আমাদের সারা পৃথিবীর ভ্রাতৃসমাজের দ্বারা শক্তিপ্রাপ্ত
জীবন কাহিনী
আমাদের সারা পৃথিবীর ভ্রাতৃসমাজের দ্বারা শক্তিপ্রাপ্ত
বলেছেন থমসন কাংগালি
১৯৯৩ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে আমাকে জাম্বিয়া লুসাকায় ১৩টা বিল্ডিংয়ের নতুন শাখা অফিস উৎসর্গ কার্যক্রমে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যেহেতু আমার হাঁটতে কষ্ট হতো, তাই যে-খ্রীষ্টীয় বোন আমাদের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন তিনি সদয়ভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কি চান আমি আপনার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে যাই যাতে মাঝে মাঝে আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন?” আমি কালো চামড়ার লোক আর তিনি সাদা চামড়ার অথচ সেটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। গভীরভাবে মুগ্ধ হয়ে, আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, কারণ তার সদয় ব্যবহারের জন্য আমার পক্ষে শাখার সবকিছু ঘুরে দেখা সম্ভব হয়েছিল।
বছরের পর বছর ধরে, এইরকম অভিজ্ঞতাগুলো আমার হৃদয়কে উষ্ণ করেছিল, আমার বিশ্বাসকে আবারও এই নিশ্চয়তায় ভরিয়ে দিয়েছিল যে, যিহোবার সাক্ষিদের খ্রীষ্টীয় মেলামেশার মধ্যে সেই প্রেম বিরাজ করে যেটার বিষয়ে খ্রীষ্ট বলেছিলেন যে, সেটাই তাঁর প্রকৃত অনুগামীদের শনাক্ত করবে। (যোহন ১৩:৩৫; ১ পিতর ২:১৭) আসুন আপনাদের আমি বলি যে, ১৯৩১ সালে কীভাবে এই খ্রীষ্টানদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, যে-বছরে তারা বাইবেল-ভিত্তিক নাম যিহোবার সাক্ষি বলে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছার কথা সকলের সামনে ঘোষণা করেছিলেন।—যিশাইয় ৪৩:১২.
আফ্রিকায় প্রথম পরিচর্যা
১৯৩১ সালের নভেম্বর মাসে, আমার বয়স ছিল ২২ বছর আর তখন আমি উত্তর রোডিশার (এখন জাম্বিয়া) কপারবেল্ট অঞ্চলে অবস্থিত কিটয়েতে থাকতাম। একজন বন্ধু যার সঙ্গে আমি ফুটবল খেলতাম সে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে আমাকে * (ইংরেজি) বাইবেল সহায়ক বইটার জন্য অনুরোধ জানাই। বইটা ইংরেজিতে ছিল বলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল, কারণ আমি ইংরেজি ভাষা খুব ভাল জানতাম না।
পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আমি তাদের কয়েকটা সভায় যোগদান করি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের শাখা অফিসে ঈশ্বরের বীণালেক ব্যাংয়ুইউলুর দক্ষিণপশ্চিম থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরে কপারবেল্ট অঞ্চল অবস্থিত, যার কাছেই আমি বড় হয়েছিলাম ও যেখানে অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকেই তামার খনিতে কাজ করতে আসত। সাক্ষিদের বেশ কয়েকটা দল বাইবেল অধ্যয়নের জন্য নিয়মিত সেখানে মিলিত হতেন। কিছুদিন পরে, আমি কিটয়ে থেকে নিকটবর্তী শহর ইনডোলাতে চলে যাই এবং সেখানকার সাক্ষিদের একটা দলের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করি। সেই সময়, আমি প্রিন্স অফ ওয়েলস নামক এক ফুটবল দলের নেতা ছিলাম। এ ছাড়া, আমি আফ্রিকান লেকস্ করপোরেশন এর একজন সাদা চামড়ার ম্যানেজারের গৃহভৃত্য হিসেবে কাজ করি, যে-কোম্পানির আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটা দোকান ছিল।
