‘আমি যিহোবাকে পরিবর্ত্তে কি ফিরাইয়া দিব?’
জীবন কাহিনী
‘আমি যিহোবাকে পরিবর্ত্তে কি ফিরাইয়া দিব?’
বলেছেন মারিয়া কেরাসিনিস
আঠারো বছর বয়সে আমি আমার বাবামার জন্য এক অপমানের পাত্র হয়ে উঠেছিলাম, পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম এবং আমার গ্রামে এক হাসিরপাত্রে পরিণত হয়েছিলাম। ঈশ্বরের প্রতি আমার নীতিনিষ্ঠাকে ভেঙে ফেলার চেষ্টায় আমাকে কাকুতিমিনতি, জোরজবরদস্তি করা ও হুমকি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সফল হয়নি। আমি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম যে, বাইবেলের সত্যের প্রতি অনুগত থাকা আধ্যাত্মিক উপকারগুলো নিয়ে আসবে। যিহোবাকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেবা করে আসার বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকালে আমি কেবল গীতরচকের কথাগুলোই প্রতিধ্বনিত করতে পারি: “আমি সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW] হইতে যে সকল মঙ্গল পাইয়াছি, তাহার পরিবর্ত্তে তাঁহাকে কি ফিরাইয়া দিব?”—গীতসংহিতা ১১৬:১২.
আমি ১৯৩০ সালে এঙ্গেলোকাসট্রো নামে এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলাম যেটা করিন্থের ইস্থ্মাসের পূর্ব দিকে, কিংক্রিয়া বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল, যেখানে প্রথম শতাব্দীতে সত্য খ্রিস্টানদের এক মণ্ডলী স্থাপিত হয়েছিল।—প্রেরিত ১৮:১৮; রোমীয় ১৬:১.
আমাদের পারিবারিক জীবন ছিল শান্তিপূর্ণ। বাবা গ্রামপ্রধান ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। পাঁচ ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। আমার বাবামা আমাদের গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার ধর্মপ্রাণ সদস্য হিসেবে বড় করে তুলেছিলেন। আমি প্রতি রবিবার মিশায় যেতাম। আমি ধর্মীয় চিত্রগুলোর সামনে প্রার্থনার মাধ্যমে আমার পাপ স্বীকার করতাম, গ্রামের বিভিন্ন চ্যাপেলে মোমবাতি জ্বালাতাম এবং সবরকমের উপবাস পালন করতাম। প্রায়ই আমি একজন নান হওয়ার কথা ভাবতাম। পরবর্তী সময়ে, পরিবারের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রথম ব্যক্তি যে বাবামাকে অসন্তুষ্ট করি।
বাইবেলের সত্যের দ্বারা রোমাঞ্চিত
আমার বয়স যখন প্রায় ১৮ বছর, তখন আমি জানতে পারি যে, পাশের গ্রামে থাকা কাটিনা যিনি হলেন আমার বড় দাদাবাবুর বোন তিনি যিহোবার সাক্ষিদের প্রকাশনাগুলো পড়েন এবং গির্জায় আর যান না। এটা আমাকে অনেক ভাবিয়ে তোলে আর এইজন্য
আমি তাকে, আমার জানা সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিই। তাই তিনি যখন আমাদের এখানে এসেছিলেন, তখন আমি তাকে নিয়ে হাঁটতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম, আসলে উদ্দেশ্য ছিল পথে যাজকের বাড়িতে থামা। যাজক যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা অভিযোগ করার দ্বারা আলোচনা শুরু করেছিলেন ও তাদেরকে ধর্মবিরোধী বলে ডেকেছিলেন, যারা কাটিনাকে ভ্রান্ত করেছে। এই আলোচনা পর পর তিন রাত ধরে চলেছিল। কাটিনা ভালভাবে প্রস্তুত করা বাইবেলের যুক্তি দিয়ে যাজকের সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করেছিলেন। অবশেষে, যাজক তাকে বলেছিলেন যে যেহেতু তিনি খুব সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মেয়ে, তাই তার উচিত নিজের যৌবনকে উপভোগ করা আর যখন তিনি বৃদ্ধ হয়ে যাবেন তখন ঈশ্বরের প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারেন।আমি সেই আলোচনা সম্বন্ধে আমার বাবামার কাছে কোনো উচ্চবাচ্য করিনি কিন্তু পরের রবিবার আমি গির্জায় যাইনি। দুপুরে যাজক সোজা আমাদের দোকানে চলে আসেন। আমি অজুহাত দেখিয়েছিলাম যে, আমার বাবাকে সাহায্য করার জন্য আমাকে দোকানে থাকতে হয়েছিল।
