অন্ধকার কারাকূপ থেকে সুইস আল্পসে
জীবন কাহিনী
অন্ধকার কারাকূপ থেকে সুইস আল্পসে
বলেছেন লোটার ভালটের
পূর্ব জার্মানির সাম্যবাদীদের কারাগারগুলোর অন্ধকার কারাকূপে দীর্ঘ তিন বছর থাকার পর, স্বাধীনতার অপূর্ব স্বাদ ও আমার পরিবারের উষ্ণ সাহচর্য উপভোগ করার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম।
কিন্তু, আমার দিকে আমার ছয় বছরের ছেলে ইয়োহানেসের অবাক চাহনির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। গত তিন বছর ধরে সে তার বাবাকে দেখেনি। তার কাছে আমি পুরোপুরি এক অচেনা লোক ছিলাম।
আমার অবস্থা আমার ছেলের মতো ছিল না, বরং আমি আমার বাবামায়ের প্রেমময় সাহচর্য উপভোগ করেছিলাম। জার্মানির কেমনিট্সে আমাদের বাড়িতে এক উষ্ণ পরিবেশ বিরাজমান ছিল, যেখানে ১৯২৮ সালে আমার জন্ম হয়। আমার বাবা বেশ খোলাখুলিভাবে ধর্মের প্রতি তার অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। তিনি স্মরণ করে বলতেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক পক্ষের “খ্রিস্টান” সৈনিকরা অন্য পক্ষের সৈনিকদের ২৫শে ডিসেম্বরে “শুভ বড়দিন” বলে অভিবাদন জানাতো আর পরদিন থেকেই আবার একে অন্যকে হত্যা করতে শুরু করত। বাবার কাছে, ধর্ম ছিল চরম ভণ্ডামি।
হতাশার স্থলে বিশ্বাস স্থান করে নেয়
আনন্দের বিষয় হল যে, এই ধরনের নিরাশাজনক অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। আমার বয়স যখন ১৭ বছর, তখন ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল আর জোরপূর্বক সৈন্যদলে ভরতি হওয়া থেকে আমি কোনোক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও, এই ধরনের প্রশ্নগুলো আমাকে চিন্তিত করে তুলত যেমন, ‘কেন এত রক্তপাত? কার ওপর আমি নির্ভর করতে পারি? কোথায় আমি প্রকৃত নিরাপত্তা পেতে পারি?’ আমরা যেখানে থাকতাম, সেই পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত শাসনাধীনে চলে এসেছিল। সাম্যবাদীদের ন্যায়, সমতা, ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের মতো মতাদর্শগুলো সেই লোকেদের আকৃষ্ট করেছিল, যারা যুদ্ধের ক্ষিপ্ততার দ্বারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শীঘ্রই এই অকপট লোকেদের মধ্যে অনেকে প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়ে পড়ছিল—এবার ধর্মের কারণে নয় কিন্তু রাজনীতির কারণে।
মথি ২৪ অধ্যায়ের পুরোটা পড়তে পরিচালিত করেছিল। আমি বইয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত ও দৃঢ়প্রত্যয় উৎপাদক ব্যাখ্যাগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, যেখানে আমাদের সময়কে ‘যুগান্ত’ বলে শনাক্ত করা এবং মানবজাতির সমস্যাগুলোর মূল কারণটা উল্লেখ করা হয়েছে।—মথি ২৪:৩; প্রকাশিত বাক্য ১২:৯.