আমি ততটা পড়ালেখা করিনি আর যে-সামান্য ইংরেজি জানতাম তা আমি ইউরোপীয়দের কাছ থেকে শিখেছিলাম, যাদের জন্য আমি কাজ করতাম। তবুও, আমি আরও পড়ালেখা করতে চেয়েছিলাম আর তাই দক্ষিণ রোডিশার (এখন জিম্বাবোয়ে) প্লামট্রির একটা স্কুলে পড়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু, এর মধ্যে আমি কেপ টাউন শাখায় দ্বিতীয়বার চিঠি লিখি। আমি তাদের জানাই যে, আমি ঈশ্বরের বীণা বইটা পেয়েছি আর যিহোবাকে পূর্ণ-সময় সেবা করতে চাই।
তাদের উত্তর পেয়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যেখানে বলা ছিল: “যিহোবাকে সেবা করার জন্য আপনি যে-ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তার জন্য আমরা আপনার প্রশংসা করি। এই বিষয়ে প্রার্থনা করার জন্য আমরা আপনাকে উৎসাহ দিচ্ছি এবং যিহোবা আপনাকে আরও ভাল করে সত্য বুঝতে সাহায্য করবেন ও সেইসঙ্গে তাঁকে সেবা করার জন্য তিনি আপনাকে একটা জায়গা খুঁজে দেবেন।” অনেকবার চিঠিটা পড়ার পর, আমি বেশ কিছু সাক্ষিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আমার কী করা উচিত। তারা বলেছিলেন: “সত্যিই যদি আপনি যিহোবাকে সেবা করতে চান, তা হলে এগিয়ে যান এবং এখনই তা শুরু করুন।”
এক সপ্তাহ ধরে, আমি এই বিষয়ে প্রার্থনা করি এবং শেষে পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই ও সাক্ষিদের সঙ্গে নিয়মিত বাইবেল অধ্যয়ন চালিয়ে যাই। পরের বছর, ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে, যিহোবা ঈশ্বরের কাছে আমার উৎসর্গীকরণের চিহ্ন হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নিই। ইনডোলের কাছাকাছি শহর লুয়ানশায় চলে যাওয়ার পর, জ্যানেট নামে একজন সহ বিশ্বাসীর সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং ১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা বিয়ে করি। আমাদের যখন বিয়ে হয়, তখন ইতিমধ্যেই জ্যানেটের একটা ছেলে ও একটা মেয়ে ছিল।
ধীরে ধীরে, আমি আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে থাকি এবং ১৯৩৭ সালে আমি পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা শুরু করি। এর অল্প কিছুদিন পরে, আমাকে একজন ভ্রমণ পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, এখন যাকে সীমা অধ্যক্ষ বলা হয়। মণ্ডলীগুলোকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য ভ্রমণ অধ্যক্ষরা সেগুলো পরিদর্শন করেন।
প্রথমদিকের বছরগুলোতে প্রচার
১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে, আমাকে সোকোনটুয়ি নামে একজন আফ্রিকান নেতার সঙ্গে দেখা করতে যেতে বলা হয়, যিনি যিহোবার সাক্ষিদের তার সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিন দিন একটা সাইকেলে চড়ে আমি তার এলাকায় পৌঁছাই। আমি যখন তাকে জানাই যে, আমাদের কেপ টাউন অফিসে তার পাঠানো চিঠির উত্তর হিসেবে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে, তখন তিনি খুবই কৃতজ্ঞ হন।