“সত্যিই কি এটাই কারণ, নাকি সেই মেয়ে তোমাকে প্রভাবিত করেছে?” যাজক আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
“এই লোকেদের বিশ্বাস আমাদের চাইতে উত্তম,” আমি সোজাসুজিভাবে বলেছিলাম।
আমার বাবার দিকে তাকিয়ে, যাজক বলেছিলেন: “মি. ইকোনোমোস, আপনার আত্মীয়কে যত তাড়াতাড়ি পারেন ঘর থেকে বের করে দিন; উনি-ই আপনার ঘরে আগুন লাগিয়েছেন।”
আমার পরিবার আমার বিরোধিতা করে
সময়টা ছিল ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে, যখন গ্রিসে গৃহযুদ্ধের উন্মাদনা বইছিল। গেরিলারা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে এই ভয়ে বাবা ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে আমি আমাদের গ্রাম ছেড়ে দিদির গ্রামের বাড়িতে চলে যাই, যেখানে কাটিনা থাকতেন। যে-দুমাস আমি সেখানে ছিলাম, সেই সময় আমাকে বেশ কয়েকটা বিষয় সম্বন্ধে বাইবেল যা বলে, তা বুঝতে সাহায্য করা হয়। আমি এটা দেখে খুবই নিরাশ হয়ে পড়ি যে, অর্থোডক্স গির্জার অনেক শিক্ষাই অশাস্ত্রীয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ঈশ্বর ধর্মীয় চিত্রগুলোর সাহায্যে করা উপাসনা গ্রহণ করেন না, বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি, যেমন ক্রুশের উপাসনার উৎস খ্রিস্টীয় নয় এবং ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য একজনকে “আত্মায় ও সত্যে” উপাসনা করতে হবে। (যোহন ৪:২৩; যাত্রাপুস্তক ২০:৪, ৫) সর্বোপরি আমি শিখেছিলাম যে, বাইবেল পৃথিবীতে অনন্তজীবনের উজ্জ্বল আশা দেয়! বাইবেলের এই ধরনের বহুমূল্য সত্যগুলো ছিল প্রাথমিক ব্যক্তিগত উপকার, যেগুলো আমি যিহোবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম।
ইতিমধ্যে, আমার দিদি ও তার স্বামী লক্ষ করেছিল যে, আমি খাওয়ার সময় ক্রুশের চিহ্ন করি না কিংবা এমনকি আমি ধর্মীয় চিত্রগুলোর সামনে প্রার্থনাও করি না। একদিন রাতে তারা দুজনেই আমাকে মেরেছিল। পরের দিন আমি তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আর আমি আমার মাসির বাড়িতে চলে যাই। আমার দাদাবাবু এই কথা আমার বাবাকে জানান। খুব শীঘ্রই বাবা কাঁদতে কাঁদতে আসেন ও আমার মন পালটানোর চেষ্টা করেন। আমার দাদাবাবু আমার সামনে হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন আর আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। বিষয়টা মিটমাট করার জন্য, তারা আমাকে আবার গির্জায় ফিরে আসতে বলে কিন্তু আমি অটল ছিলাম।
বাবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরও বিভিন্ন চাপ আসতেই থাকে। কাটিনার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার কোনো উপায়ই আমার ছিল না এবং আমার কাছে পড়ার মতো কোনো প্রকাশনা, এমনকি একটা বাইবেলও ছিল না। আমি খুব আনন্দিত হই যখন আমার একজন জেঠতুতো বোন আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। সে যখন করিন্থে যায়, তখন সেখানে সে একজন সাক্ষির দেখা পায় এবং “ঈশ্বর যেন সত্য হোন” (ইংরেজি) বইটি ও খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রের একটা কপি সঙ্গে করে নিয়ে আসে, যেগুলো আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম।
