যে-শিক্ষা জীবনভর স্থায়ী হয়েছে
জীবন কাহিনী
যে-শিক্ষা জীবনভর স্থায়ী হয়েছে
বলেছেন হ্যারল্ড গ্লুয়াস
আমার ছেলেবেলার একটা দৃশ্য ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার স্মৃতিতে রয়েছে। আমি মায়ের রান্নাঘরে বসেছিলাম আর একটা লেবেল দেখছিলাম, যেটাতে “সিলোন চা” লেখা ছিল। এ ছাড়া, সেটাতে কয়েক জন মহিলার ছবি ছিল, যারা সিলোনের (এখন শ্রীলঙ্কা) প্রাচুর্যপূর্ণ সবুজ বাগানে চাপাতা তুলছিল। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের শুষ্ক জন্মভূমি থেকে বহু দূরের এই দৃশ্য আমার কল্পনাকে উদ্দীপিত করে তুলেছিল। সিলোন কত সুন্দর ও রোমাঞ্চকর এক দেশই না হবে! সেই সময় আমি জানতাম না যে, একজন মিশনারি হিসেবে আমি আমার জীবনের ৪৫টা বছর সেই চমৎকার দ্বীপেই কাটাব।
আজকের বিশ্ব থেকে হাজার গুণ আলাদা এক বিশ্বে ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে আমি জন্মগ্রহণ করি। আমার পরিবার দূরবর্তী কিমবা নামক গ্রামের কাছে এক বিচ্ছিন্ন শস্য খামারে কাজ করত আর এটা বিশাল অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের কেন্দ্রস্থল এবং বিরাট জনশূন্য মরুভূমির দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ছিল। জীবন নানারকম বিপদে পূর্ণ ছিল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল অনাবৃষ্টির সঙ্গে এক ক্রমাগত লড়াই, কীটপতঙ্গের উপদ্রব এবং অসহ্য গরম। ঝোপজঙ্গলের মধ্যে টিনের ছাউনি দেওয়া একটা কুঁড়েঘরে বাবা ও আমাদের ছয় সন্তানকে দেখাশোনা করার জন্য আমার মা কঠোর পরিশ্রম করতেন।
কিন্তু আমার কাছে জনশূন্য প্রান্তরটা স্বাধীনতার ও রোমাঞ্চকর এক স্থান ছিল। যৌবনকালে শক্তিশালী ষাঁড়ের দলকে জঙ্গলের ঝোপঝাড় উপড়ে ফেলতে দেখে ভয় পাওয়ার অথবা গর্জনপূর্ণ ধূলিঝড় গ্রামকে ঢেকে ফেলার কথা আমার মনে পড়ে। তাই, আমার শিক্ষা আসলে একজন শিক্ষক পরিচালিত একটা ছোট্ট স্কুলে যোগ দেওয়ার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, যেটা বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পথ ছিল।
আমার বাবামা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিল, যদিও তারা কখনও গির্জায় যেত না—মূলত আমাদের খামার থেকে শহর দূরবর্তী হওয়ার
কারণে। তবুও, ১৯৩০ এর দশকের প্রথমদিকে মা বিচারক রাদারফোর্ডের দেওয়া বাইবেলের বক্তৃতাগুলো, যেগুলো আ্যডিলেডের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে বেতারে ঘোষণা করা হতো, সেগুলো শুনতে শুরু করেন। আমি ভেবেছিলাম যে, বিচারক রাদারফোর্ড ছিলেন আ্যডিলেডের একজন প্রচারক আর তাই আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মা প্রত্যেক সপ্তাহে রাদারফোর্ডের বেতার সম্প্রচারের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করে থাকতেন এবং আমাদের পুরনো আমলের ব্যাটারিচালিত রেডিও থেকে আবছাভাবে ভেসে আসা তার কণ্ঠস্বর খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।একদিন এক গরম, শুষ্ক দুপুরে একটা পুরনো পিকআপ ট্রাক আমাদের বাড়ির সামনে থামে আর মার্জিত পোশাক পরা দুজন ভদ্রলোক বের হয়ে আসে। তারা ছিল যিহোবার সাক্ষি। মা তাদের বার্তা শোনেন এবং বেশ কয়েকটা বইয়ের জন্য চাঁদা দেন আর সেগুলো তিনি সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করেন। এই বইগুলো তার ওপর এত গভীর ছাপ ফেলেছিল যে, তিনি শীঘ্রই বাবাকে বলেছিলেন যে, বাবা যেন গাড়িতে করে তাকে প্রতিবেশীদের কাছে নিয়ে যান, যাতে তিনি যা শিখছেন সেই সম্বন্ধে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
