সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যদিও দুর্বল, তবুও আমি বলবান

যদিও দুর্বল, তবুও আমি বলবান

জীবন কাহিনী

যদিও দুর্বল, তবুও আমি বলবান

বলেছেন লেওপল্ট ইঙ্গলাইটনা

এসএস অফিসার তার পিস্তলটা বের করে আমার কপালের কাছে ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করেন: “তুই কি মরার জন্য প্রস্তুত? আমি এখনই তোকে গুলি করব কারণ তোকে সাহায্য করে কোনো লাভ নেই।” গলার স্বর অটল রাখার চেষ্টা করে আমি বলেছিলাম, “আমি প্রস্তুত।” নিজেকে শক্ত রেখে আমি আমার চোখ দুটো বন্ধ করি এবং তার গুলি চালানোর অপেক্ষায় থাকি কিন্তু কিছুই ঘটেনি। আমার কপালের কাছ থেকে থেকে বন্দুকটা সরাতে সরাতে তিনি চিৎকার করে বলেন, “তুই এমনকি মরারও যোগ্য না!” কীভাবে আমি এইরকম এক বিপদজনক পরিস্থিতির মধ্যে এসে পড়েছিলাম?

 অস্ট্রিয়ায় আল্পসের দ্বারা পরিবেষ্টিত আইজেন-ফোগলেহুব শহরে, ১৯০৫ সালের ২৩শে জুলাই আমি জন্মগ্রহণ করি। আমার বাবা ছিলেন একজন করাত-কলের কর্মী ও মা ছিলেন স্থানীয় এক কৃষকের মেয়ে আর আমি ছিলাম তাদের সবচেয়ে বড় ছেলে। আমার বাবামা গরিব হলেও, কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি ছিল। আমার শৈশবকাল সল্জ্‌বার্গের কাছে মনোরম হ্রদ এবং চমৎকার পাহাড়-পর্বত ঘেরা জায়গা বাত ইশেলে কেটেছিল।

আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি প্রায়ই জীবনের অন্যায়-অবিচার সম্বন্ধে চিন্তা করতাম আর তা কেবল আমার পরিবার দরিদ্র হওয়ার কারণেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে জন্মানোর জন্য শারীরিকভাবে কষ্টভোগ করছিলাম বলে। এই ব্যাধির জন্য আমার পিঠের যে-যন্ত্রণা হতো, তাতে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। স্কুলে আমাকে জিমনাস্টিকসে ভরতি হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি আর এর ফলে আমি আমার সহপাঠীদের মাঝে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠেছিলাম।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ১৪ বছরে পড়ার অল্প কিছু সময় আগে আমি স্থির করেছিলাম যে, দারিদ্রের কবল থেকে বাঁচার জন্য এখনই আমার কাজ খোঁজা উচিত। অসহ্য ক্ষুধার যন্ত্রণা ছিল আমার নিত্যসঙ্গী আর যে-স্প্যানিস ফ্লু লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল, সেটার কারণে আমাকেও কিছু সময় প্রচণ্ড জ্বরে ভুগতে হয়েছিল বলে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কাজের জন্য যখনই অনুরোধ করতাম, তখন অধিকাংশ কৃষকই এইরকম প্রতিক্রিয়া দেখাত, “তোমার মতো এইরকম দুর্বল লোকের জন্য আমাদের কাছে কী কাজ থাকতে পারে?” কিন্তু একজন দয়ালু কৃষক আমাকে কাজ দেন।

ঈশ্বরের প্রেমের দ্বারা রোমাঞ্চিত

মা যদিও একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে আমার বাবার স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি থাকার দরুন মূলত আমি কদাচিৎ গির্জায় যেতাম। প্রতিমা পূজার বিষয়টা আমাকে বিরক্ত করত, যা রোমান ক্যাথলিক গির্জায় ব্যাপকভাবে করা হতো।

১৯৩১ সালের অক্টোবর মাসের কোনো একদিন, এক বন্ধু আমাকে তার সঙ্গে বাইবেল ছাত্রদের, সেই সময়ে যিহোবার সাক্ষিরা এই নামে পরিচিত ছিল, তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত একটা ধর্মীয় সভায় যেতে বলেন। সেখানে আমাকে বাইবেল থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছিল যেমন: প্রতিমা পূজা কি ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে? (যাত্রাপুস্তক ২০:৪, ৫) অগ্নিময় নরক বলে কি কিছু আছে? (উপদেশক ৯:৫) মৃতেরা কি পুনরুত্থিত হবে?—যোহন ৫:২৮, ২৯.

