আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে সেবা করা
জীবন কাহিনী
আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে সেবা করা
বলেছেন ডন রেনডেল
১৯২৭ সালে আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন মা মারা যান। কিন্তু, তার বিশ্বাস আমার জীবনে এক বিরাট ছাপ ফেলেছিল। সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
বাবামার যখন বিয়ে হয়, তখন বাবা একজন পেশাদার সৈনিক ছিলেন ও মা চার্চ অফ ইংল্যান্ডের এক বিশ্বস্ত সদস্যা ছিলেন। সেটা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের কথা। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং গির্জার মঞ্চকে সেনাবাহিনীর নতুন সদস্যদেরকে ভর্তি করার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করায় মা তার গির্জার পল্লিযাজকের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। উত্তরে পাদরি কী বলেছিলেন? “আপনি বাড়ি যান আর এই ব্যাপারে আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নেই!” তবে এই উত্তরে মা সন্তুষ্ট হননি।
১৯১৭ সালে যুদ্ধ যখন চরমে, তখন মা “ফটো-ড্রামা অফ ক্রিয়েশন” দেখতে যান। সত্য খুঁজে পেয়েছেন এই বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাইবেল ছাত্রদের—যিহোবার সাক্ষিরা তখন এই নামেই পরিচিত ছিল—সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য তার গির্জা ছেড়ে চলে আসেন। ইংলিশ কাউন্টি অফ সামারসেটের কাছে আমাদের ওয়েস্ট ককার গ্রামের সবচেয়ে কাছের শহর, ইয়ভিলের একটা মণ্ডলীতে তিনি সভায় যেতেন।
শীঘ্রিই মা তার দুই দিদি ও এক বোনকে নতুন বিশ্বাস সম্বন্ধে জানান। ইয়ভিল মণ্ডলীর বয়স্ক সদস্যরা আমাকে বলেছেন যে, মা ও তার বোন মিলি কীভাবে উদ্যোগের সঙ্গে দূরের অঞ্চলগুলোতে সাইকেল চালিয়ে বাইবেল অধ্যয়নের সহায়ক শাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন (ইংরেজি) বই বিতরণ করতেন। কিন্তু খুবই দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, যক্ষ্মা হওয়ায় জীবনের শেষ ১৮ মাস মা বিছানায় ছিলেন, কারণ সেই সময়ে এই রোগের কোন চিকিৎসা ছিল না।
আত্মত্যাগের অভ্যাস
ওই সময় মিলি মাসি আমাদের বাড়িতে থাকতেন আর মা যখন খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তিনি তার যত্ন নিতেন
এবং আমার ও আমার সাত বছর বয়সী দিদি জোনের দেখাশোনা করতেন। মা মারা যাওয়ায় মিলি মাসি সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে দেখাশোনা করার ভার নেওয়ার কথা বলেন। বাবা এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পেরে খুশি মনে রাজি হয়ে যান ও বলেন যে, মিলি মাসি আমাদের সঙ্গে সবসময় থাকতে পারবেন।মাসিকে আমরা অনেক ভালবাসতাম আর তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন বলে আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? বেশ কয়েক বছর পর, মিলি মাসি আমাদের বলেছিলেন যে, মা যে-ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন—জোন ও আমাকে বাইবেলের সত্য শেখানোর—তিনি তা গেঁথে তুলতে বাধ্য, যা বাবা কখনোই করবেন না বলে তিনি জানতেন কারণ ধর্মের প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না।
পরে আমরা এও জেনেছিলাম যে, মিলি মাসি আরেকটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমাদেরকে সঠিকভাবে দেখাশোনা করার জন্য তিনি কখনও বিয়ে করবেন না। কত বড় আত্মত্যাগ! তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা দেখানোর যথেষ্ট কারণ আমার ও জোনের আছে। মিলি মাসির শিক্ষা ও তার নিজের চমৎকার উদাহরণ, আমাদের মধ্যে গেঁথে রয়েছে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়