জীবনে এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটে
তিন বছর ধরে প্রচণ্ড বিরোধিতা আসতেই থাকে। কোনো সাক্ষির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না আর এমনকি আমি কোনো প্রকাশনাও পেতাম না। কিন্তু, আমার অজান্তে আমার জীবনকে ঘিরে কিছু বিরাট পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছিল।
বাবা আমাকে বলেছিলেন যে, থিষলনীকীতে আমার মামার বাড়িতে আমাকে যেতে হবে। থিষলনীকীতে যাওয়ার আগে, আমি একটা কোট তৈরি করানোর জন্য করিন্থে একটা দরজির দোকানে যাই। সেখানে কাটিনাকে কাজ করতে দেখে আমি কত আশ্চর্যই না হয়েছিলাম! এত দিন পরে পরস্পরকে দেখে আমরা দুজনেই খুব খুশি হয়েছিলাম। আমরা দুজনে যখন সেই দোকান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এক হাসিখুশি যুবকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যে সাইকেলে করে কাজ থেকে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল। তার নাম ছিল কারালামবুস। একে অপরকে ভাল করে জানার পর আমরা
বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। এই সময়ে, ১৯৫২ সালের ৯ই জানুয়ারি আমি যিহোবার কাছে আমার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম নিই।কারালামবুস আগেই বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। সে-ও তার পরিবার থেকে বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল। কারালামবুস খুব উদ্যোগী ছিল। সে মণ্ডলীর সহকারী দাস হিসেবে সেবা করত এবং অনেক বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করত। শীঘ্রই তার দাদারা সত্যকে গ্রহণ করেছিল এবং আজকে তাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য যিহোবার সেবা করছে।
আমার বাবা কারালামবুসকে খুব ভালবাসতেন, তাই তিনি এই বিয়ের জন্য সম্মতি দিয়েছিলেন কিন্তু আমার মাকে সহজে রাজি করানো যায়নি। এত কিছু সত্ত্বেও, কারালামবুস ও আমি ১৯৫২ সালের ২৯শে মার্চ বিয়ে করি। শুধুমাত্র আমার বড়দা ও আমার একজন জেঠতুতো ভাই বিয়েতে এসেছিল। আমি তখন জানতাম না যে, কারালামবুস কী এক অতুলনীয় আশীর্বাদ—যিহোবার কাছ থেকে এক প্রকৃত উপহার—প্রমাণিত হবে! তার সঙ্গী হিসেবে, আমি আমার জীবন যিহোবার সেবাকে ঘিরে গড়ে তুলতে পেরেছিলাম।
আমাদের ভাইবোনদের শক্তিশালী করা
কারালামবুস ও আমি ১৯৫৩ সালে এথেন্সে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। প্রচার কাজে আরও বেশি করার জন্য কারালামবুস তার পারিবারিক ব্যাবসা থেকে ইস্তিফা নেয় আর একটা খণ্ডকালীন কাজের সন্ধান পায়। আমরা দুপুরে খ্রিস্টীয় পরিচর্যায় সময় কাটাতাম এবং অনেক বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতাম।
আমাদের পরিচর্যায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করার কারণে আমাদের উপায়গুলো বের করায় দক্ষ হওয়ার দরকার ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমরা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একটা কপি বুকস্টলের জানালার ওপর রাখার সিদ্ধান্ত নিই যেটা এথেন্সের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ছিল যেখানে আমার স্বামী খণ্ডকালীন কাজ করত। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারী আমাদের বলেছিলেন যে, এই পত্রিকাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তিনি এটার একটা কপি পেতে পারেন কি না আর তিনি নিরাপত্তা দফতরে এটার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা যখন তাকে আশ্বাস দেয় যে, এই পত্রিকাটা বৈধ তখন তা আমাদের জানানোর জন্য তিনি ফিরে আসেন। অন্যান্য ভাইয়েরা যাদের বুকস্টলগুলো রয়েছে তারাও এটা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বুকস্টলগুলোর জানালাগুলোতে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার কপিগুলো রাখতে শুরু করে। একজন ব্যক্তি আমাদের বুকস্টল থেকে প্রহরীদুর্গ নেন, সাক্ষি হন আর এখন একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করছেন।
এ ছাড়া আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম যখন দেখেছিলাম যে, আমার সবচেয়ে ছোট ভাই সত্য শিখেছে। সে নৌবাণিজ্যের কলেজে পড়াশোনা করার জন্য এথেন্সে এসেছিল এবং আমরা তাকে আমাদের সঙ্গে একটা সম্মেলনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের সম্মেলনগুলো গোপনে জঙ্গলগুলোতে অনুষ্ঠিত হতো। সে যা শুনেছিল তা তার ভাল লেগেছিল কিন্তু এরপর খুব শীঘ্রই সে নৌবণিক হিসেবে কাজ শুরু করে। একটা যাত্রায় সে আর্জেন্টিনার এক বন্দরে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে একজন মিশনারি প্রচার করার জন্য জাহাজে উঠেছিলেন এবং আমার ভাই তার কাছ থেকে আমাদের পত্রিকাগুলো চেয়েছিল। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম যখন আমরা তার কাছ থেকে চিঠি পাই, যেটাতে লেখা ছিল: “আমি সত্য পেয়েছি। দয়া করে আমাকে এই পত্রিকার একজন গ্রাহক কর।” আজকে, সে ও তার পরিবার বিশ্বস্তভাবে যিহোবাকে সেবা করছে।
১৯৫৮ সালে আমার স্বামীকে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যেহেতু আমাদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল এবং পরিস্থিতিগুলো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল, তাই ভ্রমণ অধ্যক্ষরা সাধারণত তাদের স্ত্রীদের নিয়ে কাজ করত না। ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাসে আমরা শাখা অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আমিও তার সঙ্গে যেতে পারি কি না। তারা রাজি হয়েছিল। আমাদের মধ্য ও উত্তর গ্রিসের মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন ও তাদের শক্তিশালী করতে হয়েছিল।
সেই যাত্রাগুলো সহজ ছিল না। খুব অল্পই পাকা রাস্তা ছিল। যেহেতু আমাদের নিজস্ব গাড়ি ছিল না, তাই আমরা সাধারণত জনসাধারণের পরিবহণ বা খোলা ট্রাকগুলোতে মুরগি ও অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে যাত্রা করতাম। কাঁচা রাস্তাগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য আমরা রাবারের জুতো পরতাম। যেহেতু প্রত্যেকটা গ্রামে একটা অসামরিক সমরবাহিনী তদারকি করত, তাই জেরার মুখোমুখি হওয়া এড়িয়ে চলার জন্য আমাদের রাতের আঁধারে গ্রামগুলোতে ঢুকতে হতো।
ভাইবোনেরা এই পরিদর্শনগুলোর প্রতি গভীর উপলব্ধি দেখিয়েছিল। যদিও তাদের অধিকাংশই নিজ নিজ খেতগুলোতে কঠোর পরিশ্রম করত, তবুও তারা বিভিন্ন ঘরে গভীর রাতে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে যোগ দেওয়ার জন্য সবরকম চেষ্টা করত। এ ছাড়া, ভাইবোনেরা খুব অতিথিপরায়ণ ছিল এবং যদিও তাদের খুব অল্প ছিল কিন্তু তাদের সবচেয়ে ভালটা তারা আমাদের দিত। কখনও কখনও, আমরা পুরো পরিবারের সঙ্গে একই কামরায় শুতাম। ভাইবোনদের বিশ্বাস, ধৈর্য ও উদ্যোগ আমাদের জন্য আরেক অমূল্য উপকার হিসেবে প্রমাণিত হয়।