আমি তার লোকেদের প্রত্যেকটা ঘরে যাই এবং তাদের ইনসাকাতে (জনসাধারণের জন্য তৈরি জায়গা) আসতে আমন্ত্রণ জানাই। তারা যখন সমবেত হয়, তখন আমি জনতার সামনে কথা বলি। ফলে, অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু হয়। গ্রামের নেতা এবং তার ক্লার্ক সবচেয়ে প্রথমে সেখানকার মণ্ডলীগুলোর অধ্যক্ষ হন। আজকে সেই অঞ্চলে, ৫০টারও বেশি মণ্ডলী রয়েছে, যেগুলো এখন সামফিয়া জেলা বলে পরিচিত।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, আমি লেক ব্যাংয়ুইউলু অঞ্চলের চারপাশে কাজ করি। প্রত্যেক মণ্ডলীর সঙ্গে আমি দশ দিন করে কাটাই। যেহেতু সেই সময় খুব কম লোকই আধ্যাত্মিক শস্যছেদনের কাজে রত ছিলেন, তাই আমরা ঠিক আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের মতো মনে করেছিলাম যখন তিনি বলেছিলেন: “শস্য প্রচুর বটে, কিন্তু কার্য্যকারী লোক অল্প; অতএব শস্যক্ষেত্রের স্বামীর নিকটে প্রার্থনা কর, যেন তিনি নিজ শস্যক্ষেত্রে কার্য্যকারী লোক পাঠাইয়া দেন।” (মথি ৯:৩৬-৩৮) সেই দিনগুলোতে, ভ্রমণের কাজ কঠিন ছিল, তাই আমি যখন মণ্ডলীগুলোতে পরিদর্শন করতাম, তখন জ্যানেট সাধারণত ছেলেমেয়ের সঙ্গে লুয়ানশাতে থেকে যেত। সেই সময়ের মধ্যে জ্যানেট ও আমার আরও দুটো সন্তান হয় কিন্তু এদের একজন দশ মাস বয়সেই মারা যায়।
সেই সময় গাড়িঘোড়া খুব কম ছিল আর স্বাভাবিকভাবেই রাস্তাঘাটও তেমন বেশি ছিল না। একদিন, জ্যানেটের সাইকেলে চড়ে আমি ২০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিই। কখনও কখনও, আমাকে যখন কোন নদী পার হতে হতো, তখন আমি সাইকেলটাকে আমার কাঁধে তুলে নিয়ে এক হাতে সেটা ধরে রাখতাম আর অন্য হাত দিয়ে সাঁতার কেটে নদী পার হতাম। হঠাৎ, লুয়ানশায়াতে সাক্ষিদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় আর ১৯৪৬ সালে খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক সভায় ১,৮৫০ জন উপস্থিত হয়।
আমাদের কাজ বিরোধিতার মুখোমুখি হয়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার, কায়াম্বওয়ার জেলা কমিশনার আমাকে ডেকে বলেছিলেন: “আমি চাই যে, আপনি ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির বইপত্র ব্যবহার করা বন্ধ করুন কারণ সেগুলোর ওপর এখন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আমি আপনাকে কিছু বইপত্র দিতে পারি যেগুলো আপনি আপনার কাজে ব্যবহারের জন্য অন্যান্য বই লিখতে কাজে লাগাতে পারেন।”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘আমার কাছে যে-সাহিত্য রয়েছে তাতে আমি সন্তুষ্ট। আমার আর কিছু দরকার নেই।’
তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি আমেরিকার লোকেদের জানেন না (আমাদের সাহিত্য সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছাপানো হতো)। তারা আপনাকে ভুল পথে নিয়ে যাবে।’
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “না, যাদের সঙ্গে আমি মেলামেশা করি, তারা সেরকম নন।”
এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন: “যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য আপনি কি আপনার মণ্ডলীগুলোকে আর্থিক দান দিতে উৎসাহিত করতে পারেন না, যেমন অন্যান্য ধর্মের লোকেরা করছে?”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “সেটা সরকারের দূতেদের কাজ।”
তিনি বলেছিলেন, “আপনি বাড়ি গিয়ে এই বিষয়ে চিন্তা করুন না কেন?”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “যাত্রাপুস্তক ২০:১৩ এবং ২ তীমথিয় ২:২৪ পদে বাইবেল আমাদের নরহত্যা ও যুদ্ধ না করতে আদেশ দেয়।”