আমার প্রশ্নগুলোর অর্থপূর্ণ উত্তরের খোঁজে যখন আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলাম, সেইসময় আমার এক মাসি তার বিশ্বাস সম্বন্ধে আমাকে জানিয়েছিলেন, যিনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন ছিলেন। তিনি আমাকে বাইবেলভিত্তিক একটা প্রকাশনা দিয়েছিলেন, যেটি আমাকে এই প্রথমবারের মতোশীঘ্রই আমি যিহোবার সাক্ষিদের আরও অন্যান্য প্রকাশনা পেয়েছিলাম এবং অত্যন্ত উৎসুকভাবে সেগুলো পড়ার সময় আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, আমি সেই সত্য খুঁজে পেয়েছি যা এত দিন ধরে আমি ঐকান্তিকভাবে খুঁজছিলাম। এটা জানা রোমাঞ্চকর ছিল যে, যিশু খ্রিস্ট ১৯১৪ সালে স্বর্গীয় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং তিনি শীঘ্রই বাধ্য মানবজাতির জন্য আশীর্বাদগুলো নিয়ে আসতে অধার্মিক বিষয়গুলো দূর করে দেবেন। আমার জন্য আরেকটা বড় আবিষ্কার ছিল, মুক্তির মূল্য সম্বন্ধে স্পষ্ট বোধগম্যতা। এটা আমাকে যিহোবা ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করতে সাহায্য করেছিল। যাকোব ৪:৮ পদের এই সাদর আমন্ত্রণ আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল: “ঈশ্বরের নিকটবর্ত্তী হও, তাহাতে তিনিও তোমাদের নিকটবর্ত্তী হইবেন।”
আমার পাওয়া নতুন বিশ্বাসের প্রতি ঐকান্তিক উদ্যোগ সত্ত্বেও, আমার বাবামা ও দিদি প্রথম প্রথম আমি তাদেরকে যা বলতাম, সেগুলো গ্রহণ করতে ইতস্তত বোধ করত। কিন্তু, এটা কেমনিট্সের কাছাকাছি সাক্ষিদের এক ছোট্ট দলের দ্বারা অনুষ্ঠিত খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যাওয়ার বিষয়ে আমার আকাঙ্ক্ষাকে কমিয়ে দেয়নি। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, যখন আমার বাবামা ও দিদি আমার সঙ্গে প্রথম সভায় গিয়েছিল! এটা ছিল ১৯৪৫/৪৬ সালের শীতকালের কথা। পরে, আমরা যেখানে থাকতাম সেই হারট্যাউ শহরে যখন বাইবেল অধ্যয়নের একটা দল গঠিত হয়েছিল, তখন আমার পরিবার সেখানে নিয়মিতভাবে যোগ দিতে শুরু করেছিল।
“আমি বালক”
বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ সত্যগুলো শেখা ও যিহোবার লোকেদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে মেলামেশা করা আমাকে যিহোবার কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করতে পরিচালিত করেছিল আর আমি ১৯৪৬ সালের ২৫শে মে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। আমি গভীর সন্তুষ্টি লাভ করেছিলাম, যখন আমার পরিবারের সদস্যরাও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে তারা তিন জনই বিশ্বস্ত সাক্ষি হয়েছিল। আমার দিদি এখনও কেমনিট্সের একটা মণ্ডলীর একজন সক্রিয় সাক্ষি। আমার মা ও বাবা যথাক্রমে ১৯৬৫ ও ১৯৮৬ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত আনুগত্যের সঙ্গে সেবা করে গেছে।
আমার বাপ্তিস্মের ছয় মাস পর, আমি একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছিলাম। এটা জীবনভর “সময়ে অসময়ে” করা এক পরিচর্যার শুরু ছিল। (২ তীমথিয় ৪:২) শীঘ্রই পরিচর্যার নতুন নতুন সুযোগ খুলে গিয়েছিল। পূর্ব জার্মানির এক দূরবর্তী এলাকায় পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারকদের প্রয়োজন দেখা গিয়েছিল। একজন ভাই ও আমি এই কার্যভারের জন্য আবেদন করেছিলাম কিন্তু আমি মনে মনে ভেবেছিলাম যে, এই ধরনের দায়িত্বপূর্ণ কাজের অভিজ্ঞতা বা পরিপক্বতা কোনোটাই আমার নেই। যেহেতু আমার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর, তাই আমার অনুভূতি যিরমিয়ের মতোই ছিল: “হায় হায়, হে . . . সদাপ্রভু, দেখ, আমি কথা কহিতে জানি না, কেননা আমি বালক।” (যিরমিয় ১:৬) আমার দোটানা মনোভাব থাকা সত্ত্বেও, দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইয়েরা সদয়ভাবে আমাকে একটা সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলে, ব্র্যানডেনবার্গ রাজ্যের এক ছোট্ট শহর, বেল্টসিখে আমাদের কার্যভার দেওয়া হয়েছিল।
