যারা যিহোবার পথে চলে তাদের তিনি প্রচুররূপে পুরস্কৃত করেন
জীবন কাহিনী
যারা যিহোবার পথে চলে তাদের তিনি প্রচুররূপে পুরস্কৃত করেন
বলেছেন রমুয়াল্ট স্ট্যাফ্স্কি
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন উত্তর পোল্যান্ডে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। নয় বছরের এক কৌতূহলী বালক হিসেবে, আমি দেখার জন্য কাছাকাছি একটা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলাম। আমি যা দেখেছিলাম তা ভয়াবহ ছিল—মৃতদেহগুলো মাটিতে স্তূপীকৃত হয়ে ছিল এবং বাতাস শ্বাসরুদ্ধকর ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। যদিও আমি মূলত চিন্তা করছিলাম যে, কী করে নিরাপদে বাড়িতে যাব কিন্তু আমার মনে কিছু প্রশ্ন এসেছিল: “কেন ঈশ্বর এই ধরনের ভয়াবহ বিষয়গুলো ঘটতে দেন? তিনি কোন পক্ষে আছেন?”
যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় কাছাকাছি সময়ে, যুবকদের জার্মান সরকারের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। যে-ই তা প্রত্যাখ্যান করার দুঃসাহস দেখাত, তাকে একটা গাছের অথবা একটা ব্রিজের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হতো আর তার বুকে “রাজদ্রোহী” অথবা “অন্তর্ঘাতী” কথাটা লিখে দেওয়া হতো। আমাদের শহর গিডিনিয়া, বিপক্ষ সৈন্যবাহিনীর মাঝে অবস্থিত ছিল। আমরা যখন জল আনার জন্য শহরের বাইরে গিয়েছিলাম, তখন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে সোঁ সোঁ করে গুলি ও বোমা যাচ্ছিল আর এর আঘাতে আমার ছোট ভাই হেনরিক নিহত হয়েছিল। শোচনীয় পরিস্থিতির দরুন, আমার মা সুরক্ষার জন্য আমাদের চার ভাইবোনকে মাটির নীচে একটা ঘরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আমার দুই বছর বয়সি ভাই, ইউগেনিউশ ডিপথিরিয়ায় মারা গিয়েছিল।
আবারও আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: “ঈশ্বর কোথায়? কেন তিনি এইসমস্ত দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন?” এমনকি যদিও আমি একজন উদ্যোগী ক্যাথলিক ছিলাম এবং নিয়মিতভাবে গির্জায় যেতাম কিন্তু আমি উত্তরগুলো খুঁজে পাইনি।
আমি বাইবেলের সত্য গ্রহণ করেছিলাম
আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর এক অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে এসেছিল। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে, একজন যিহোবার সাক্ষি গিডিনিয়ায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার মা সেই সাক্ষির সঙ্গে কথা বলেছিলেন আর
আমি তাদের কথা কিছুটা শুনেছিলাম। এটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল, তাই আমরা এক খ্রিস্টীয় সভায় যোগদানের আমম্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। যদিও আমি তখনও বাইবেলের সত্য পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারিনি কিন্তু মাত্র এক মাস পর, আমি স্থানীয় সাক্ষিদের একটা দলে যোগ দিয়েছিলাম এবং যুদ্ধ ও নৃশংসতামুক্ত এক উত্তম জগৎ সম্বন্ধে অন্যদের কাছে প্রচার করেছিলাম। এটা আমাকে প্রচুর আনন্দ দিয়েছিল।১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, আমি সপটে একটা সীমা সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। পরের মে মাসে, আমি নিয়মিত অগ্রগামীর পরিচর্যা শুরু করেছিলাম, আমার অধিকাংশ সময়ই অন্যদের কাছে বাইবেলের বার্তা প্রচার করার কাজে ব্যয় করেছিলাম। স্থানীয় পাদরি তীব্রভাবে আমাদের কাজের বিরোধিতা করেছিলেন এবং আমাদের বিরুদ্ধে দৌরাত্ম্যকে উসকে দিয়েছিলেন। একবার, এক ক্রুদ্ধ জনতা আমাদের আক্রমণ করেছিল, আমাদের দিকে পাথর ছুঁড়েছিল এবং আমাদেরকে প্রচণ্ড মারধর করেছিল। আরেকবার, স্থানীয় নান ও