যদিও আমাকে যেতে বলা হয়েছিল কিন্তু পরে ফোর্ট রোজবেরির জেলা কমিশনার আমাকে ডেকে পাঠান, যে-শহরকে এখন মানসা বলা হয়। তিনি বলেছিলেন, “আমি আপনাকে এটা জানানোর জন্য এখানে ডেকে পাঠিয়েছি যে, সরকার আপনাদের বইপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।”
আমি বলেছিলাম, “হ্যাঁ। আমি এই বিষয়ে শুনেছি।”
“তাই আপনার সমস্ত মণ্ডলীতে গিয়ে সেখানে যে-লোকেদের সঙ্গে আপনি উপাসনা করেন, তাদের সমস্ত বইপত্র এখানে নিয়ে আসতে বলা উচিত। বুঝেছেন তো?”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘সেটা আমার কাজ নয়। এটা সরকারের দূতেদের কাজ।’
আকস্মিক সাক্ষাৎ ফল উৎপাদন করে
যুদ্ধের পর, আমরা ঠিকমতো প্রচার চালিয়ে যাই। ১৯৪৭ সালে, আমি সবেমাত্র মাওয়ানজা গ্রামের একটা মণ্ডলীতে কাজ করা শেষ করে কোথায় এক কাপ চা পাওয়া যেতে পারে তার খোঁজ করছিলাম। আমাকে মি. নোকোনডির বাড়িতে যেতে বলা
হয়, যেখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। মি. নোকোনডি ও তার স্ত্রী আন্তরিকভাবে আমাকে অভ্যর্থনা জানান। মি. নোকোনডিকে আমি জিজ্ঞেস করি যে, আমি চা খাওয়ার সময় তিনি “ঈশ্বর যেন সত্য হন” (ইংরেজি) বইয়ের “নরক, আশা সহ বিশ্রামের এক স্থান” অধ্যায়টা পড়তে চান কি না।“তা হলে নরক বলতে আপনি কী বোঝেন?” চা খাওয়া শেষ করে আমি জিজ্ঞেস করি। তিনি যা পড়েছিলেন, তাতে অভিভূত হয়ে তিনি সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন আরম্ভ করেন এবং পরে তিনি ও সেইসঙ্গে তার স্ত্রী বাপ্তিস্ম নেন। যদিও শেষে তিনি আর সাক্ষি ছিলেন না কিন্তু তার স্ত্রী ও কয়েকজন ছেলেমেয়ে সাক্ষি ছিলেন। আসলে, তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একজন পিলনি জাম্বিয়াতে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে এখনও সেবা করছেন। আর যদিও পিলনির মার এখন অনেক বয়স হয়েছে, তবুও এখনও তিনি একজন বিশ্বস্ত সাক্ষি।
পূর্ব আফ্রিকার এক অভিজ্ঞতা
উত্তর রোডিশায় আমাদের শাখা অফিস, যেটা ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে লুসাকায় স্থাপিত হয়েছিল, আমাকে তানজানাইকাতে (এখন তানজানিয়া) কাজ করতে বলে। আরেকজন সাক্ষি পাহাড়ি এলাকা জুড়ে পায়ে হাঁটা পথে আমাদের সঙ্গী হন। এই যাত্রায় তিন দিন লেগে গিয়েছিল আর তা খুবই ক্লান্তিকর ছিল। আমি যখন গোছা গোছা বই বয়ে নিয়ে যেতাম, তখন আমার স্ত্রী আমাদের কাপড়চোপড় বয়ে নিয়ে যেত আর অন্য সাক্ষি আমাদের বিছানাপত্র বয়ে নিয়ে যেতেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে, আমরা যখন এমবিয়ায় এসে পৌঁছাই, তখন বাইবেলের শিক্ষাগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে চলতে বিভিন্ন রদবদল করতে ভাইদের সাহায্য করার জন্য সেখানে অনেক কিছু করার ছিল। একটা বিষয় ছিল যে, আমরা সেই অঞ্চলে ওয়াচটাওয়ার লোক বলে পরিচিত ছিলাম। যদিও ভাইয়েরা যিহোবার সাক্ষি নাম গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু জনসাধারণ্যে সেটাকে ব্যবহার করা হতো না। এ ছাড়া, কোন কোন সাক্ষির মৃতদের সম্মান করার সঙ্গে জড়িত কিছু প্রথা ত্যাগ করার দরকার হয়েছিল। কিন্তু, সম্ভবত অনেককেই সবচেয়ে যে-কঠিন রদবদলটা করতে হয়েছিল সেটা ছিল তাদের বিবাহকে আইনগতভাবে রেজিস্ট্রি করা, সকলের সামনে সেগুলোকে সম্মানীয় করা।—ইব্রীয় ১৩:৪.