যে-বিষয়টা আমার ওপর সবচেয়ে বেশি ছাপ ফেলেছিল সেটা ছিল, মানুষের রক্তপিপাসু যুদ্ধগুলোকে ঈশ্বর অনুমোদন করেন না, যদিও সেগুলো এমনকি তাঁর নামে করা হয় বলে বলা হয়ে থাকে। আমি শিখেছিলাম যে, “ঈশ্বর প্রেম” এবং তাঁর এক মহিমান্বিত নাম রয়েছে আর তা হল যিহোবা। (১ যোহন ৪:৮; যাত্রাপুস্তক ৬:৩) আমি এটা জেনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম যে, যিহোবার রাজ্যের মাধ্যমে, পৃথিবীব্যাপী এক পরমদেশে মানুষ চিরকাল সুখে বাস করতে পারবে। এ ছাড়া, আমি কিছু অসিদ্ধ মানুষের সেই অপূর্ব আশা সম্বন্ধেও জেনেছিলাম, যাদেরকে ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্যে যিশুর সঙ্গে সেবা করতে ঈশ্বর আহ্বান জানিয়েছেন। আমি সেই রাজ্যের জন্য যথাসাধ্য করতে প্রস্তুত ছিলাম। তাই, ১৯৩২ সালের মে মাসে আমি বাপ্তিস্ম নিই এবং একজন যিহোবার সাক্ষি হই। সেই সময়ে গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক অস্ট্রিয়ায় বিদ্যমান ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সাহসের প্রয়োজন ছিল।

অবজ্ঞা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়া

আমি গির্জা থেকে ইস্তফা দেওয়ায় আমার বাবামা খুবই আঘাত পায় আর যাজক সঙ্গে সঙ্গে পুলপিট থেকে খবরটা প্রচার করেন। প্রতিবেশীরা তাদের অবজ্ঞা প্রকাশ করতে আমার সামনে মাটিতে থুতু ফেলতো। তা সত্ত্বেও, পূর্ণসময়ের পরিচারকদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম আর আমি ১৯৩৪ সালের জানুয়ারি মাসে অগ্রগামীর কাজ শুরু করি।

আমাদের প্রদেশে নাৎসি দল জোরালো প্রভাব বিস্তার করায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন অস্থির হয়ে পড়ে। ইন্সের স্টিরিয়া উপত্যকায় অগ্রগামীর কাজ করার সময়, পুলিশ আমার পিছনে লেগেই ছিল আর তাই আমাকে “সর্পের ন্যায় সতর্ক” হতে হয়েছিল। (মথি ১০:১৬) ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত, তাড়না আমার দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। যদিও আমি বেকার ছিলাম তবুও, আমাকে বেকার ভাতা দিতে অস্বীকার করা হয় আর আমার প্রচার কাজের জন্য আমাকে কয়েক বার অল্প সময়ের জন্য এবং চার বার দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

হিটলারের সৈন্যবাহিনী অস্ট্রিয়া দখল করে

১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে, হিটলারের সৈন্যবাহিনী অস্ট্রিয়ায় হানা দেয়। কয়েক দিনের মধ্যে, ৯০,০০০রেরও বেশি লোককে—প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশকে—গ্রেপ্তার করা হয় এবং নাৎসি সরকারের বিরোধিতা করার অভিযোগে বিভিন্ন কারাগার ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠান হয়। আসন্ন ঘটনার জন্য যিহোবার সাক্ষিরা কিছুটা হলেও প্রস্তুত ছিল। ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মকালে, আমার প্রথম মণ্ডলীর বেশ কিছু সদস্য একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সাইকেলে করে ৩৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রাগে যাত্রা করে। সেখানে গিয়ে তারা, জার্মানিতে আমাদের সহবিশ্বাসীদের প্রতি দেখানো নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে শোনে। স্পষ্টতই, এখন আমাদের পালা ছিল।