জোন ও আমি গ্রামের চার্চ অফ ইংল্যান্ড স্কুলে পড়তাম আর সেখানকার প্রধান শিক্ষিকাকে মিলি মাসি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা সম্বন্ধে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন গির্জায় যেত, তখন আমরা ঘরে ফিরে আসতাম এবং গির্জার পল্লিযাজক যখন ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুলে আসতেন, তখন আমরা অন্য ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে বসতাম ও আমাদেরকে শাস্ত্রের পদ মুখস্ত করতে দেওয়া হতো। এটা আমার জন্য খুবই উপকারজনক হয়েছিল কারণ এই পদগুলো আমার মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে গিয়েছিল।
আমার বয়স যখন ১৪ বছর, তখন আমি পড়ালেখা ছেড়ে দিই এবং স্থানীয় পনির তৈরির কারখানায় চার বছরের একটা প্রশিক্ষণ নিই। এ ছাড়া আমি পিয়ানো বাজাতে শিখি এবং গান ও বলড্যান্স ছিল আমার শখ। আমার হৃদয়ে যদিও বাইবেলের সত্য ছিল কিন্তু তখনও তা আমাকে প্রেরণা দেয়নি। এরপর ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে একদিন, একজন বয়স্কা সাক্ষি আমাকে তার সঙ্গে ১১০ কিলোমিটার দূরে সুইনডনের এক সম্মেলনে যেতে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে ব্রিটেনের যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক দাস আ্যলবার্ট ডি. শ্রোডার জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই অধিবেশন আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন দুর্বার গতিতে চলছিল। কিন্তু আমি তখন কী করছিলাম? আমি ইয়ভিল কিংডম হলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সবচেয়ে প্রথম যে-সভায় যোগ দিই সেখানে প্রথম বারের মতো রাস্তায় সাক্ষ্যদান করার কথা ঘোষণা করা হয়। সীমিত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, আমি এই কাজে অংশ নিই এবং আমার অনেক বন্ধু পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ অবাক হয়ে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে!
১৯৪০ সালের জুন মাসে আমি ব্রিস্টল শহরে বাপ্তিস্ম নিই। এক মাসের মধ্যে আমি নিয়মিত অগ্রগামী অর্থাৎ পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে নাম লেখাই। অল্প কিছুদিন পর আমার দিদিও যখন তার উৎসর্গীকরণের চিহ্নস্বরূপ জলে বাপ্তিস্ম নেয়, তখন আমি কত খুশিই না হয়েছিলাম!
যুদ্ধের সময় অগ্রগামীর কাজ করা
যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আমি কাগজপত্র পাই। আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আমি ইয়ভিলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করায় আমাকে ব্রিস্টলের এক আদালতে হাজির হতে হয়েছিল। জন উইনের সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করার জন্য সিনডারফোর্ড, গ্লসেস্টারশায়ার ও পরে হেভারফোর্ডওয়েস্ট এবং ওয়েলসের কারমারদেনে গিয়েছিলাম। * পরে কারমারদেনের একটা আদালতের রায়ে সুয়ানসি জেলে আমার তিন মাসের জেল হয় ও সেইসঙ্গে ১৭২৫ টাকা জরিমানা করা হয়, যা সেই সময়ের জন্য অনেক বেশি ছিল। এরপর সেই জরিমানা দিতে না পারায় আমার আবারও তিন মাসের জন্য জেল হয়।