আমাদের সেবাকে প্রসারিত করা
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, এথেন্সে শাখা অফিস দেখতে যাওয়ার সময় আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আমরা বেথেলে সেবা করার জন্য ইচ্ছুক আছি কি না। আমরা যিশাইয়ের কথাগুলোর মতো উত্তর দিয়েছিলাম: “এই আমি, আমাকে পাঠাও।” (যিশাইয় ৬:৮) দুমাস পরে আমরা একটা চিঠি পাই যেটাতে আমাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেথেলে আসার জন্য বলা হয়েছিল। তাই, ১৯৬১ সালের ২৭শে মে থেকে আমরা বেথেলে সেবা করতে শুরু করি।
আমরা আমাদের নতুন কার্যভারটা খুবই উপভোগ করেছিলাম এবং শীঘ্রই আমরা সেই জায়গাটাকে নিজের করে নিই। আমার স্বামী সারভিস ও সাবস্ক্রিপশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করত এবং পরে কিছু সময় ধরে সে শাখা কমিটিতে ছিল। আমি হোম ডিপার্টমেন্টে বিভিন্ন কাজ করেছিলাম। সেই সময় বেথেল পরিবারে ১৮ জন সদস্য ছিল কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর ধরে সেখানে প্রায় ৪০ জন ব্যক্তি ছিল কারণ বেথেলে প্রাচীনদের জন্য একটা স্কুল হচ্ছিল। সকালে আমি থালাবাসন ধুয়ে দিতাম, পাচককে সাহায্য করতাম, ১২টা বিছানা তৈরি করতাম ও দুপুরের খাবারের জন্য টেবিল সাজাতাম। দুপুরে আমি কাপড় ইস্ত্রি করতাম ও শৌচাগার এবং রুমগুলো পরিষ্কার করতাম। সপ্তাহে একবার আমি লন্ড্রিতেও কাজ করতাম। অনেক কাজ ছিল কিন্তু সাহায্য করতে পেরে আমি আনন্দিত ছিলাম।
আমরা আমাদের বেথেলের কার্যভার ও সেইসঙ্গে ক্ষেত্রের পরিচর্যায় খুব ব্যস্ত থাকতাম। অনেক সময় আমরা সাতটা বাইবেল অধ্যয়ন পর্যন্ত করেছি। সপ্তাহের শেষে কারালামবুস যখন বক্তৃতাগুলো দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মণ্ডলীতে যেত, তখন আমি তার সঙ্গে যেতাম। আমরা ছিলাম অবিচ্ছেদ্য।
আমরা এক দম্পতির সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতাম, যারা গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল এবং তারা এমন একজন যাজকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, যিনি ধর্মবিরোধীদের খুঁজে বের করার সংগঠনের নেতৃত্ব নিতেন। তাদের বাড়িতে একটা কামরা ধর্মীয় চিত্রগুলো দিয়ে ভরতি ছিল, যেখানে সবসময় ধূপ জ্বলত এবং বাইজান্টাইন ভজনগুলো সারাদিন বাজত। কিছুদিন ধরে আমরা বাইবেল অধ্যয়ন করানোর জন্য বৃহস্পতিবারে তাদের কাছে যেতাম এবং তাদের যাজক বন্ধু শুক্রবারে তাদের কাছে আসতেন। একদিন তারা তাদের বাড়িতে অবশ্যই আসার জন্য আমাদের অনুরোধ জানান কারণ তারা আমাদের আশ্চর্য করার মতো কিছু দেখাতে চেয়েছিল। প্রথমে আমাদেরকে তারা যা দেখিয়েছিল সেটা ছিল সেই কামরাটা। তারা সমস্ত চিত্র ফেলে দিয়েছিল এবং কামরাটাকে নতুন করে সাজিয়েছিল। এই দম্পতি আরও অগ্রগতি করেছিল এবং বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। সর্বমোট, প্রায় ৫০ জন যাদের সঙ্গে আমরা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করেছিলাম তাদের যিহোবার কাছে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে ও বাপ্তিস্ম নিতে দেখার আনন্দ আমরা উপভোগ করেছিলাম।
অভিষিক্ত ভাইদের সঙ্গে মেলামেশা করা ছিল এক বিশেষ উপকার, যা আমি উপভোগ করেছি। ভাই নর, ফ্রাঞ্জ, হেনশেলের