ইতিবাচক প্রভাবগুলোর উপকার
খুব বেশি দিন যেতে না যেতেই, সেই রুক্ষ জনশূন্য পরিবেশ আমাদেরকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে আ্যডিলেড শহরে চলে আসতে বাধ্য করে। আমাদের পরিবার যিহোবার সাক্ষিদের আ্যডিলেড মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি করে। এ ছাড়া, আমাদের চলে আসা আমার নিয়মমাফিক শিক্ষার সমাপ্তি এনেছিল। আমার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিই। আমি অসর্তক প্রকৃতির ছিলাম, যেটা সহজেই আমাকে আধ্যাত্মিক অনুধাবনগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারত যদি না কিছু উত্তম ভাই—অগ্রগামী অথবা পূর্ণসময়ের পরিচারকরা—যারা আমার প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখিয়েছিল, তারা আমাকে সাহায্য করত।
সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এই উদ্যোগী ভাইদের প্রভাব আমার ভিতরকার সুপ্ত আধ্যাত্মিকতাকে উদ্দীপিত করে তুলেছিল। তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার ভাল লাগত এবং তাদের কঠোর পরিশ্রমী মনোভাবকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। তাই যখন ১৯৪০ সালে আ্যডিলেডে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে, পূর্ণসময়ের কাজ করার জন্য উৎসাহ দিয়ে এক ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন আশ্চর্যের বিষয় যে আমি আমার নাম দাখিল করেছিলাম। সেই সময় এমনকি আমি বাপ্তিস্ম নিইনি এবং সাক্ষ্যদানের অভিজ্ঞতাও খুব সামান্য ছিল। তবুও, কিছুদিন পর আ্যডিলেড থেকে কয়েক শত কিলোমিটার দূরে প্রতিবেশী রাজ্য ভিক্টোরিয়ার এক শহর, ওয়ার্নাম্বুলে অগ্রগামীদের একটা দলে যোগ দেওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এই দ্বিধাগ্রস্ত শুরু সত্ত্বেও, আমি শীঘ্রই ক্ষেত্রের পরিচর্যার প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলি, এমন এক ভালবাসা যেটার সম্পর্কে আমি বলতে পেরে আনন্দিত যে, বছরের পর বছর ধরে তা ম্লান হয়ে যায়নি। বস্তুত, সেটা ছিল আমার জন্য এক সন্ধিক্ষণ আর আমি প্রকৃত আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে শুরু করি। আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর জন্য যাদের ভালবাসা রয়েছে তাদের নিকটবর্তী হওয়ার মূল্য সম্বন্ধে আমি জেনেছিলাম। আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে আমাদের শিক্ষা যা-ই হোক না কেন, আমাদের মধ্যে যে-ভাল গুণগুলো রয়েছে সেগুলোকে কীভাবে তাদের উত্তম প্রভাব বের করে আনতে পারে আর আমরা যা শিখি তা কীভাবে জীবনভরের জন্য আমাদের উপকার করতে পারে।
বিভিন্ন পরীক্ষার দ্বারা শক্তিশালী হওয়া
আমি মাত্র অল্প কিছুদিন ধরে অগ্রগামীর কাজ করছিলাম, যখন অস্ট্রেলিয়াতে যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কী করব সেই বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ায় আমি সেই ভাইদের কাছ থেকে নির্দেশনা জানার চেষ্টা করেছিলাম যারা বলেছিল যে, লোকেদের কাছে বাইবেল সম্বন্ধে কথা বলার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই, আমি অন্য অগ্রগামীদের সঙ্গে বাইবেল থেকে এক সহজ-সরল বার্তা নিয়ে ঘরে ঘরে যেতে শুরু করি। এটা আমাকে একেবারে সামনেই যে-পরীক্ষাগুলো ছিল, সেগুলোর জন্য শক্তিশালী করেছিল।