তৃতীয় বার শুনানির সময় আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়: “আপনি কি জানেন না যে বাইবেল বলে, ‘কৈসরের যাহা যাহা, কৈসরকে দেও’?” উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, আমি জানি কিন্তু ওই পদের শেষের অংশটুকু এও বলে: “আর ঈশ্বরের যাহা যাহা, ঈশ্বরকে দেও।” আর আমি ঠিক তা-ই করছি।’ (মথি ২২:২১) কয়েক সপ্তা পর আমি একটা চিঠি পাই, যেটাতে আমাকে জানানো হয় যে, সেনাবাহিনীর কাজের বাধ্যবাধকতা থেকে আমি মুক্ত।
১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে আমাকে লন্ডন বেথেল পরিবারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরের শীতে, নেথেন এইচ. নর, যিনি তখন সারা পৃথিবীর প্রচার কাজের নেতৃত্বে ছিলেন এবং তার সচিব মিলটন জি. হেনশেল লন্ডনে আসেন। মিশনারি প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডে ব্রিটেন থেকে আটজন যুবক ভাইকে ডাকা হয়েছিল আর তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
মিশনারি কার্যভার
১৯৪৬ সালের ২৩শে মে, আমরা ফুয়ির ছোট কর্নিশ বন্দর থেকে যুদ্ধের সময়কার একটা লিবার্টি জাহাজে করে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পোতাশ্রয়ের কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন কালিন্জ ছিলেন একজন যিহোবার সাক্ষি আর আমরা ঘাট ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাইরেন বাজিয়েছিলেন। আমরা যখন দেখি যে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের তীর আর দেখা যাচ্ছে না, তখন স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে খুশি ও কান্নার এক মিশ্র অনুভূতি হয়। আটলান্টিক মহাসাগর পার হওয়া খুবই কঠিন ছিল কিন্তু ১৩ দিন পর আমরা নিরাপদে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পৌঁছাই।
ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে ১৯৪৬ সালের ৪ থেকে ১১ই আগস্ট আট দিনের, আনন্দিত জাতিগুলোর ঈশতান্ত্রিক অধিবেশনে যোগ দেওয়া ছিল খুবই রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা। ৩২টা দেশ থেকে ৩০২ জন প্রতিনিধি সহ সেখানে মোট আশি হাজার জন উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলনে উদ্যমী লোকেদের সামনে সচেতন থাক! * পত্রিকা এবং বাইবেল অধ্যয়ন সহায়ক “ঈশ্বর যেন সত্য হোন” (ইংরেজি) বইটা প্রকাশ করা হয়।
আমরা ১৯৪৭ সালে গিলিয়েড থেকে গ্র্যাজুয়েট হই এবং বিল কপসন ও আমাকে মিশরে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু মিশরে যাওয়ার আগে আমি ব্রুকলিন বেথেলে রিচার্ড আ্যব্রাহামসনের কাছ থেকে অফিসের কাজের ওপর ভালভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাই। আমরা আলেকজান্দ্রিয়াতে পৌঁছে জাহাজ থেকে নামি এবং শীঘ্রিই মধ্যপ্রাচ্যের জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে নিই। তবে, আরবি ভাষা শেখা খুব কঠিন ছিল আর আমাকে চারটে ভাষায় টেস্টিমনি কার্ড ব্যবহার করতে হয়েছিল।
বিল কপসন সেখানে সাত বছর থেকেছিলেন কিন্তু প্রথম বছরের পর আমি আমার ভিসা রিনিউ করতে পারিনি, তাই আমাকে সেই দেশ ছাড়তে হয়েছিল। মিশনারি সেবার ওই বছরটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রদ সময়। প্রতি সপ্তায় ২০টারও বেশি গৃহ বাইবেল অধ্যয়ন করানোর সুযোগ আমার হয়েছিল এবং সেই সময় সত্য শিখেছিল এমন ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও সক্রিয়ভাবে যিহোবার প্রশংসা করে চলেছেন। এরপর মিশর থেকে আমাকে সাইপ্রাসে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়।
সাইপ্রাস এবং ইস্রায়েল
