যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া ও যত্ন লাভ করা
জীবন কাহিনী
যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া ও যত্ন লাভ করা
বলেছেন ফে কিং
আমার বাবামা দয়ালু ছিল কিন্তু অন্যান্য অনেকের মতোই ধর্মের প্রতি তাদের একটুও আগ্রহ ছিল না। আমার মা প্রায়ই বলতেন: “একজন ঈশ্বর নিশ্চয়ই আছেন, তা না হলে কে ফুল, গাছপালা সৃষ্টি করেছেন?” কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে তার চিন্তা কেবলমাত্র এই পর্যন্তই ছিল।
আমার বাবা ১৯৩৯ সালে মারা যাওয়ার সময় আমার বয়স ছিল ১১ বছর আর আমি ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের ঠিক দক্ষিণে স্টকপোর্টে আমার মায়ের সঙ্গে থাকতাম। আমি সবসময় আমার সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে আরও বেশি কিছু জানতে চেয়েছিলাম এবং যদিও আমি বাইবেল সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না, তবুও এটিকে সম্মান করতাম। তাই আমি চার্চ অফ ইংল্যান্ড-এ যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, এটা দেখতে যে এখানে কী শেখানো হয়।
গির্জার সভাগুলো আমার ওপর কোনো প্রভাবই ফেলেনি কিন্তু সুসমাচারের পুস্তকগুলো যখন পড়া হয়েছিল, তখন যিশুর কথাগুলো যেকোনোভাবে হোক আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে, অবশ্যই বাইবেল সত্য। সেই বিষয়গুলোর কথা মনে করে আমার খুবই আশ্চর্য লাগে যে, আমি কখনও নিজে বাইবেল পড়িনি। এমনকি পরে, আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন বান্ধবী যখন আধুনিক অনুবাদের একটা “নূতন নিয়ম” আমাকে দিয়েছিল, তখনও আমি এটি পড়ার জন্য সময় করে নিইনি।
১৯৫০ সালে কোরিয়ার যুদ্ধের আরম্ভ, সত্যিই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো এই সংঘর্ষটাও কি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে? যদি তা-ই হয়, তা হলে কীভাবে আমি আমার শত্রুদের ভালবাসার বিষয়ে যিশুর আদেশ মেনে চলব? কিন্তু, লোকেরা যখন আমার দেশ আক্রমণ করবে, তখন আমি কি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব এবং তাদেরকে বাধা দিতে কিছুই করব না? আমি যদি তা করি, তা হলে নিশ্চিতভাবে আমি আমার দায়িত্বকে এড়িয়ে যাচ্ছি। যদিও আমি খুব বিভ্রান্ত ছিলাম, তবুও
আমি এই ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম যে, আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বাইবেলে রয়েছে, যদিও আমার কোনো ধারণা ছিল না যে কীভাবে বা কোথায় সেগুলো আমি পেতে পারি।অস্ট্রেলিয়ায় সত্য খোঁজা
আমার মা ও আমি ১৯৫৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, যেখানে আমার দিদি জিন থাকত। কয়েক বছর পরে জিন আমাকে বলে যে, সে যিহোবার সাক্ষিদের বলেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে কারণ সে জানত, আমি বাইবেলের প্রতি আগ্রহী ছিলাম এবং গির্জায় যেতাম। সে জানতে চেয়েছিল যে, আমি তাদের সম্বন্ধে কী মনে করি। “আমি জানি না যে, তাদের দেওয়া ব্যাখ্যাগুলো সঠিক না বেঠিক,” সে আমাকে বিশ্বাসপূর্বক এই কথাগুলো বলেছিল “কিন্তু তাদের কাছে অন্তত বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে, যা গির্জাগুলোতে দেওয়া ব্যাখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।”
বিল ও লিন্ডা শ্নিডার, নামে এক হাসিখুশি দম্পতি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বয়স ছিল সত্তর ছুঁই ছুঁই এবং তারা বেশ অনেক বছর ধরে সাক্ষি। তারা এডেলাইডে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা পরিচালিত বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়াতে যখন প্রচার কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, তখন তারা পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু বিল ও লিন্ডা আমাকে সাহায্য করা সত্ত্বেও, আমি তখনও অন্যান্য ধর্ম পরীক্ষা করে দেখছিলাম।