পরে, উগান্ডা সহ পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য জায়গাগুলোতে আমার পরিচর্যা করার সুযোগ হয়েছিল। আমি এনটেবি ও কামপালায় প্রায় ছয় সপ্তাহ কাটাই, যেখানে অনেককেই বাইবেলের সত্য জানতে সাহায্য করা হয়েছিল।
নিউ ইয়র্ক সিটিতে আমন্ত্রণ
উগান্ডাতে কিছুদিন পরিচর্যা করার পর, ১৯৫৬ সালের প্রথম দিকে আমি টাংগেনইকার রাজধানী ডার এস সালেমে এসে পৌঁছাই। সেখানে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় থেকে একটা চিঠি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এই চিঠিতে, ১৯৫৮ সালের ২৭শে জুলাই থেকে ৩রা আগস্ট পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে যে-আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমি সেই প্রত্যাশায় রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
যখন সময় আসে, তখন আমি ও আরেকজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ লুকা মাওয়াংগো প্লেনে করে দক্ষিণ রোডিশার ইনডোলা থেকে সোলবেরি (এখন হারারি) এবং এরপর কেনিয়ার নাইরোবিতে যাই। সেখান থেকে প্লেনে করে আমরা ইংল্যান্ডের লন্ডনে পাড়ি দিই আর আমাদেরকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়। যে-রাতে আমরা ইংল্যান্ডে পৌঁছাই সেই রাতে যখন আমরা ঘুমাতে যাই, তখন আমরা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম এবং কীভাবে আমাদের মতো আফ্রিকানদের, সাদা চামড়ার লোকেরা এত আতিথেয়তা দেখিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আলোচনা করে চলেছিলাম। এই অভিজ্ঞতার দ্বারা আমরা অনেক উৎসাহ পেয়েছিলাম।
শেষে, আমরা নিউ ইয়র্কে পৌঁছাই, যেখানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনের একটা দিনে, আমি উত্তর রোডিশার যিহোবার
সাক্ষিদের কাজ সম্বন্ধে রিপোর্ট দিয়েছিলাম। সেইদিন নিউ ইয়র্ক সিটির পোলো গ্রাউন্ড ও ইয়াংকি স্টেডিয়ামে প্রায় ২,০০,০০০ জন সমবেত হয়েছিলেন। যে-অপূর্ব সুযোগ আমি উপভোগ করেছিলাম, সেই কথা ভেবে সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।খুব শীঘ্রই সম্মেলন শেষ হয়ে যায় এবং আমরা বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি ফেরার পথে, আমরা আবারও ইংল্যান্ডে আমাদের ভাইবোনদের প্রেমময় আতিথেয়তা উপভোগ করি। জাতি, বংশ নির্বিশেষে যিহোবার লোকেদের একতা ভোলার নয়, যা তারা সেই সময় আমাদের দেখিয়েছিলেন!
সেবা করে চলা ও পরীক্ষাগুলো
১৯৬৭ সালে, আমাকে একজন জেলা দাস অর্থাৎ সীমা থেকে সীমায় ভ্রমণ করেন এমন একজন পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেই সময় জাম্বিয়াতে সাক্ষিদের সংখ্যা বেড়ে ৩৫,০০০ এর বেশি হয়েছিল। পরে, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায়, আমাকে আবারও কপারবেল্টে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। শেষে, জ্যানেট অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে মারা যায়।
তার মৃত্যুর পর, আমার অবিশ্বাসী শ্বশুর বাড়ির লোকেরা জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে জ্যানেটের মৃত্যুর জন্য যখন আমাকে দোষারোপ করে, তখন আমি সাংঘাতিকভাবে আঘাত পাই। কিন্তু কেউ কেউ যারা জ্যানেটের অসুস্থতা সম্বন্ধে জানতেন এবং তার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তারা এই ব্যাপারে সত্য বিষয়টা এই আত্মীয়দের জানান। এরপর আরেকটা পরীক্ষা আসে। কিছু আত্মীয়স্বজন চেয়েছিল আমি যেন পরম্পরাগত প্রথা যেটাকে উকুপাইয়ানিকা বলা হয় সেটা মেনে চলি। যে-অঞ্চল থেকে আমি আসি সেই অঞ্চলে এই প্রথার মানে হল যে, যখন বিবাহ সাথী মারা যায়, তখন তার জীবিত সাথীকে মৃতের কোন নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করতে হবে। অবশ্যই, আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
