদারভাবে দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন, তার প্রতি উপলব্ধি দেখাতে সাহায্য করবে এবং অন্যদের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে দীর্ঘসহিষ্ণু হতে প্রেরণা দেবে।
[পাদটীকাগুলো]
^ ইব্রীয় ভাষায় “নাক বা নাসারন্ধ্রের (’আফ) জন্য যে শব্দ” ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রায়ই রূপক অর্থে রাগকে প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়। একজন রাগী ব্যক্তি রাগে ফুঁসতে থাকে বা নাক দিয়ে জোরে শব্দ করে বলেই এই শব্দটা ব্যবহার করা হয়।
^ এই ভবিষ্যদ্বাণীটা আরও ভালভাবে বোঝার জন্য যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত দানিয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীতে মনোযোগ দিন! (ইংরেজি) বইয়ের ১৯১-৪ পৃষ্ঠা দেখুন।
আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন?
• বাইবেলে “দীর্ঘসহিষ্ণুতা” শব্দের মানে কী?
• জলপ্লাবনের আগে, বাবিলনে বন্দিত্বে যাওয়ার পরে এবং প্রথম শতাব্দীতে কীভাবে যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন?
• কোন্ গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর জন্য যিহোবা দীর্ঘসহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন?
• যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতাকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
জলপ্লাবনের আগে যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা লোকেদেরকে অনুতপ্ত হওয়ার জন্য বিরাট সুযোগ করে দিয়েছিল
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাবিলনের পতনের পর, যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা থেকে যিহুদিরা উপকৃত হয়েছিল
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রথম শতাব্দীতে যিহুদি ও ন-যিহুদি উভয়ই যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতা থেকে উপকার পেয়েছিল
[১২ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
আজকে খ্রীষ্টানরা যিহোবার দীর্ঘসহিষ্ণুতাকে ভালভাবে কাজে লাগান