হিটলারের সৈন্যবাহিনী অস্ট্রিয়ায় হানা দেওয়ার দিন থেকেই, যিহোবার সাক্ষিদের সভাগুলো ও প্রচার কাজ বাধ্য হয়ে গোপনে করতে শুরু করা হয়। যদিও সুইস বর্ডার দিয়ে গোপনে বাইবেল সাহিত্যাদি নিয়ে আসা হচ্ছিল কিন্তু প্রত্যেকের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। তাই, ভিয়েনার সহখ্রিস্টানরা গোপনে সাহিত্য ছাপাচ্ছিল। আমি প্রায়ই বাহক হিসেবে কাজ করতাম, সাক্ষিদের কাছে সাহিত্য বিলি করতাম।

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে

১৯৩৯ সালের ৪ঠা এপ্রিলে, বাত ইশেলে খ্রিস্টের মৃত্যুর স্মরণার্থ সভা উদ্‌যাপন করার সময় তিন জন সহখ্রিস্টান ও আমাকে গেসটাপো (জার্মানির গোয়েন্দা পুলিশ) গ্রেপ্তার করে। আমাদের সকলকে গাড়িতে করে লিঞ্জে রাজ্য পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনই আমি প্রথম গাড়িতে চড়ি কিন্তু সেটা উপভোগ করার মতো মানসিকতা আমার ছিল না। লিঞ্জে, আমাকে অনেকবার অতি চরম জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল কিন্তু আমি আমার বিশ্বাস পরিত্যাগ করিনি। পাঁচ মাস পরে, আমাকে উত্তর অস্ট্রিয়ায় বিচারকের সামনে আনা হয়। অপ্রত্যাশিতভাবে, আমার ওপর যে-অপরাধমূলক মামলা জারি করা হয়েছিল তা তুলে নেওয়া হয়; কিন্তু এটাই আমার কঠোর পরীক্ষার শেষ ছিল না। এই সময়ের মধ্যে, অন্য তিন জনকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থেকে মারা গিয়েছিল।

আমাকে হাজতে রাখা হয় আর ১৯৩৯ সালের ৫ই অক্টোবর আমাকে জানানো হয় যে, আমাকে জার্মানিতে বুচেনওয়াল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের অর্থাৎ বন্দিদের জন্য একটা বিশেষ ট্রেন, লিঞ্জ স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। বক্সকারগুলোর মধ্যে দুজন মানুষ থাকার মতো কক্ষ ছিল। যে-লোকটি আমার সঙ্গে কক্ষে ছিলেন তিনি ছিলেন উত্তর অস্ট্রিয়ার প্রাক্তন রাজ্যপাল ড. হেনরিখ গ্লিসনা।

ড. গ্লিসনা আর আমি এক আগ্রহজনক বিষয় নিয়ে কথোপকথন আরম্ভ করেছিলাম। আমার দুঃখজনক অবস্থার প্রতি তিনি আন্তরিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন আর মর্মাহত হয়ে বলেছিলেন যে, এমনকি তিনি রাজ্যপাল থাকার সময়ও যিহোবার সাক্ষিরা তার প্রদেশে অসংখ্য আইনগত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন: “মি. ইঙ্গলাইটনা, যদিও আমি ভুলটা শুধরাতে পারব না কিন্তু আমি ক্ষমা চাইছি। এটা মনে হচ্ছে যে, আমাদের সরকার ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হওয়ার দোষে দোষী। আপনার যদি কখনো কোনো সাহায্যের দরকার হয়, আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করতে খুবই ইচ্ছুক থাকব।” যুদ্ধের পর আমাদের আবার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে নাৎসি ক্ষতিগ্রস্তের জন্য দেওয়া সরকারি অবসর ভাতা পেতে সাহায্য করেছিলেন।

“আমি এখনই তোকে গুলি করব”