একজন সহকর্মী আমাকে বিলি গ্রাহাম নামে একজন সুসমাচার প্রচারকের সভাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আর সভার পরে আমাদের মধ্যে কয়েক জন একজন পাদরির সঙ্গে দেখা করি, যিনি বিভিন্ন প্রশ্ন করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি একটা প্রশ্ন করি, যেটা তখনও আমাকে ভাবিয়ে তুলছিল: “কীভাবে আপনি একজন খ্রিস্টান হতে পারেন এবং আপনার শত্রুদের ভালবাসতে পারেন, যখন আপনি যুদ্ধে যান ও তাদের হত্যা করেন?” পুরো দলের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে হইচই শুরু হয়ে যায়—সেই প্রশ্নটা স্পষ্টতই তাদের সকলকে চিন্তিত করে তুলেছিল! কিছু পরে, পাদরি বলেছিলেন: “আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানি না। আমি এখনও প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তা করছি।”
ইতিমধ্যে, বিল ও লিন্ডার সঙ্গে আমি বাইবেল অধ্যয়ন করে যাচ্ছিলাম এবং ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। আমি আমার শিক্ষকদের উদাহরণকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাই পরের বছর আগস্ট মাস থেকে আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী, একজন পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে নাম লিখিয়েছিলাম। আট মাস পরে আমাকে বিশেষ অগ্রগামী হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এটা জেনে আমি কতই না খুশি হয়েছিলাম যে, আমার দিদি জিনও অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছিল এবং বাপ্তাইজিত হয়েছিল!
সুযোগের এক দ্বার খুলে যায়
আমি সিডনির একটা মণ্ডলীতে সেবা করছিলাম এবং বেশ কয়েকটা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করছিলাম। একদিন চার্চ অফ ইংল্যান্ড এর একজন অবসরপ্রাপ্ত পাদরির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এবং আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, জগতের শেষ সম্বন্ধে গির্জা কী শিক্ষা দেয়। যদিও তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, ৫০ বছর ধরে তিনি গির্জার মতবাদ শিখিয়ে আসছেন, তার উত্তর আমাকে অবাক করে দিয়েছিল: “এটা আমাকে একটু গবেষণা করে দেখতে হবে কারণ আমি যিহোবার সাক্ষিদের মতো অত ভালভাবে বাইবেল জানি না।”
এর কিছু পরেই, পাকিস্তানে সেবা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান করা হয়েছিল। আমি আবেদন করেছিলাম কিন্তু জানতাম না যে অবিবাহিত মেয়েদের পাঠানো হয় না, শুধুমাত্র অবিবাহিত পুরুষ বা বিবাহিত দম্পতিদের পাঠানো হয়। এটা স্পষ্ট ছিল যে, আমার আবেদনপত্রকে আমাদের প্রধান কার্যালয় ব্রুকলিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ শীঘ্রই আমি একটা চিঠি পাই যেটাতে আমাকে বলা হয়েছিল যে, ভারতের বোম্বেতে (এখন মুম্বই নামে পরিচিত) একটা স্থান খালি রয়েছে আর সেখানে আমি যেতে চাই কি না। সেটা ছিল ১৯৬২ সালের কথা। আমি সেখানে গিয়েছিলাম এবং এলাহাবাদে চলে যাওয়ার আগে ১৮ মাস বোম্বেতে থেকেছিলাম।
শীঘ্রই আমি হিন্দি শিখতে প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করেছিলাম। এই ভারতীয় ভাষায় সাধারণত বানান ও উচ্চারণের মিল রয়েছে, তাই এই ভাষা রপ্ত করা খুব একটা কঠিন নয়।