আমি গ্রিক ভাষা শিখতে শুরু করি আর সেখানকার আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি। অল্প কিছুদিন পর, আ্যনথনি সাইডারিসকে যখন গ্রিসে চলে যেতে বলা হয়, তখন আমাকে সাইপ্রাসের কাজ দেখাশোনার জন্য নিয়োগ করা হয়। সেই সময় সাইপ্রাস শাখা অফিস ইস্রায়েলের কাজও দেখাশোনা করত আর মাঝে-মধ্যে অন্যান্য ভাইদের নিয়ে সেখানকার অল্প কয়েকজন সাক্ষির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আমার হতো।
ইস্রায়েলে আমার প্রথম যাত্রায় আমরা হাইফার একটা রেস্টুরেন্টে ছোট সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম, যেখানে ৫০ থেকে ৬০ জন ব্যক্তি এসেছিলেন। জাতীয় দলগুলোকে ভাগ করে আমরা ছয়টা ভাষায় অধিবেশন কার্যক্রম উপস্থাপনা করেছিলাম! আরেকবার আমি যিহোবার সাক্ষিদের তৈরি একটা চলচিত্র জেরুসালেমে দেখাতে পেরেছিলাম এবং জনসাধারণের উদ্দেশে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম, যে-সম্বন্ধে ইংরেজি ভাষার খবরের কাগজে ভাল রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল।
সেই সময় সাইপ্রাসে প্রায় ১০০ জন সাক্ষি ছিলেন এবং বিশ্বাসের জন্য তাদেরকে প্রাণপণ লড়াই করতে হয়েছিল। গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার যাজকদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দলগুলো আমাদের সম্মেলনে বাধা দিয়েছিল এবং গ্রামের এলাকাগুলোতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আমাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারার অভিজ্ঞতা, আমার জন্য নতুন বিষয় ছিল। আমাকে শিখতে হয়েছিল যে, কীভাবে দ্রুত পালাতে হয়! এইরকম হিংস্র বিরোধিতার মুখে এই দ্বীপে আরও কয়েকজন মিশনারিদের পেয়ে আমাদের বিশ্বাস শক্তিশালী হয়েছিল। ডেনিস ও ম্যাভিস ম্যাথিয়ুস ও সেইসঙ্গে জন হুলি এবং বেরিল হেউড আমার সঙ্গে ফামাগুস্টায় যোগ দিয়েছিলেন এবং টম ও মেরি গুলডেন ও লন্ডনে জন্ম নেওয়া সাইপ্রাসের নিনা কানস্টানটি লিমাসলে গিয়েছিলেন। একই সময়ে বিল কপসনকেও সাইপ্রাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে বার্ট ও বেরিল ভেইসি তার সঙ্গে যোগ দেন।
পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া
১৯৫৭ সালের শেষে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং মিশনারি কার্যভার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আমি ঠিক করেছিলাম যে, স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমার ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়া উচিত, যেখানে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আমি অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম। আমার দিদি ও দাদাবাবু প্রেমের সঙ্গে তাদের এখানে আমাকে থাকতে দিয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতি পালটে যায়। জোনের জন্য পরিস্থিতি দিন-দিন কঠিন হচ্ছিল। আমি যে-১৭ বছর ছিলাম না এই সময়ে সে তার স্বামী ও ছোট মেয়ের দেখাশোনা করা ছাড়াও, প্রেমের সঙ্গে আমার বাবা ও মিলি মাসির দেখাশোনা করেছিল, যাদের দুজনেরই তখন অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল ও শরীর ভাল ছিল না। মাসির আত্মত্যাগের উদাহরণ অনুকরণ করার সুযোগ এসেছিল আর তাই মাসি ও বাবার মৃত্যু পর্যন্ত আমি আমার দিদির সঙ্গে ছিলাম।
ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থাকা আমার জন্য সহজ ছিল কিন্তু কিছুদিন বিশ্রামের পর আমি আবার আমার কার্যভারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা বোধ করেছিলাম। শত হলেও, যিহোবার সংগঠন কি আমাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেনি? তাই, আবার অগ্রগামীর কাজ করার জন্য নিজের পয়সা খরচ করে ১৯৭২ সালে আমি সাইপ্রাসে ফিরে গিয়েছিলাম।
পরের বছরের জন্য একটা সম্মেলনের ব্যবস্থা করতে ভাই নেথেন এইচ. নর এখানে এসেছিলেন। আমি ফিরে এসেছি দেখে তিনি আমাকে সমস্ত দ্বীপের জন্য সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করেন, যে-সুযোগটা আমি প্রায় চার বছর ধরে উপভোগ করেছিলাম। এটা খুবই সাহসের এক কাজ ছিল কারণ এই কাজে বেশির ভাগ সময়ই গ্রিক ভাষায় কথা বলতে হতো।
অসুবিধার সময়
আমি সাইপ্রাসের উত্তর উপকূলবর্তী কাইরিনিয়া থেকে একটু পূর্ব দিকে কারাকুমি গ্রামে সাইপ্রাসের একজন গ্রিক-ভাষী সাক্ষি, পল আন্দ্রেয়ুর সঙ্গে একটা বাড়িতে থেকেছিলাম। সাইপ্রাস শাখা অফিস ছিল কাইরিনিয়া পর্বতমালার দক্ষিণে নিকোসিয়ায়। ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে, রাষ্ট্রপতি ম্যাক্যারিয়োসকে উৎখাত করার জন্য যে-আন্দোলন চলছিল, সেই সময় আমি নিকোসিয়ায় ছিলাম আর আমি তার বাসভবনকে আগুনে পুড়ে ছাই হতে দেখেছিলাম। পরিস্থিতি যখন কিছুটা শান্ত হয়, তখন আমি তাড়াতাড়ি কাইরিনিয়ায় চলে যাই, যেখানে আমরা এক সীমা অধিবেশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দুদিন পর, আমি পোতাশ্রয়ে প্রথম বোমা পড়ার শব্দ পাই আর দেখি যে, আকাশ হেলিকপ্টারে ছেয়ে গেছে যেগুলো তুরস্ক থেকে আক্রমণকারী সেনাবাহিনীকে আনছিল।
আমি ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় তুরস্কের সৈন্যরা আমাকে নিকোসিয়ার সীমান্তে নিয়ে যায় আর সেখানে রাষ্ট্রসংঘের কর্মকর্তারা আমাকে জেরা করেন, যারা শাখা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। এরপর আমি এক বিপদজনক কাজের মুখোমুখি হই আর আমাকে বসতি নেই এমন এলাকার উলটো দিকে জনশূন্য বাড়িগুলোতে যাওয়ার জন্য জট পাকিয়ে থাকা টেলিফোন ও বৈদ্যুতিক তারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল। যিহোবা ঈশ্বরের সঙ্গে আমার যোগাযোগের পথে কখনও বাধা দিতে পারেনি বলে আমি কত খুশিই না ছিলাম! প্রার্থনা আমাকে জীবনের সবচেয়ে হতাশাজনক অভিজ্ঞতার মধ্যেও শক্তি জুগিয়েছিল।
আমি আমার সমস্ত জিনিসপত্র খুইয়েছিলাম কিন্তু শাখা অফিসের নিরাপত্তা আমার সঙ্গে ছিল বলে আমি খুশি ছিলাম। কিন্তু, এই পরিস্থিতি খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে আক্রমণকারী সেনাবাহিনী দ্বীপের উত্তরাঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। বেথেল খালি করে দিতে হয়েছিল এবং আমরা লিমাসলে চলে গিয়েছিলাম। গণ্ডগোলের কারণে বাড়িঘর হারানো ৩০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত ভাইদের দেখাশোনা করার জন্য গঠিত একটা কমিটির সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি খুশি ছিলাম।
কার্যভারে আরও পরিবর্তন
১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালক গোষ্ঠী আমাকে এথেন্সের বেথেল পরিবারের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য গ্রিসে যেতে বলেন কিন্তু সেই বছরের শেষের দিকে আমি আবার সাইপ্রাসে ফিরে যাই এবং আমাকে শাখা কমিটি কোঅর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সাইপ্রাসের অধিবাসী আন্দ্রিয়াস কন্দয়রগিস ও তার স্ত্রী মারোকে লন্ডন থেকে পাঠানো হয়েছিল আর তারা আমার জন্য “সান্ত্বনাজনক” হয়েছিলেন।—কলসীয় ৪:১১.