১৯৩৯ সালের ৯ই অক্টোবর, আমি বুচেনওয়াল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পৌঁছাই। এর অল্প কিছুদিন পরে, ক্যাম্পের পরিচালককে জানানো হয় যে, নতুনদের মধ্যে একজন সাক্ষি রয়েছে আর তাই আমি তার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠি। তিনি আমাকে নির্মমভাবে প্রহার করেন। এরপর, তিনি যখন উপলব্ধি করেন যে তিনি আমাকে আমার বিশ্বাস পরিত্যাগ করাতে পারবেন না, তখন তিনি বলেছিলেন: “ইঙ্গলাইটনার, আমি এখনই তোকে গুলি করব। কিন্তু তা করার আগে, আমি তোকে তোর বাবামাকে বিদায় জানানোর জন্য একটা কার্ডে কিছু লেখার সুযোগ দিচ্ছি।” আমার বাবামাকে সান্ত্বনা দিয়ে যে-কথাগুলো লিখব, তা আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম কিন্তু আমি লিখতে যাওয়ার সময় প্রতিবারই, তিনি আমার ডান কনুইয়ে আঘাত করার ফলে লেখাগুলো টেরাবাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন: “দেখো, কী মূর্খ! এ এমনকি সোজাভাবে দুটো লাইনও লিখতে পারে না। কিন্তু তাই বলে বাইবেল পড়া তো বন্ধ করেনি, করেছে কি?”

এরপর সেই পরিচালক তার পিস্তল বের করে আমার কপালে ঠেকিয়ে এমন ভাব দেখান যেন এখনই গুলি করবেন, যেমনটা আমি শুরুতে এই ঘটনার কথা বর্ণনা করেছি। এরপর তিনি জোর করে আমাকে ছোট্ট এবং লোকে ঠাসাঠাসি একটা কক্ষের মধ্যে ঢোকান। সেখানে আমাকে সারারাত দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু যা-ই হোক, আমি হয়তো শুতেও পারতাম না কারণ আমার সারা শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছিল। “কোনো বাজে ধর্মের জন্য মৃত্যুবরণ করার কোনো মানে হয় না!” একই কক্ষে থাকা আমার সঙ্গীরা কেবল এই “সান্ত্বনা” দিতে পেরেছিল। ড. গ্লিসনা আমার পাশের কক্ষে ছিলেন। যা ঘটেছিল তা তিনি শুনতে পেয়েছিলেন এবং ভেবেচিন্তে বলেছিলেন, “খ্রিস্টানদের ওপর তাড়না আবারও অপ্রিয় বাস্তব হয়ে উঠছে!”

১৯৪০ সালের গ্রীষ্মকালে, সমস্ত বন্দিকে একটা রবিবারে খনি খোঁড়ার কাজের জন্য উপস্থিত হতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, যদিও রবিবারগুলোতে সাধারণত আমাদের ছুটি থাকত। এটা ছিল কিছু বন্দির “আইনবিরুদ্ধ কাজের” জন্য এক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ। আমাদেরকে খনি থেকে ক্যাম্পে বড় বড় পাথর বয়ে আনার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। দুজন বন্দি আমার পিঠে একটা বিরাট পাথর চাপানোর চেষ্টা করছিল আর তার ভারে আমি প্রায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, ভীত লাগেফুয়েরা (ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক) আরটুর রুডল, অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে বাঁচিয়ে দেন। পাথরটা বয়ে নিয়ে যেতে আমার কষ্টকর প্রচেষ্টা দেখে তিনি আমাকে বলেছিলেন: “ওই পাথরটা পিঠে নিয়ে তুমি কখনোই ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারবে না! এক্ষুণি এটা নীচে রাখো!” এমন একটা আদেশ মেনে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। এরপর রুডল খুব ছোট একটা পাথর দেখিয়ে বলেছিলেন: “ওটা পিঠে নিয়ে ক্যাম্পে যাও। এটা বয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ!” এরপর, আমাদের তত্ত্ববধায়কের দিকে তাকিয়ে তিনি আদেশ দিয়েছিলেন: “বাইবেল ছাত্রদের তাদের ব্যারাকগুলোতে ফিরে যেতে দেওয়া হোক। এক দিনের জন্য তারা যথেষ্ট কাজ করেছে!”

প্রতিদিন কাজের শেষে আমার আধ্যাত্মিক পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করে আমি সবসময় আনন্দিত হতাম। আমাদের আধ্যাত্মিক খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থাদি ছিল। একজন ভাই একটা ছোট কাগজের টুকরোর মধ্যে বাইবেলের একটা পদ লিখতেন আর সেটা অন্যদের কাছে বিতরণ করতেন। এ ছাড়া, গোপনে একটা বাইবেলও ক্যাম্পে পাচার করা হয়েছিল। এটিকে ছিঁড়ে আলাদা আলাদা বইয়ে ভাগ করা হয়েছিল। তিন মাসের জন্য আমাকে ইয়োবের বই দেওয়া হয়েছিল। আমি এটি আমার মোজার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ইয়োবের বিবরণ আমাকে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল।