সেই এলাকায় প্রচার করা অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল কিন্তু এটা আমাকে মূল্যবান প্রশিক্ষণ জুগিয়েছিল। যথাসময়ে, বেশ কয়েক জন বিখ্যাত মহিলা ব্যবসায়ী রাজ্যের বার্তা গ্রহণ করেছিল এবং যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল। কিন্তু, তাদের এই পদক্ষেপ সেই ছোট্ট প্রত্যন্ত অঞ্চলের দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত প্রথা ও সন্দেহের বিপরীত ছিল। ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট উভয় সম্প্রদায়ের পাদরিশ্রেণী আমাদের প্রতি প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল এবং আমাদের প্রচার কাজের জন্য আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদমূলক অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু, নির্দেশনা ও সুরক্ষার জন্য যিহোবার ওপর নির্ভর করে আমরা বেশ কয়েক জন আগ্রহী ব্যক্তিকে সত্য গ্রহণ করার জন্য সাহায্য করতে পেরেছিলাম।
অসহিষ্ণুতার মেঘ ঘনীভূত হয়
১৯৪৮ সালে বিভিন্ন আশীর্বাদ ও অপ্রত্যাশিত সমস্যা দুটোরই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। প্রথমে, আমি তুরিংজিয়া রাজ্যের রুডেলশ্টাট শহরে অগ্রগামীর কার্যভার পেয়েছিলাম। সেখানে আমি অনেক বিশ্বস্ত ভাইবোনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম এবং তাদের সাহচর্য উপভোগ করেছিলাম। সেই বছরেরই জুলাই মাসে আরেকটা বড় আশীর্বাদ এসেছিল। আমি এক বিশ্বস্ত ও সক্রিয় খ্রিস্টান যুবতী এরিকা উলমানকে বিয়ে করেছিলাম, যার সঙ্গে আমার সেই তখন থেকে আলাপ ছিল, যখন আমি কেমনিট্স মণ্ডলীর সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম। আমরা একসঙ্গে আমার নিজ শহর হারট্যাউতেও অগ্রগামীর কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু, পরে এরিকা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ও অন্যান্য কারণে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে পারেনি।
সেই বছরগুলো যিহোবার লোকেদের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় ছিল। কেমনিট্সের শ্রমবিভাগ আমাকে প্রচার কাজ ছেড়ে দিয়ে পূর্ণ-সময় চাকরি করার চাপ দেওয়ার জন্য আমার খাদ্যের রেশন কার্ড বাতিল করে দিয়েছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইয়েরা রাষ্ট্রের কাছে আইনগত অনুমতি পাওয়ার অনুরোধ করার জন্য আমার মামলাটা ব্যবহার করেছিল। এটা অনুমোদন করা হয়নি এবং ১৯৫০ সালের ২৩শে জুন আমাকে শাস্তি হিসেবে হয় জরিমানা দিতে হতো নতুবা ৩০ দিনের জন্য কারাবাস হতো। আমরা সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলাম কিন্তু উচ্চতর আদালত সেই আপিল বাতিল করে দিয়েছিল এবং আমাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।
সেই ঘটনাটা ছিল আসন্ন বিরোধিতা ও কষ্টের ঝড় ঘনীভূত হওয়ার এক সামান্য ইঙ্গিত। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, সাম্যবাদী সরকার আমাদের সম্মানহানি করার জন্য প্রচারমাধ্যমে এক অভিযান শুরু করার পর, আমাদের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। আমাদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং নিরপেক্ষ পদক্ষেপের কারণে আমাদেরকে পশ্চিমা দেশগুলোর এক বিপদজনক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যারা ধর্মের মুখোশ পরে “সন্দেহজনক কাজ” করে চলে। ঠিক যেদিন নিষিদ্ধকরণের আদেশ জারি করা হয়েছিল, সেদিনই ঘরে আমার স্ত্রী আমাদের ছেলে ইয়োহানেসকে জন্ম দেয় আর আমি তখন ছিলাম কারাগারে। ধাত্রী আপত্তি করা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জোরপূর্বক আমাদের আ্যপার্টমেন্টে ঢুকেছিল এবং তাদের অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে অনুসন্ধান চালিয়েছিল। অবশ্য, তারা কিছুই খুঁজে পায়নি। তবে, পরবর্তী সময়ে তারা আমাদের মণ্ডলীতে একজন গুপ্তচরকে ঢোকানোর দ্বারা সফল হয়েছিল। এর ফলে ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে আমিসহ সমস্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাই গ্রেপ্তার হয়েছিলাম।