শেষে, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে চাপের অবসান হয়। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম যে, দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে যিহোবা আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার স্ত্রীকে কবর দেওয়ার এক মাস পর, একজন ভাই আমার কাছে এসে বলেছিলেন: “ভাই কাংগালি, আপনার স্ত্রীর মৃত্যুতে আপনার পদক্ষেপ আমাদের সত্যিই অনেক উৎসাহ দিয়েছে, কারণ আপনি কোন অশাস্ত্রীয় প্রথার কাছে নতি স্বীকার করেননি। আমরা আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
এক অপূর্ব শস্যছেদন
একজন যিহোবার সাক্ষি হিসেবে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা শুরু করার পর ৬৫ বছর কেটে গেছে। এই বছরগুলোতে শত শত মণ্ডলী গড়ে উঠতে দেখা এবং যে-এলাকাগুলোতে আমি একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে এক সময় কাজ করেছিলাম সেই এলাকাগুলোতে অনেক কিংডম হল তৈরি হতে দেখা কতই না আনন্দের! ১৯৪৩ সালে যেখানে প্রায় ২,৮০০ জন সাক্ষি ছিলেন এখন তা বেড়ে জাম্বিয়াতে আমাদের রাজ্য ঘোষণাকারীদের সংখ্যা হয়েছে ১,২২,০০০ এরও বেশি। সত্যিই, গত বছর এই দেশে স্মরণার্থক সভায় উপস্থিতি সংখ্যা ছিল ৫,১৪,০০০ জন, যার জনসংখ্যা ১ কোটি ১০ লক্ষের চেয়ে কিছু কম ছিল।
এর মধ্যে দিয়ে যিহোবা আমার ভাল যত্ন নেন। আমার যখন চিকিৎসার দরকার হয়, একজন খ্রীষ্টান ভাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। বিভিন্ন মণ্ডলী এখনও আমাকে জনসাধারণের বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান আর এটা আমাকে অনেক গঠনমূলক মুহূর্ত দান করে। যে-মণ্ডলীর সঙ্গে আমি মেলামেশা করি, সেই মণ্ডলী আমার ঘর পরিষ্কার করার জন্য পালা করে বোনদের ব্যবস্থা করে এবং প্রত্যেক সপ্তাহে ভাইয়েরা আমাকে তাদের সঙ্গে সভাগুলোতে নিয়ে আসেন। আমি জানি আমি যদি যিহোবার সেবা না করতাম, তা হলে কখনও এমন প্রেমময় যত্ন পেতাম না। আমাকে পূর্ণ-সময়ের পরিচারকের কাজে ব্যবহার করে যাওয়ার এবং এখনও যে-বহু সুযোগ আমি বহন করছি তার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
আমার দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে আর আমি যখন হেঁটে কিংডম হলে যাই, তখন যাওয়ার পথে আমাকে বেশ কয়েকবার থামতে হয়। এখন বইয়ের ব্যাগ আমার কাছে খুব ভারী বলে মনে হয়, তাই সভায় যে-বইগুলোর হয়তো দরকার নেই সেগুলো না নিয়ে আমি এটাকে হালকা করি। যারা আমার বাড়িতে আসেন তাদের সঙ্গে মূলত বাইবেল অধ্যয়ন করাই হল আমার ক্ষেত্রের পরিচর্যা। তবুও, বিগত বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকানো এবং যে-অসাধারণ বৃদ্ধি ঘটেছে সে বিষয়ে চিন্তা করা কতই না আনন্দের! আমি এমন একটা ক্ষেত্রে কাজ করেছি, যেখানে যিশাইয় ৬০:২২ পদে লেখা যিহোবার কথাগুলো অসাধারণভাবে পূর্ণ হয়েছে। এটা বলে: “যে ছোট, সে সহস্র হইয়া উঠিবে, যে ক্ষুদ্র, সে বলবান্ জাতি হইয়া উঠিবে; আমি সদাপ্রভু যথাকালে ইহা সম্পন্ন করিতে সত্বর হইব।” সত্যিই, কেবল জাম্বিয়াতেই নয় কিন্তু সারা পৃথিবীতে এটা ঘটতে দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি। *
[পাদটীকাগুলো]
^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।
^ দুঃখের বিষয় যে, অবশেষে ভাই কাংগালি একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ছাপানোর জন্য এই প্রবন্ধটা প্রস্তুত করার সময় বিশ্বস্ত থেকে তিনি মারা যান।
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
জাম্বিয়া শাখার সামনে থমসন
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
আজকে জাম্বিয়া শাখা