অবশেষে ১৯৪১ সালের ৭ই মার্চ, আমি একটা বড় রক্ষণাবেক্ষণার্থ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিই, যাদের নিদাহাজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। দিনের পর দিন আমার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। এক দিন, দুজন ভাই ও আমাকে বাক্সগুলোর মধ্যে যন্ত্রপাতি ভরার আদেশ দেওয়া হয়। এটা করার পর, ব্যারাকগুলোতে ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা বন্দিদের অন্য একটা দলের সঙ্গে যোগ দিই। একজন এসএস লক্ষ করেছিলেন যে, আমি পিছনে পড়ে গিয়েছি। তিনি এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, কোনো কিছু না বলেই হঠাৎ করে পিছন থেকে আমাকে নির্মমভাবে লাথি মেরে গুরুতরভাবে আহত করেন। সেই ব্যথা প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমি পরের দিন কাজে গিয়েছিলাম।

অপ্রত্যাশিত মুক্তি

১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে, নিদাহাজেন ক্যাম্পটা অবশেষে অপসারিত হয়। পরে, আমাকে রাভেন্সব্রুকে মৃত্যু শিবিরে পাঠানো হয়। এরপর, ১৯৪৩ সালের জুন মাসে, আমাকে অপ্রত্যাশিতভাবে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এই সময়, এই মুক্তি আমার বিশ্বাস অস্বীকার করার শর্তে ছিল না। আমাকে কেবল আমার জীবনের বাকি দিনগুলোতে একটা খামারে বাধ্যতামূলক শ্রম দেওয়ার জন্য রাজি হতে হয়েছিল। শিবিরের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি তা করতে ইচ্ছুক ছিলাম। আমি শেষবার স্বাস্থ্যগত পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য শিবিরের ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার আমাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। “এখনও তুমি একজন যিহোবার সাক্ষি!” তিনি বিস্ময়ে বলেছিলেন। “আপনার কথা ঠিক, ডাক্তার মহাশয়,” আমি উত্তর দিয়েছিলাম। “এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় না যে, তোমাকে মুক্তি দেওয়ার দরকার আছে। বরং, তোমার মতো এক হতভাগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে মুক্তি পাওয়াই হবে এক ধরনের স্বস্তি।”

তার এই কথাগুলো একটুও বাড়িয়ে বলা হয়নি। আমার শরীরের অবস্থা সত্যিই সংকটজনক ছিল। আমার চামড়ার কিছুটা অংশ উকুনের মতো এক ধরনের পোকায় খেয়ে ফেলেছিল, প্রহারের ফলে আমার একটা কান কালা হয়ে যায় আর আমার পুরো শরীর ফোড়ায় ভরে গিয়েছিল। ৪৬ মাসের বঞ্চনা, অশেষ ক্ষুধা এবং বাধ্যতামূলক শ্রমের পর, আমার ওজন মাত্র ২৮ কিলোগ্রাম হয়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থায়, ১৯৪৩ সালের ১৫ই জুলাই রাভেন্সব্রুক থেকে আমি ছাড়া পেয়েছিলাম।

কোনো প্রহরী ছাড়াই আমাকে এক ট্রেনে করে আমার দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর এরপর লিঞ্জে গেসটাপোর প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে আমি রিপোর্ট করি। একজন গেসটাপো অফিসার আমাকে আমার ছাড়পত্র দিয়ে সাবধান করে দেন: “তুই যদি মনে করিস যে, আমরা তোকে এই জন্য মুক্তি দিচ্ছি যাতে তুই গোপনে তোর কাজ চালিয়ে যেতে পারিস, তা হলে তুই মারাত্মক ভুল করছিস! তুই প্রচার করতে গিয়ে যদি কখনো ধরা পড়িস, তা হলে ঈশ্বরই তোকে বাঁচাবে।”

শেষ পর্যন্ত আমি বাড়িতে আসি! ১৯৩৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল প্রথম আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তখন থেকে আমার মা আমার ঘরের কোনো জিনিসপত্রই সরাননি। এমনকি আমার বিছানার পাশে টেবিলের ওপর আমার বাইবেল খোলা অবস্থায়ই ছিল! আমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই।