অন্ধকার কারাকূপে
অপরাধী হিসেবে দণ্ডিত হওয়ার ও তিন থেকে ছয় বছর কারাবরণের শাস্তি পাওয়ার পর, জুইকার ওসটেশ্টাইন প্রাসাদের সেঁতসেঁতে কারাকূপে আমাদের বেশ কয়েক জন ভাইয়ের সঙ্গে আমরাও যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে অত্যন্ত জঘন্য অবস্থা সত্ত্বেও, পরিপক্ব ভাইদের সঙ্গে মেলামেশা করা ছিল এক প্রকৃত আনন্দের বিষয়। আমাদের স্বাধীনতা না থাকার মানে এই ছিল না যে, আমাদের আধ্যাত্মিক খাদ্যেরও অভাব
ছিল। সরকারের দ্বারা অবজ্ঞাত এবং নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রহরীদুর্গ ঠিক চুপিচুপি কারাগারে এমনকি আমাদের কক্ষগুলোতে চলে এসেছিল! কীভাবে?কিছু ভাইকে কয়লা খনিতে কাজ করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল, যেখানে তাদের বাইরে থেকে আসা সাক্ষিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো আর তারা তাদেরকে পত্রিকাগুলো দিত। এরপর ভাইয়েরা গোপনে পত্রিকাগুলো কারাগারে নিয়ে আসত এবং অত্যন্ত কৌশলে আমাদের বাকি সকলকে অতীব প্রয়োজনীয় আধ্যাত্মিক খাদ্য বন্টন করতে পারত। এভাবে যিহোবার যত্ন ও নির্দেশনা লাভ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও উৎসাহিত বোধ করেছিলাম!
১৯৫৪ সালের শেষের দিকে, আমাদের তোরগাওয়ের কুখ্যাত কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেখানকার সাক্ষিরা আমাদের পেয়ে খুশি হয়েছিল। সেই সময় পর্যন্ত, তারা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলো থেকে যে-বিষয়গুলো মনে রেখেছিল, সেগুলো অনবরত স্মরণ করার দ্বারা আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী থেকেছিল। সতেজ আধ্যাত্মিক খাদ্যের সরবরাহের জন্য তারা কতই না আকুল আকাঙ্ক্ষা করেছিল! জুইকাওতে আমরা যে-বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেছিলাম, সেগুলো তখন তাদের সঙ্গে বন্টন করার দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়েছিল। কিন্তু, কীভাবে আমরা তা করব, যখন কিনা আমাদের রোজকার কাজকর্ম করার সময় একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ ছিল? তবে, কীভাবে তা করতে হবে সেই বিষয়ে ভাইয়েরা আমাদের নানা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিল এবং যিহোবার শক্তিশালী সুরক্ষার হাত আমাদের ওপর ছিল। এটা আমাদের অধ্যবসায়ের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন এবং ধ্যান করার গুরুত্বটা শেখায় যখন আমাদের তা করার স্বাধীনতা ও সুযোগ রয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময়
যিহোবার সাহায্যে আমরা অটল থেকেছিলাম। আমরা খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন আমাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে রাজক্ষমা প্রদান করা হয়েছিল। কারাগারের দরজার কপাটগুলো যখন খোলা হয়েছিল, সেই মুহূর্তের আনন্দের কথা বর্ণনা করা আমাদের জন্য কঠিন! ততদিনে আমার ছেলের বয়স হয়েছিল ছয় বছর এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হওয়া এবং একসঙ্গে আমাদের সন্তান লালনপালন করায় অংশ নেওয়া আমার জন্য এক পরম আনন্দের বিষয় ছিল। কিছু সময়ের জন্য ইয়োহানেস আমার সঙ্গে একজন অচেনা লোকের মতো ব্যবহার করেছিল কিন্তু অল্প দিনেই আমাদের মধ্যে এক উষ্ণ বন্ধন গড়ে উঠেছিল।