চার মাস পরে আমার ১৮ বছর পূর্ণ আর আমাকে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। এটা আমাকে কয়েক জন সামরিক অফিসার এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আমার বিশ্বাসের পক্ষ সমর্থন করার জন্য সুযোগ দিয়েছিল। সেই সময়ে, প্রায় ২০ জন ভাই তাদের নিরপেক্ষ পদক্ষেপের কারণে আ্যডিলেডে জেলে ছিল আর শীঘ্রই আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিই। আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রমের কাজ দেওয়া হয়, পাথর খোঁড়া ও রাস্তাঘাট মেরামত করা। এটা আমাকে ধৈর্য এবং দৃঢ়সংকল্পের মতো গুণগুলো গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। আমাদের উত্তম আচরণ এবং দৃঢ় পদক্ষেপ পরিশেষে কারারক্ষীদের অনেককেই আমাদেরকে সম্মান করতে প্রেরণা দিয়েছিল।
কয়েক মাস পরে ছাড়া পাওয়ার পর, আমি আবারও সুস্বাদু খাওয়াদাওয়া উপভোগ করি এবং পুনরায় অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। কিন্তু, অগ্রগামী সঙ্গী দুর্লভ ছিল, তাই আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় দূরবর্তী খামার এলাকায় আমি একা একা কাজ করব কি না। আমি রাজি হই এবং শুধুমাত্র আমার সাক্ষ্যদানের জিনিসপত্র এবং একটা সাইকেল নিয়ে জাহাজে করে ইয়র্ক উপদ্বীপে যাত্রা করি। যখন আমি পৌঁছাই, তখন এক আগ্রহী পরিবার আমাকে একটা ছোট্ট অতিথিশালায় নিয়ে যায়, যেখানে একজন সদয় ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে ছেলের মতো ব্যবহার করেন। দিনের বেলায়, আমি ধুলোবালিপূর্ণ রাস্তাগুলোতে সাইকেল চালিয়ে যেতাম, উপদ্বীপের একদিক থেকে অন্যদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট শহরগুলোতে প্রচার করতাম। দূরবর্তী এলাকাগুলোতে প্রচার করার জন্য, আমি মাঝে মাঝে ছোট হোটেল অথবা অতিথিশালাগুলোতে রাতে থেকে যেতাম। এইভাবে, আমি শত শত কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়েছি এবং অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একা একা পরিচর্যা করে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে আমি কখনও খুব বেশি চিন্তা করিনি আর তাই যখন আমি যিহোবার যত্ন উপভোগ করেছিলাম, তখন আমি তাঁর আরও নিকটবর্তী হয়েছিলাম।
অযোগ্য মনে করার অনুভূতির সঙ্গে মোকাবিলা করা
১৯৪৬ সালে, আমি একটা চিঠি পাই যেটাতে আমাকে ভাইদের দাস (এখন সীমা অধ্যক্ষ বলা হয়) হিসেবে ভ্রমণের কাজ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল নির্ধারিত এক সীমায় বেশ কিছু মণ্ডলী পরিদর্শন করা। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আমি এই কার্যভারের দায়িত্বগুলোকে প্রকৃতপক্ষে এক কঠিন কাজ বলে মনে করেছিলাম। একদিন আমি একজন ভাইকে বলতে শুনি যে, “হ্যারল্ড খুব ভাল বক্তা নন কিন্তু প্রচার কাজে তিনি খুব ভাল।” এই মন্তব্য আমাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছিল। আমি আমার বক্তৃতা দেওয়ার এবং সাংগঠনিক কাজগুলোতে সীমাবদ্ধতাগুলো সম্বন্ধে ভালভাবেই অবগত ছিলাম কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম যে, প্রচার কাজ ছিল খ্রিস্টানদের জন্য মুখ্য কাজ।