শীঘ্রই আমাকে পাহাড়ের ওপর একটা খামারে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই খামারের কৃষক যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু ছিল, সে আমাকে সামান্য মাইনেও দিত, যদিও সে তা দিতে বাধ্য ছিল না। যুদ্ধের আগে, আমার এই বন্ধু আমাকে তার বাড়ির এলাকায় কিছু বাইবেল সাহিত্য লুকিয়ে রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। আধ্যাত্মিকভাবে শক্তি অর্জন করার জন্য গচ্ছিত এই কয়েকটা সাহিত্যের সদ্ব্যবহার করে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার সমস্ত প্রয়োজন মেটানো হয়েছিল এবং এই খামারে থেকে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।

পাহাড়ে লুকানো

কিন্তু মুক্তির সেই শান্ত দিনগুলো বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি, আমাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনীর একজন ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করার আদেশ দেওয়া হয়। প্রথমে, তিনি জানিয়েছিলেন যে, আমার পিঠের অসুস্থতার কারণে আমি সক্রিয়ভাবে কাজ করতে অক্ষম। কিন্তু, এক সপ্তাহ পর সেই একই ডাক্তার তার পরীক্ষালব্ধ বিষয়টাকে পরিবর্তন করে এভাবে পড়েন: “সামনের সারির দক্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে সক্ষম।” কিছু সময়ের জন্য সৈন্যরা আমাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় কিন্তু অবশেষে যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কিছু সময় আগে, ১৯৪৫ সালের ১৭ই এপ্রিল তারা আমাকে খুঁজে পায়। সামনের সারিতে থেকে যুদ্ধ করার জন্য আমাকে জোরপূর্বক সৈন্যদলে ভরতি করা হয়েছিল।

সামান্য খাবার এবং কাপড়চোপড় ও একটা বাইবেল নিয়ে, আমি কাছাকাছি পাহাড়গুলোতে আশ্রয় খুঁজতে থাকি। প্রথম প্রথম, আমি খোলা আকাশের নীচে ঘুমাই কিন্তু আবহাওয়া খুবই খারাপ হতে থাকে আর দুফুট গভীর পর্যন্ত বরফ পড়ে। এর ফলে আমি পুরোপুরি ভিজে যাই। এরপর আমি সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১,২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এক পাহাড়ি কক্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হই। কাঁপতে কাঁপতে, আমি উনানে আগুন জ্বালাই এবং নিজেকে উষ্ণ করতে ও আমার কাপড়চোপড় শুকাতে সক্ষম হই। পরিশ্রান্ত হয়ে, আমি উনানের সামনেই একটা বেঞ্চের ওপর ঘুমিয়ে পড়ি। শীঘ্রই, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি হঠাৎ করে জেগে উঠি। আমার কাপড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল! আগুন নিভানোর জন্য আমি মেঝেতে গড়াগড়ি দিই। আমার পুরো পিঠে ফোসকা পড়ে যায়।

অনেক ঝুঁকি নিয়ে, ভোর হওয়ার আগেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পাহাড়ের খামারে ফিরে আসি কিন্তু কৃষকের স্ত্রী এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি আমাকে এই বলে ফেরত পাঠিয়ে দেন যে, একজন আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। তাই আমি আমার বাবামার কাছে যাই। প্রথমে, এমনকি আমার বাবামা আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে ইতস্তত করছিল কিন্তু অবশেষে তারা আমাকে খড়কুটো রাখার চিলেকোঠায় ঘুমাতে দেয় আর মা আমার ক্ষতস্থানের যত্ন নেন। কিন্তু দুদিন পর, আমার বাবামা আমার উপস্থিতিতে এতটাই ঘাবড়ে যান যে, আমি ঠিক করি আবার পাহাড়ে গিয়ে লুকানো আমার জন্য সবচেয়ে ভাল হবে।

১৯৪৫ সালের ৫ই মে, এক বিকট আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দেখতে পাই যে, মিত্র দেশের বিমানগুলো খুব নীচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে, আমি জানতে পারি যে, হিটলারের সরকারের পতন হয়েছে! এক অবিশ্বাস্য কঠোর পরীক্ষা সহ্য করতে যিহোবার আত্মা আমাকে শক্তিশালী করেছিল। আমি গীতসংহিতা ৫৫:২২ পদের কথাগুলোকে নিজের জীবনে সত্য হতে দেখেছিলাম, যেটা আমার পরীক্ষাগুলোর শুরুতে আমাকে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছে। আমি ‘সদাপ্রভুতে আমার ভার অর্পণ’ করেছিলাম আর যদিও আমি শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল ছিলাম কিন্তু আমি যখন “মৃত্যুচ্ছায়ার উপত্যকা দিয়া” গমন করেছিলাম, তখন তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।—গীতসংহিতা ২৩:৪.