পূর্ব জার্মানির যিহোবার সাক্ষিরা তখন অত্যন্ত কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছিল। আমাদের খ্রিস্টীয় পরিচর্যার প্রতি বিরোধিতা বৃদ্ধি পাওয়ার এবং আমাদের নিরপেক্ষ পদক্ষেপ নেওয়ার অর্থ ছিল, আমাদের ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে—বিপদ, উদ্বেগ এবং ক্লান্তির দ্বারা জর্জরিত এক জীবন। তাই, এরিকা ও আমি আমাদের পরিস্থিতিকে মনোযোগ ও প্রার্থনাপূর্বক পরীক্ষা করে দেখেছিলাম আর এক অনুকূল অবস্থায় থাকার জন্য অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছিলাম, যাতে দুশ্চিন্তার দ্বারা জর্জরিত না হই। আমরা যিহোবাকে সেবা করার ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা চেয়েছিলাম।
১৯৫৭ সালের বসন্তকালে, আমাদের জন্য পশ্চিম জার্মানির স্টাটগার্টে চলে যাওয়ার একটা সুযোগ খুলে গিয়েছিল। সেখানে সুসমাচার প্রচারের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না আর আমরা আমাদের ভাইদের সঙ্গে নির্বিঘ্নে মেলামেশা করতে পেরেছিলাম। তাদের প্রেমময় সমর্থন আমাদের অভিভূত করেছিল। আমরা হেডেলফিংগেন মণ্ডলীতে সাত বছর কাটিয়েছিলাম। সেই দিনগুলোতে, আমাদের ছেলে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল এবং সত্যে উন্নতি করেছিল। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভিসবাডেনে কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুল-এ যোগ দেওয়ার বিশেষ সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানে আমাকে আমার পরিবার নিয়ে সেই জায়গায় সেবা করতে চলে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল, যেখানে জার্মানভাষী বাইবেল শিক্ষকদের প্রয়োজন ছিল। এই জায়গাগুলোর মধ্যে ছিল জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের কয়েকটা অঞ্চল।
সুইস আল্পসে
ফলে, ১৯৬৩ সালে আমরা সুইজারল্যান্ডে চলে গিয়েছিলাম। আমাদেরকে সুইস আল্পসের মধ্য অংশে, অপূর্ব লুসার্ন হ্রদের তীরে ব্রুনেন শহরে এক ছোট্ট মণ্ডলীতে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কাছে এটা এক পরমদেশে থাকার মতো ছিল। আমাদেরকে সেখানে বলা জার্মানির আঞ্চলিক ভাষা শিখতে, স্থানীয় জীবনযাপন ও লোকেদের মনোভাবের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু, আমরা শান্তিপ্রিয় লোকেদের মাঝে কাজ ও প্রচার করে আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা ব্রুনেনে ১৪ বছর ছিলাম। আমাদের ছেলে সেখানে বড় হয়ে উঠেছে।
১৯৭৭ সালে আমার বয়স যখন ৫০ ছুঁই ছুঁই, তখন আমরা টুনের সুইস বেথেলে সেবা করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমরা এটাকে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ হিসেবে গণ্য করেছিলাম এবং অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেটা গ্রহণ করেছিলাম। আমার স্ত্রী ও আমি নয় বছর বেথেলে সেবা করেছি, যেটা আমাদের খ্রিস্টীয় জীবন ও ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক উন্নতিতে এক বিশেষ মাইলফলক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এ ছাড়া, আমরা টুন এবং এর আশেপাশের এলাকার স্থানীয় প্রকাশকদের সঙ্গে প্রচার করতেও ভালবাসতাম, সবসময় যিহোবার ‘আশ্চর্য্য ক্রিয়ার’ দৃশ্য দেখতে পেতাম, যার মধ্যে ছিল বার্নিস আল্পসের তুষারাচ্ছাদিত বিশাল পর্বতমালার দৃশ্য।—আরেক জায়গায় যাওয়া