কিন্তু, এটা প্রায়ই হতাশাজনক ছিল, যখন গৃহকর্তারা আমাকে কষ্ট করে তাদের ভাষায় কথা না বলে ইংরেজিতে বলার জন্য বলত! কিন্তু এই নতুন দেশে অনেক আগ্রহজনক ও রোমাঞ্চকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গিয়েছিল এবং আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা সহসাক্ষিদের সঙ্গে মেলামেশা করে আনন্দ পেয়েছিলাম।আমার যৌবনের দিনগুলোতে আমি বিবাহ সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলাম কিন্তু আমি যখন বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম, তখন আমি যিহোবাকে সেবা করার বিষয়টা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, সেই সম্বন্ধে চিন্তা করার সময় ছিল না। যাই হোক, এখন আমি আবার একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা বোধ করতে শুরু করেছিলাম। অবশ্য, আমি বিদেশে সেবা করার আমার কার্যভারকে ছাড়তে চাইনি, তাই আমি এই বিষয়টা নিয়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম ও বিষয়টা নিয়ে আর বেশি চিন্তা করিনি।
এক অপ্রত্যাশিত আশীর্বাদ
সেই সময়ে এডউইন স্কিনার ভারত শাখার কাজের তত্ত্বাবধান করছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে অন্যান্য বিশ্বস্ত ভাইদের সঙ্গে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড এর অষ্টম ক্লাসে যোগ দিয়েছিলেন, যে-ভাইদের মধ্যে ছিলেন হ্যারাল্ড কিং ও স্ট্যানলি জোন্স, যাদের চিনে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। * ১৯৫৮ সালে হ্যারাল্ড ও স্ট্যানলিকে সাংহাইয়ে তাদের প্রচার কাজের জন্য নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছিল। হ্যারাল্ড যখন ১৯৬৩ সালে ছাড়া পেয়েছিলেন, তখন এডউইন তাকে চিঠি লিখেছিলেন। হ্যারাল্ড যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে যাত্রা করে হংকংয়ে ফিরে আসার পর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন এবং উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি বিয়ে করতে চান। তিনি এডউইনকে বলেছিলেন যে, কারাবাসে থাকার সময় তিনি এই বিষয়ে প্রার্থনা করেছিলেন এবং তিনি এডউইনকে জিজ্ঞেস করেন, যদি তার এমন একজন সাক্ষি বোন সম্বন্ধে জানা থাকে যিনি একজন উপযুক্ত স্ত্রী হওয়ার যোগ্য।
ভারতে অধিকাংশ বিয়ে অভিভাবকদের মাধ্যমে ঠিক করা হয় এবং এডউইনকে বরাবরই এই ধরনের ব্যবস্থাগুলো করতে বলা হতো কিন্তু সবসময়ই তিনি তা করতে চাইতেন না। তাই, তিনি হ্যারাল্ডের চিঠি রূৎ মেকের হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন, যার স্বামী হোমার, একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ ছিলেন। পরে, রূৎ এই কথা বলার জন্য আমাকে চিঠি লিখেছিলেন যে, অনেক বছর ধরে সত্যে আছেন এমন একজন মিশনারি বিয়ে করার জন্য একজন মেয়ে খুঁজছেন আর রূৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমি সেই ভাইকে চিঠি লেখার জন্য আগ্রহী আছি কি না। সেই ভাইটি কে বা তার সম্বন্ধে কোনো কিছুই তিনি আমাকে বলেননি।
অবশ্য, সঙ্গীর জন্য করা আমার প্রার্থনা সম্বন্ধে যিহোবা ছাড়া আর কেউ জানত না আর শুরুতে আমি এই বিষয়টাকে প্রত্যাখ্যান করার কথাই ভেবেছিলাম। তবে, বিষয়টা নিয়ে আমি যত বেশি ভাবতে থাকি ততই আমি এই উপসংহারে এসেছিলাম যে, যিহোবা খুব কমই আমাদের প্রার্থনার উত্তর ঠিক আমরা যেভাবে চিন্তা করি, সেভাবে দিয়ে থাকেন। তাই, আমি রূৎকে চিঠির উত্তর দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে, তাকে বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলে তিনি সেই ভাইকে আবার চিঠি লেখার জন্য বলতে পারেন। হ্যারাল্ড কিংয়ের পাঠানো দ্বিতীয় চিঠিটা ছিল আমার জন্য।