১৯৪৭ সালে ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় থেকে ভাই নেথেন নর এবং মিলটন হেনশেলের পরিদর্শন সম্বন্ধে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি বিরাজ করছিল। ১৯৩৮ সালে ভাই রাদারফোর্ড আসার পর প্রধান কার্যালয় থেকে এটা ছিল প্রথম পরিদর্শন। এই পরিদর্শনের সঙ্গে সিডনিতে এক বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অল্পবয়স্ক অন্য অনেক অগ্রগামীর মতো, আমিও মিশনারি প্রশিক্ষণের জন্য আগ্রহী ছিলাম যেটা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিংয়ে সম্প্রতি খোলা ওয়াচটাওয়ার
বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডে দেওয়া হচ্ছিল। আমাদের মধ্যে উপস্থিত বেশ কয়েক জন ভেবেছিলাম যে, নথিভুক্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হবে কি না। কিন্তু, ভাই নর ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, আমরা যদি প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একটা প্রবন্ধ পড়তে পারি এবং মুখ্য বিষয়গুলোকে মনে রাখতে পারি, তা হলে সম্ভবত আমরা গিলিয়েডে কৃতকার্য হব।আমি মনে করেছিলাম যে, আমার সীমিত শিক্ষা হয়তো আমাকে অযোগ্য করবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে কয়েক মাস পরে গিলিয়েড প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে আবেদন করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে, আমাকে একজন ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয় আর আমি ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত ১৬তম ক্লাসে যোগ দিই। এটা এক চমৎকার অভিজ্ঞতা বলে প্রমাণিত হয়েছিল, যা ভীষণভাবে আমার আস্থাকে বৃদ্ধি করেছিল। শিক্ষাগত যোগ্যতা যে সফলতার প্রাথমিক বিষয় ছিল না, সেটা আমার কাছে প্রমাণিত হয়েছিল। এর পরিবর্তে, অধ্যবসায় এবং বাধ্যতা ছিল প্রধান চাহিদা। আমাদের নির্দেশকরা আমাদের সর্বোত্তমটুকু করার জন্য আমাদের উৎসাহিত করেছিল। আমি যখন তাদের উপদেশে মনোযোগ দিয়েছিলাম, আমি ক্রমাগত উন্নতি করেছিলাম এবং খুব ভালভাবেই শিক্ষার পর্ব অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
শুষ্ক মহাদেশ থেকে রত্নবৎ দ্বীপে
গ্র্যাজুয়েশনের পর, অস্ট্রেলিয়া থেকে দুজন ভাই এবং আমাকে সিলোনে (এখন শ্রীলঙ্কা) কার্যভার দেওয়া হয়। ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা রাজধানী শহর কলম্বোতে এসে পৌঁছাই। এটা গরম ও আর্দ্র জায়গা ছিল এবং নতুন নতুন দৃশ্য, শব্দ আর গন্ধ আমাদের ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিয়েছিল। আমরা যখন জাহাজ থেকে নামি, তখন সেই দেশে ইতিমধ্যেই সেবারত মিশনারিদের একজন, সিটি স্কোয়ারে পরের রবিবারে জনসাধারণের উদ্দেশে যে-একটা বক্তৃতা দেওয়া হবে, সেটার বিজ্ঞাপন সম্বলিত একটা হ্যান্ডবিল দিয়ে আমাকে স্বাগত জানান। অবাক হওয়ার বিষয় যে, বক্তা হিসেবে হ্যান্ডবিলে আমারই নাম ছিল! আপনারা নিশ্চয়ই আমার ঘাবড়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারছেন। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়াতে আমার অগ্রগামী কাজের বছরগুলো আমাকে প্রদত্ত যেকোনো কার্যভার গ্রহণ করতে শিখিয়েছে। তাই যিহোবার সাহায্যে, আমি জনসাধারণের বক্তৃতাটি সফলভাবে দিতে পেরেছিলাম। সেই সময়ে কলম্বোর মিশনারি হোমে ইতিমধ্যেই যে-চার জন অবিবাহিত ভাই ছিল, তাদের সঙ্গে আমরা তিন জনও কঠিন সিংহলি ভাষার সঙ্গে মোকাবিলা করতে ও ক্ষেত্রের পরিচর্যায় অংশ নিতে শুরু করি। বেশির ভাগ সময়ই আমরা একা কাজ করতাম আর স্থানীয় লোকেরা সম্মানীয় এবং অতিথিপরায়ণ দেখে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। শীঘ্রই সভাগুলোতে উপস্থিতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
সময় যতই পেরিয়ে যেতে থাকে, আমি আকর্ষণীয় একজন অগ্রগামী বোন সিবেল সম্বন্ধে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে শুরু করি, যার সঙ্গে গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে জাহাজে করে যাত্রা করার সময় আমার পরিচয় হয়েছিল। সে নিউ ইয়র্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য ভ্রমণ করছিল। পরে, সে ২১তম গিলিয়েড ক্লাসে যোগ দিয়েছিল এবং ১৯৫৩ সালে তাকে হংকংয়ে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমি তাকে চিঠিপত্র লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং এভাবে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আমরা যোগাযোগ চালিয়ে গিয়েছিলাম আর সেই বছরই সিবেল সিলোনে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল যেখানে আমরা বিয়ে করেছিলাম।
এক মিশনারি দম্পতি হিসেবে একসঙ্গে আমাদের প্রথম কার্যভার ছিল শ্রীলঙ্কার একেবারে উত্তরে একটা শহর জাফনাতে। ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি, সিংহলি ও তামিল সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ শুরু হয় এবং তা পরবর্তী দশকগুলোতে সশস্ত্র দ্বন্দ্বের ভিত্তি জোগায়। এটা দেখা কতই না হৃদয়গ্রাহী ছিল যে, সেই কঠিন বছরগুলোতে মাসের পর মাস ধরে সিংহলি এবং তামিল সাক্ষিরা একে অপরকে আশ্রয় দিয়েছে! সেই পরীক্ষাগুলো ভাইদের বিশ্বাসকে পরিশোধিত ও শক্তিশালী করেছিল।
শ্রীলঙ্কায় প্রচার করা ও শিক্ষা দেওয়া
হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয়েছিল। তবুও, আমরা সংস্কৃতি ও
তাদের প্রিয় গুণগুলো উভয়ই উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলাম। যেহেতু বিদেশিদেরকে স্থানীয় বাসে যাত্রা করতে দেখাটা অস্বাভাবিক ছিল, তাই আমাদের উপস্থিতি প্রায়ই কৌতূহল জাগিয়ে তুলত। সিবেল ঠিক করেছিল যে, সে মুখে হাসি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এটা দেখা কতই না আনন্দের যে, সেই কৌতূহলী মুখগুলো শীঘ্রই সুন্দর হাসিতে পরিণত হয়েছে!একবার, রাস্তায় একটা অবরোধের সামনে আমাদের থামানো হয়েছিল। কর্মরত রক্ষী আমাদেরকে আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং আমরা কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করার পর, তার প্রশ্নগুলো আরও ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছিল।
“এই ভদ্রমহিলা কে?”
“আমার স্ত্রী,” আমি উত্তর দিয়েছিলাম।
“আপনারা কতদিন বিয়ে করেছেন?”
“আট বছর।”
“আপনাদের কি কোনো ছেলেমেয়ে আছে?”
“না।”
“আশ্চর্য! আপনারা কি ডাক্তার দেখিয়েছেন?”