১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে আমাদের আরেক জায়গায় যেতে হয়েছিল। আমাদেরকে সুইজারল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে বাখ্স মণ্ডলীর এক বিশাল এলাকায় বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। আবারও আমাদের এক ভিন্ন জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল। তবে, যেখানেই আমরা সর্বোত্তমভাবে ব্যবহৃত হতে পারি, সেখানে যিহোবাকে সেবা করার আকাঙ্ক্ষার দ্বারা চালিত হয়ে আমরা তাঁর আশীর্বাদে এই নতুন কার্যভার গ্রহণ করেছিলাম। মাঝে মাঝে, আমি বিকল্প ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছি, মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করে তাদের শক্তিশালী করেছি। আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে আর এই এলাকায় প্রচার করতে গিয়ে আমাদের অনেক আনন্দপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাখস্ মণ্ডলী বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমরা একটা সুন্দর কিংডম হলে সভা উপভোগ করি, যা পাঁচ বছর আগে উৎসর্গীকৃত হয়েছিল।
যিহোবা আমাদের সবচেয়ে উদারভাবে যত্ন নিয়েছেন। আমরা আমাদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যায় কাটিয়েছি কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের কিছুরই অভাব হয়নি। আমাদের ছেলে, তার স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের আর সেইসঙ্গে আমাদের নাতিনাতনিদের পরিবারগুলোকে বিশ্বস্তভাবে যিহোবার পথে চলতে দেখার সন্তুষ্টি ও আনন্দ আমাদের রয়েছে।
পূর্বের দিনগুলোর কথা চিন্তা করে আমি মনে করি যে, বাস্তবিকই আমরা “সময়ে অসময়ে” যিহোবাকে সেবা করেছি। খ্রিস্টীয় পরিচর্যা করে যাওয়া আমাকে সাম্যবাদীদের কারাগারগুলোর অন্ধকার কারাকূপ থকে সুইস আল্পসের চমৎকার পর্বতমালায় নিয়ে গেছে। এই কারণে আমার পরিবার ও আমি এক মুহূর্তের জন্যও অনুশোচনা করিনি।
[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স]
“একই অপরাধে দুবার দণ্ডিত ব্যক্তিরা” তাড়নার মধ্যেও দৃঢ় থাকে
জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (জিডিআর), যা পূর্ব জার্মানি হিসেবেও পরিচিত, তাদের শাসনাধীনে যিহোবার সাক্ষিরা পাশবিক দমনের লক্ষ্যবস্তু ছিল। বিভিন্ন রেকর্ড দেখায় যে, ৫,০০০রও বেশি সাক্ষিকে তাদের খ্রিস্টীয় পরিচর্যা এবং নিরপেক্ষতার কারণে জোরপূর্বক শ্রম শিবিরগুলোতে এবং অল্প কিছুদিনের জন্য বন্দিত্বে পাঠিয়েছিল।—যিশাইয় ২:৪.
এই সাক্ষিদের মধ্যে কাউকে কাউকে “একই অপরাধে দুবার দণ্ডিত ব্যক্তি” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৩২৫ জনকে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে এবং কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল। এরপর, ১৯৫০ এর দশকে স্টাজি, জিডিআর এর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগ তাদের তন্নতন্ন করে খুঁজে কারাবদ্ধ করেছিল। এমনকি কয়েকটা কারাগার দুবার—প্রথমে নাৎসি ও পরে স্টাজি কারাগার হিসেবে—ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৯৫০ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত, প্রচণ্ড তাড়নার প্রথম দশ বছরে মোট ৬০ জন সাক্ষি—পুরুষ ও মহিলা—দুর্ব্যবহার, অপুষ্টি, অসুস্থতা এবং বার্ধক্যের কারণে কারাগারেই মারা গিয়েছিল। ১২ জন সাক্ষিকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যা পরে কমিয়ে ১৫ বছর করা হয়েছিল।
আজকে, বার্লিনে প্রাক্তন স্টাজি প্রধান কার্যালয়ে স্থায়ীভাবে তৈরি এক প্রদর্শিত ছবি রয়েছে, যা পূর্ব জার্মানিতে যিহোবার সাক্ষিদের ওপর ৪০ বছর ধরে আইনত তাড়নার বিষয়টা তুলে ধরে। সেখানে প্রদর্শিত ছবি ও ব্যক্তিগত বিবরণগুলো সেই সাক্ষিদের সাহস ও আধ্যাত্মিক শক্তির নীরব সাক্ষ্য দেয়, যারা তাড়নার মধ্যেও বিশ্বস্ত ছিল।
[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
পূর্ব জার্মানি
রুডেলশ্টাট
বেলজিগ
টরগাও
কেমনিট্স
জুইকাও
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
জুইকার ওসটেশ্টাইন প্রাসাদ
[সৌজন্যে]
Fotosammlung des Stadtarchiv Zwickau, Deutschland
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমার স্ত্রী এরিকার সঙ্গে