চিনে কারাবাস থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হ্যারাল্ডের বিভিন্ন ছবি ও তার কাহিনী বিভিন্ন খবরের কাগজ ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তিনি সারা পৃথিবীতে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, তবে তার বিশ্বস্ত ঈশতান্ত্রিক কাজের নথিই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই আমরা পাঁচ মাস ধরে এক অপরকে চিঠি লিখেছিলাম এবং তারপর আমি হংকংয়ে চলে গিয়েছিলাম। ১৯৬৫ সালের ৫ই অক্টোবর আমরা বিয়ে করেছিলাম।
আমরা দুজনেই বিয়ের পর পূর্ণ-সময়ের কাজ করে যেতে চেয়েছিলাম আর আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে এক অন্যের সাহচর্য লাভের অনুভূতি বোধ করছিলাম। হ্যারাল্ডের প্রতি আমার ভালবাসা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল আর আমি যখন দেখেছিলাম যে, সে সদয়ভাবে ও বিবেচনাপূর্বক যেভাবে লোকেদের সঙ্গে ব্যবহার করে ও আমাদের ক্ষেত্রে আসা সমস্যাগুলোকে যেভাবে মোকাবিলা করে থাকে, তখন সে আমার গভীর সম্মান অর্জন করে। ২৭ বছর ধরে আমরা সুখী বিবাহিত জীবন উপভোগ করেছি এবং যিহোবার কাছ থেকে অনেক আশীর্বাদ পেয়েছি।
চিনের লোকেরা পরিশ্রমী এবং তাদের আমার খুব ভাল লাগে। হংকংয়ে ক্যানটোনিজ ভাষা বলা হয়, এটা হল চিনের এক আঞ্চলিক ভাষা যেটাতে আরও অনেক ধ্বনি বা সুরের ওঠা-নামা রয়েছে, যা ম্যানডারিন ভাষায় অতটা নেই আর সেইজন্য শেখা একটু কঠিন। হ্যারাল্ড এবং আমি যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে মিশনারি হোমে আমাদের বিবাহ জীবন শুরু করেছিলাম
ও এরপর আমরা হংকংয়ের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছিলাম। হ্যাঁ, আমরা খুব সুখী ছিলাম কিন্তু ১৯৭৬ সালে আমার স্বাস্থ্য এক গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে।স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করা
কয়েক মাস আমার রক্তক্ষরণ হয়েছিল আর তাই আমার রক্ত কণিকার পরিমাণ অত্যন্ত দ্রুত নেমে গিয়েছিল। আমার অস্ত্রোপচারের দরকার হয়েছিল কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা আমাকে বলেছিল যে, তারা রক্ত ছাড়া অস্ত্রোপচার করবে না কারণ যদি তারা করে, তা হলে আমি সম্ভবত রক্তস্বল্পতার কারণে অকস্মাৎ অবসাদে মারা যাব। একদিন ডাক্তাররা যখন আমার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন নার্সরা এই বলে আমার মন পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিল যে, অযথা জীবনকে নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। সেই দিন তালিকা অনুযায়ী ১২টা অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল, যেগুলোর মধ্যে ১০টা ছিল গর্ভপাত কিন্তু আমি লক্ষ করেছিলাম যে, কেউই সেই গর্ভবতী মহিলাদেরকে তাদের শিশুর জীবন হত্যা করার বিষয়ে প্রতিবাদ করে একটা কথাও বলেনি।
শেষ পর্যন্ত, হ্যারাল্ড হাসপাতালকে একটা চিঠি লিখে জানায় যে, আমি যদি মারা যাই, তা হলে তারা দায়মুক্ত আর ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করার জন্য রাজি হয়েছিল। আমাকে অস্ত্রোপচার করার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং অজ্ঞান করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু, যিনি অজ্ঞান করবেন, তিনি শেষ মুহূর্তে তা করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং হাসপাতাল আমাকে মুক্তি দিয়েছিল।
এরপর আমরা হাসপাতালের বাইরের একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার অবস্থার গুরুতরতাকে উপলব্ধি করে তিনি খুব কম খরচে অস্ত্রোপচার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন—এই শর্তে যে, আমরা যেন কাউকে না বলি তিনি কত দাম নিয়েছেন। তিনি সফলতার সঙ্গে অস্ত্রোপচার করেছিলেন—আর কোনো রক্ত ব্যবহার করা ছাড়াই। এই নির্দিষ্ট সময়ে হ্যারাল্ড ও আমার প্রতি যিহোবার প্রেমপূর্ণ দয়া ও যত্ন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল।