১৯৮৪ সালে থিওডোর জারাসের জোন ভিজিটের শেষে, আমি পরিচালক গোষ্ঠীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল: “ভাই জারাসের পরিদর্শন শেষ হয়ে গেলে আমরা চাই যে, আপনি ভাই জারাসের সঙ্গে গ্রিসে যান।” কোন কারণ জানানো হয়নি কিন্তু আমরা যখন গ্রিসে পৌঁছেছিলাম, তখন পরিচালক গোষ্ঠীর কাছ থেকে পাওয়া আরেকটা চিঠি সেখানকার শাখা কমিটির কাছে পড়া হয় আর তাতে আমাকে ওই দেশের শাখা কমিটি কোঅর্ডিনেটর নিয়োগ করা হয়।
এর মধ্যে গ্রিসে ধর্মভ্রষ্টতা উপস্থিত হয়েছিল। এ ছাড়া সেখানে বেআইনিভাবে ধর্মান্তরিতকরণের অনেক অভিযোগও ছিল। প্রতিদিন যিহোবার লোকেদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল এবং আদালতে হাজির করা হচ্ছিল। পরীক্ষার সময় ধৈর্য ধরে *
যে-ভাইবোনেরা তাদের আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন, তাদেরকে জানা কত অদ্বিতীয় এক সুযোগ ছিল! তাদের কয়েকজনের মামলার পরে মানবাধিকারের ইউরোপীয় আদালতে শুনানি হয়েছিল ও চমৎকার ফল আসার জন্য সেগুলো গ্রিসের প্রচার কাজের ওপর এক ভাল ছাপ ফেলেছিল।গ্রিসে সেবা করার সময় আমি এথেন্স, থেসালোনিকিয়া এবং রোডস্ ও ক্রীট দ্বীপে সম্মেলনগুলোতে যোগ দিতে পেরেছিলাম যেগুলো এখন স্মরণে রয়েছে। সেই চারটে বছর ছিল আনন্দে ভরা ও ফলপ্রসূ কিন্তু আরেকটা পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছিল আর তা হল ১৯৮৮ সালে আমি আবার সাইপ্রাসে ফিরে গিয়েছিলাম।
সাইপ্রাসে এবং আবারও গ্রিসে
আমি যখন সাইপ্রাসে ছিলাম না, তখন ভাইয়েরা নিকোসিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নিসোতে নতুন শাখা অফিস তৈরি করেন আর ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় থেকে ভাই ক্যারি বারবার উৎসর্গীকরণ বক্তৃতা দেন। দ্বীপের পরিস্থিতি অনেকটা স্থায়ী হয়ে গেছে এবং আবারও ফিরে আসতে পেরে আমি খুশি হয়েছি কিন্তু এই পরিস্থিতি খুব বেশি দিন স্থায়ী ছিল না।
পরিচালক গোষ্ঠী গ্রিসের এথেন্স থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে এক নতুন বেথেল বানানোর পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছিলেন। যেহেতু আমি ইংরেজি ও গ্রিক দুভাষাতেই কথা বলতে পারতাম, তাই আমাকে ১৯৯০ সালে নতুন বিল্ডিং তৈরির জায়গায় একজন অনুবাদক হিসেবে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, যাতে ওখানে যে-আন্তর্জাতিক দাসেরা কাজ করছিলেন সেই পরিবারের জন্য আমি অনুবাদ করতে পারি। গরমের সময় ভোর ছটায় নির্মাণ স্থলে থাকার আনন্দের কথা আমার এখনও মনে রয়েছে, যখন আমি গ্রিক-ভাষী ভাইবোন যারা বিল্ডিং নির্মাণকারী পরিবারের সঙ্গে স্বেচ্ছায় কাজ করছিলেন তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতাম! তাদের আনন্দ ও উদ্যোগের সুন্দর স্মৃতিগুলো সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে।
গ্রিক অর্থোডক্স যাজক ও তাদের সমর্থকরা নির্মাণ স্থলে ঢোকার চেষ্টা করে আমাদের কাজে বাধা দিতে চেয়েছিল কিন্তু যিহোবা আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন ও আমরা রক্ষা পেয়েছি। ১৯৯১ সালের ১৩ই এপ্রিল নতুন বেথেলের উৎসর্গীকরণের সময় আমি সেখানে ছিলাম।
আমার প্রিয় দিদিকে সাহায্য করা
পরের বছর, আমি ছুটিতে ইংল্যান্ড গিয়ে দিদি ও দাদাবাবুর সঙ্গে থাকি। দুঃখের বিষয় যে, সেখানে থাকার সময় দাদাবাবুর দুবার হার্ট আ্যটাক হয় ও শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান। আমি মিশনারি হিসেবে সেবা করার সময় জোন আমাকে উদারভাবে সমর্থন করেছে। এমন একটা সপ্তাও ছিল না যে, সে আমাকে উৎসাহ দিয়ে চিঠি লেখেনি। যে-কোন মিশনারির জন্য এইরকম যোগাযোগ কত বড় আশীর্বাদ! এখন সে একজন বিধবা, তার শরীর ভেঙে পড়েছে ও তার সাহায্যের দরকার। আমার কী করা উচিত?