এই স্বাভাবিক কৌতূহল প্রথম প্রথম আমাদের অবাক করত কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, এটা অন্যদের প্রতি স্থানীয় লোকেদের ব্যক্তিগত আন্তরিক আগ্রহের এক অভিব্যক্তি। বস্তুতপক্ষে, এটা ছিল তাদের সবচেয়ে প্রীতিকর গুণগুলোর মধ্যে একটা। একজন ব্যক্তিকে অল্পক্ষণের জন্য জনসাধারণের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই যেকেউ তার কাছে আসবেন এবং সদয়ভাবে জিজ্ঞেস করবেন যে, তিনি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারেন কি না।
বিভিন্ন পরিবর্তন এবং প্রতিফলন
বছরের পর বছর ধরে, শ্রীলঙ্কায় আমাদের মিশনারি কাজ ছাড়াও আমরা বিভিন্ন কার্যভার উপভোগ করেছি। আমাকে সীমা ও জেলার কাজে এবং শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের মধ্যে, আমার বয়স ৭০ এর মাঝামাঝি ছিল। ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কায় মিশনারি সেবা করার বিষয়ে চিন্তা করার আনন্দ আমার ছিল। কলম্বোতে প্রথম যখন আমি সভায় যোগদান করেছিলাম, তখন সেখানে প্রায় ২০ জন লোক উপস্থিত হয়েছিল। সেই সংখ্যা বেড়ে এখন ৩,৫০০রও বেশি হয়েছে! সিবেল ও আমি এই প্রিয়জনদের অনেককেই আমাদের আত্মিক ছেলেমেয়ে এবং নাতিনাতনি হিসেবে দেখেছি। যাই হোক, সারা দেশে তখনও আরও অনেক কাজ করা বাকি ছিল—যে-কাজের জন্য আমাদের চেয়ে যারা কমবয়সী তাদের শক্তি ও কর্মদক্ষতার প্রয়োজন। এই কথা মাথায় রেখে, আমরা অস্ট্রেলিয়াতে ফিরে যাওয়ার জন্য পরিচালক গোষ্ঠীর কাছ থেকে একটা আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। এটা অল্পবয়স্ক যোগ্য দম্পতিদের মিশনারি হিসেবে আমাদের স্থান গ্রহণ করতে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করার সুযোগ দিয়েছিল।
আমার বয়স এখন ৮২ বছর আর সিবেল ও আমি উভয়েই আনন্দিত যে, আমার আগের বাড়ি আ্যডিলেডে আমাদের বিশেষ অগ্রগামীর পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এখনও যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান। আমাদের পরিচর্যা আমাদেরকে মানসিকভাবে সজাগ এবং নমনীয় রাখে। এ ছাড়া, এটা আমাদেরকে এই দেশে একেবারে আলাদা জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
যিহোবা আমাদের সমস্ত বস্তুগত প্রয়োজনের ক্রমাগত যত্ন নিয়েছেন আর আমাদের স্থানীয় মণ্ডলীর ভাইবোনেরা আমাদের অনেক ভালবাসা ও সমর্থন প্রদান করে। সম্প্রতি আমি একটা নতুন কার্যভার পেয়েছি। আমি আমাদের মণ্ডলীতে সচিব হিসেবে কাজ করি। তাই আমি দেখেছি যে, যিহোবাকে বিশ্বস্তভাবে সেবা করার জন্য যতই আমি প্রচেষ্টা করছি, ততই আমার ক্রমাগত প্রশিক্ষণ হচ্ছে। ফেলে আসা বছরগুলোর কথা চিন্তা করে, আমি সবসময় অবাক হই যে, ঝোপঝাড়ের এক সাধারণ, অসর্তক প্রকৃতির ছেলে এইরকম অপূর্ব শিক্ষা পেতে পারে—যে-শিক্ষা জীবনভর স্থায়ী হয়েছে।
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৫৫ সালে, আমাদের বিয়ের দিনে
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৫৭ সালে, একজন স্থানীয় ভাই রাজন কাদিরগামারের সঙ্গে ক্ষেত্রের পরিচর্যায়
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
আজকে সিবেলের সঙ্গে