১৯৯২ সালে হ্যারাল্ড সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমরা শাখা অফিসে চলে গিয়েছিলাম এবং সেখানে প্রেমের সঙ্গে আমাদের দুজনেরই যত্ন নেওয়া হয়েছিল। আমার প্রিয়তম স্বামী ১৯৯৩ সালে ৮১ বছর বয়সে তার পার্থিব জীবন শেষ করেছিলেন।
ইংল্যান্ডে ফিরে আসা
আমি হংকং বেথেল পরিবারের একজন সদস্য হতে পেরে আনন্দিত ছিলাম কিন্তু রোদের তাপ ও আর্দ্রতা সহ্য করা দিন দিন আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠছিল। এরপর হঠাৎ ব্রুকলিন প্রধান কার্যালয় থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম যেটাতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আমার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আমি অধিক সুযোগসুবিধা রয়েছে এমন শাখা অফিসে যেতে চাই কি না। তাই, ২০০০ সালে আমি ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলাম এবং লন্ডনে বেথেল পরিবারে যোগ দিয়েছিলাম। এটা কী এক প্রেমপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবেই না প্রমাণিত হয়েছে! আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল এবং আমি আমার বিভিন্ন কার্যভারকে খুব উপভোগ করি, যেটার অন্তর্ভুক্ত বেথেল পরিবারের লাইব্রেরি ও তাতে থাকা ২,০০০টি খণ্ডের যত্ন নিতে সাহায্য করা।
এ ছাড়া, আমি চিন ভাষী মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করি, যা লন্ডনে মিলিত হয় কিন্তু এখানে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। আজকাল, খুব অল্প লোকই হংকং থেকে আসে, বরং অধিকাংশই চিনের প্রধান শহর থেকে আসে। তারা ম্যানডারিন ভাষায় কথা বলে এবং এই বিষয়টা প্রচার কাজে এক নতুন সমস্যা উপস্থিত করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রিপোর্ট পাওয়া যায় যে, চিন থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অনেক আগ্রহজনক বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করা হচ্ছে। তারা খুব পরিশ্রমী ও বাইবেলের যে-সত্যগুলো তারা শিখছে, সেগুলো উপলব্ধি করে। তাদের সাহায্য করা এক আনন্দের বিষয়।
আমার নতুন ঘরের শান্ত পরিবেশে আমি প্রায়ই আমার সুখী জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করি এবং যিহোবার প্রেমপূর্ণ দয়ার কথা ভেবে সবসময় আশ্চর্য হই। তাঁর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্তকিছুর ওপর এটা পরিব্যাপ্ত এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দাসদের প্রতি তাঁর যত্ন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আমার প্রতি তাঁর প্রেমপূর্ণ যত্নের জন্য আমার কৃতজ্ঞ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।—১ পিতর ৫:৬, ৭.
[পাদটীকা]
^ এই দুজন মিশনারির জীবন কাহিনী ১৯৬৩ সালের ১৫ই জুলাই প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ৪৩৭-৪২ পৃষ্ঠা এবং ১৯৬৫ সালের ১৫ই ডিসেম্বর প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ৭৫৬-৬৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল।
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
ভারতে সেবা করছেন
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
হ্যারাল্ড কিং ১৯৬৩ সালে এবং ১৯৫০ এর দশকে চিনে সেবা করছেন
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
১৯৬৫ সালের ৫ই অক্টোবর, হংকংয়ে আমাদের বিয়ের দিনে
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
হংকং বেথেলের সদস্যদের সঙ্গে, মাঝে লিয়াঙ্গরা, ডান দিকে গানাওয়েরা