মতো পরিচালক গোষ্ঠীর সদস্যদের পরিদর্শনগুলো অত্যন্ত উৎসাহজনক ছিল। ৪০ বছরেরও বেশি সময় পর আমি এখনও মনে করি যে, বেথেলে সেবা করা হল এক মহৎ সম্মান ও বিশেষ সুযোগ।অসুস্থতা ও বিচ্ছেদের সঙ্গে মোকাবিলা করা
১৯৮২ সালে আমার স্বামীর মধ্যে আলজেইমারস রোগের লক্ষণগুলো দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালের মধ্যে তার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়ে আর এর ফলে তার সর্বক্ষণ যত্নের প্রয়োজন দেখা যায়। তার জীবনের শেষ আট বছর আমরা বেথেল ছেড়ে কোথাও যেতে পারিনি। বেথেল পরিবারের অনেক প্রিয় ভাইবোনেরা ও সেইসঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষরা আমাদের সাহায্য করার বিভিন্ন ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু, তাদের সদয় সাহায্য সত্ত্বেও, তার যত্ন নেওয়ার জন্য আমাকে দিন রাত ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে হতো। কখনও কখনও, পরিস্থিতিগুলো খুবই কঠিন হয়ে পড়ত এবং আমি অনেক রাত না ঘুমিয়েই কাটিয়েছি।
১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে আমার প্রিয় স্বামী মারা যায়। যদিও আমি প্রচণ্ডভাবে তার অভাব বোধ করি কিন্তু আমি এটা জেনে সান্ত্বনা পাই যে, সে যিহোবার তত্ত্বাবধানে রয়েছে এবং আমি জানি যে, পুনরুত্থানের সময় যিহোবা অন্যান্য কোটি কোটি লোকের মধ্যে তাকে স্মরণে রাখবেন।—যোহন ৫:২৮, ২৯.
যিহোবার উপকারগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ
যদিও আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি কিন্তু আমি একা নই। আমার এখনও বেথেলে সেবা করার বিশেষ সুযোগ রয়েছে এবং আমি পুরো বেথেল পরিবারের ভালবাসা ও যত্ন উপভোগ করি। আমার প্রসারিত পরিবারের মধ্যে সমগ্র গ্রিসের আধ্যাত্মিক ভাইবোনরাও অন্তর্ভুক্ত। যদিও আমার বয়স এখন ৭০রের ওপরে, তবুও আমি এখনও কিচেন ও ডাইনিং রুমে পুরোদিন কাজ করতে পারি।
১৯৯৯ সালে আমার জীবনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল, যখন আমি নিউ ইয়র্কে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করেছিলাম। আমি কেমন বোধ করেছিলাম তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সেটা ছিল গঠনমূলক এবং অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা।
অতীতে ফিরে তাকিয়ে দেখলে, আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি যে আমি আমার জীবনকে এর চেয়ে ভালভাবে আর ব্যবহার করতে পারতাম না। সর্বোত্তম যে-বৃত্তি একজন গ্রহণ করতে পারে তা হল, যিহোবাকে পূর্ণ-সময় সেবা করা। আমি দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি যে আমার কখনও কোনোকিছুর অভাব হয়নি। আধ্যাত্মিক ও শারীরিক, উভয়ভাবেই যিহোবা প্রেমের সঙ্গে আমার স্বামীর ও আমার যত্ন নিয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি যে, কেন গীতরচক জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আমি যিহোবা হইতে যে সকল মঙ্গল পাইয়াছি, তাহার পরিবর্ত্তে তাঁহাকে কি ফিরাইয়া দিব?”—গীতসংহিতা ১১৬:১২.
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
কারালামবুস ও আমি ছিলাম অবিচ্ছেদ্য
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
শাখায় আমার স্বামী তার অফিসে
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমি অনুভব করি যে বেথেল সেবা হল এক মহৎ সম্মান