যিহোবার শক্তি “দুর্ব্বলতায় সিদ্ধি পায়”

যুদ্ধের পর, জীবন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। প্রথমে, আমি আমার কৃষক বন্ধুর পাহাড়ের খামারে মজুর হিসেবে কাজ করি। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার সৈন্যরা হস্তক্ষেপ করার পরই আমি আমার জীবনের বাকি দিনগুলো বাধ্যতামূলক কৃষিকাজ করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হই।

যুদ্ধের শেষে, খ্রিস্টান ভাইয়েরা বাত ইশেল এবং আশেপাশের জেলায় নিয়মিতভাবে সভা করতে শুরু করে। পুনরায় শক্তি লাভ করে তারা প্রচার করা শুরু করে। আমি একটা কোম্পানিতে রাত্রে পাহারাদারের কাজ পাই আর ফলে আমি অগ্রগামীর কাজ করে যেতে পারি। শেষে, আমি সেন্ট ভল্ফগাঙ্গ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করি এবং ১৯৪৯ সালে আমি তেরেজিয়া কুর্টস্‌কে বিয়ে করি, যার আগের পক্ষের একটা মেয়ে ছিল। ১৯৮১ সালে, আমার প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যু পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে ৩২ বছর কাটাই। সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি তার যত্ন নিয়েছিলাম।

তেরেজিয়ার মৃত্যুর পর, আমি পুনরায় অগ্রগামীর কাজ শুরু করি যা আমাকে হারানোর অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। বর্তমানে আমি আমার বাত ইশেল মণ্ডলীতে একজন অগ্রগামী এবং প্রাচীন হিসেবে সেবা করছি। যেহেতু আমি হুইলচেয়ারের সাহায্যে চলি, তাই আমি বাত ইশেলের পার্কে অথবা আমার বাড়ির সামনে রাজ্যের আশা সম্বন্ধে লোকেদের সঙ্গে কথা বলি ও বাইবেল সাহিত্য অর্পণ করি। যে-সুন্দর বাইবেল আলোচনাগুলো আমার সঙ্গে হয়ে থাকে, সেগুলো আমার কাছে প্রচুর আনন্দের এক উৎস।

আমার অতীতের ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রমাণ করতে পারি যে, বাধ্য হয়ে যে-সমস্ত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমাকে সহ্য করতে হয়েছে, সেগুলো আমাকে তিক্ত করেনি। অবশ্য, এমন সময় এসেছে যখন আমি পরীক্ষাগুলোর কারণে ভেঙে পড়েছি। কিন্তু, যিহোবা ঈশ্বরের সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক আমাকে সেই ধরনের নেতিবাচক সময়গুলো কাটিয়ে ওঠতে সাহায্য করেছে। “আমার শক্তি দুর্ব্বলতায় সিদ্ধি পায়” পৌলকে দেওয়া প্রভুর এই উপদেশ আমার জীবনেও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন, প্রায় ১০০ বছর বয়সে, আমি প্রেরিত পৌলের সঙ্গে এই কথাগুলো বলতে যোগ দিতে পারি: “খ্রীষ্টের নিমিত্ত নানা দুর্ব্বলতা, অপমান, অনাটন, তাড়না, সঙ্কট ঘটিলে আমি প্রীত হই, কেননা যখন আমি দুর্ব্বল, তখনই বলবান্‌।”—২ করিন্থীয় ১২:৯, ১০.

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে, গেসটাপো গ্রেপ্তার করে

১৯৩৯ সালের মে মাসে, বিভিন্ন অভিযোগসহ গেসটাপো দলিল

[সৌজন্যে]

দুটো ছবিই: Privatarchiv; B. Rammerstorfer

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

নিকটবর্তী পাহাড়গুলো আশ্রয় জুগিয়েছিল

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Foto Hofer, Bad Ischl, Austria