জোনের মেয়ে থেলমা ও তার স্বামী ইতিমধ্যেই তাদের মণ্ডলীর আরেকজন বিশ্বস্ত বিধবা, যে আমাদেরই একজন আত্মীয় ও খুব অসুস্থ, তার দেখাশোনা করছে। তাই, অনেক প্রার্থনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, জোনকে দেখাশোনা করার জন্য আমি তার সঙ্গেই থাকব। রদবদল করা এত সহজ ছিল না কিন্তু ইয়ভিলে দুটো মণ্ডলীর একটা পেন মিল মণ্ডলীতে সেবা করতে পারার সুযোগ পেয়ে আমি খুশি।
বিদেশে যে ভাইদের সঙ্গে আমি সেবা করেছি, তারা টেলিফোনে ও চিঠি দিয়ে নিয়মিত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন আর এর জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আমি জানি যে, আমি যদি কখনও গ্রিস বা সাইপ্রাসে যেতে চাই, তা হলে ভাইয়েরা সঙ্গে সঙ্গে আমার জন্য টিকিট পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু আমার বয়স এখন ৮০ বছর আর আমার স্বাস্থ্য বা চোখের অবস্থা আগের মতো নেই। আগের মতো সক্রিয় হতে না পারা খুবই দুঃখজনক কিন্তু বেথেল পরিচর্যায় বেশ কিছু বছর থাকার জন্য আমি এমন অনেক অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য পেয়েছি, যা আজও আমার জন্য উপকারজনক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি সবসময় সকালের নাস্তার আগে দৈনিক শাস্ত্রপদ পড়ি। এ ছাড়া আমি লোকেদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ও তাদের ভালবাসতে শিখেছি, যা মিশনারি পরিচর্যায় সাফল্যের চাবি।
যিহোবার প্রশংসায় প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি চমৎকার বছরগুলোর দিকে যখন আমি ফিরে তাকাই, তখন আমি জানি যে, পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা হল সবচেয়ে বড় সুরক্ষা আর তা সবচেয়ে ভাল শিক্ষা প্রদান করে। যিহোবার উদ্দেশে বলা দায়ূদের কথাগুলো আমি পূর্ণ-হৃদয়ে প্রতিধ্বনি করি: “তুমি হইয়াছ আমার পক্ষে উচ্চদুর্গ, আমার সঙ্কটের দিনে আশ্রয়।”—গীতসংহিতা ৫৯:১৬.
[পাদটীকাগুলো]
^ জন উইনের জীবন কাহিনী “আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে,” ১৯৯৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রহরীদুর্গ এর ২৫-৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে।
^ আগে সান্ত্বনা নামে পরিচিত ছিল।
^ ১৯৯৮ সালের ১লা ডিসেম্বর প্রহরীদুর্গ এর ২০-১ পৃষ্ঠা এবং ১৯৯৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) এর ২৭-৩১ পৃষ্ঠা; ১৯৯৮ সালের ৮ই জানুয়ারি সচেতন থাক! (ইংরেজি) এর ২১-২ পৃষ্ঠা এবং ১৯৯৭ সালের ২২শে মার্চ সচেতন থাক! (ইংরেজি) এর ১৪-১৫ পৃষ্ঠা দেখুন।
[২৪ পৃষ্ঠার মানচিত্রগুলো]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
গ্রিস
সাইপ্রাস
ফামাগুসটা
লিমাসল
কাইরিনিয়া
নিকোসিয়া
এথেন্স
[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯১৫ সালে মা
[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৪৬ সালে গিলিয়েডের অষ্টম ক্লাসের অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে আমি (বাঁদিক থেকে চতুর্থ) ব্রুকলিন বেথেলের ছাদে
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রথমবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর মিলি মাসির সঙ্গে