পাদরিবর্গ আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য লোকেদের একটা দলকে উসকে দিয়েছিল। আমরা একটা পুলিশ স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিলাম কিন্তু সেই জনতা ভবনটাকে ঘিরে ফেলেছিল, আমাদেরকে মারধর করার ভয় দেখিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আরও পুলিশ অফিসাররা এসেছিল এবং এক সশস্ত্র রক্ষিবাহিনীর সাহায্যে আমাদেরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সেই সময়ে, আমরা যে এলাকায় প্রচার করতাম সেখানে কোনো মণ্ডলী ছিল না। তাই, কখনো কখনো আমরা খোলা আকাশের নীচে জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটাতাম। আমরা আনন্দিত ছিলাম যে, এইরকম পরিস্থিতি সত্ত্বেও, আমরা প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। আজকে, সেই এলাকায় দৃঢ় মণ্ডলীগুলো রয়েছে।
বেথেল পরিচর্যা ও গ্রেপ্তার
১৯৪৯ সালে, আমাকে লড্জ বেথেল হোমে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এইরকম এক জায়গায় পরিচর্যা করা কী এক বিশেষ সুযোগই না ছিল! দুঃখের বিষয় যে, আমি সেখানে বেশিদিন থাকতে পারিনি। ১৯৫০ সালের জুন মাসে, আমাদের কাজের ওপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করার এক মাস আগে, বেথেলের অন্য ভাইদের সঙ্গে আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং ফলস্বরূপ আমি এক নির্মম জেরার মুখোমুখি হয়েছিলাম।
যেহেতু আমার বাবা এমন একটা জাহাজে কাজ করতেন, যেটা নিয়মিতভাবে নিউ ইয়র্কে আসা-যাওয়া করত, তাই তদন্তকারী অফিসাররা আমার মুখ দিয়ে একথা স্বীকার করানোর চেষ্টা করেছিল যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করছিলেন। আমাকে নির্দয় জেরা সহ্য করতে হয়েছিল। এ ছাড়া, চার জন অফিসার একই সময়ে আমাকে দিয়ে ভাই ভিলহেল্ম শাইডারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানোর চেষ্টা করেছিল, যিনি সেই সময় পোল্যান্ডে আমাদের কাজ দেখাশোনা করছিলেন। তারা মোটা লাঠি দিয়ে আমার পায়ের গোড়ালিতে মারতে থাকে। রক্তাক্ত অবস্থায় আমি যখন মেঝেতে পড়ে ছিলাম এবং মনে করেছিলাম যে, আমি আর সহ্য করতে পারব না, তখন আমি আর্তনাদ করে বলেছিলাম, “যিহোবা, আমাকে সাহায্য করো!” আমার নির্যাতনকারীরা অবাক হয়ে গিয়েছিল এবং আমাকে মারধর করা বন্ধ করে দিয়েছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে, তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম এবং পুনরায় শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম। এটা আমাকে এই দৃঢ়প্রত্যয় জুগিয়েছিল যে, যিহোবার উৎসর্গীকৃত দাসেরা যখন তাঁর কাছে আর্তনাদ করে, তখন তিনি প্রেমের সঙ্গে তার প্রতি সাড়া দেন। এটা আমার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল এবং আমাকে ঈশ্বরের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে শিক্ষা দিয়েছিল।
তদন্তের শেষ রিপোর্টে মিথ্যা সাক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, মনে হয়েছিল যেন আমিই সাক্ষ্য দিয়েছি। আমি যখন আপত্তি জানিয়েছিলাম, তখন একজন অফিসার আমাকে বলেছিলেন, “যা বলার তা আদালতে বোলো!” কারাকক্ষের একজন বন্ধুত্বপরায়ণ সঙ্গী আমাকে উদ্বিগ্ন না হতে পরামর্শ দেন, যেহেতু একজন সামরিক উকিলের দ্বারা চূড়ান্ত রিপোর্টটা যাচাই হতে হবে, যেটা আমাকে সেই মিথ্যা সাক্ষ্যকে খণ্ডন করার এক সুযোগ দেবে। সেটাই সত্যি হয়েছিল।
সীমার কাজ এবং আরেক কারাদণ্ড
১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ছাড়া পেয়েছিলাম। এক মাস পর, আমি একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচর্যা শুরু করেছিলাম। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, মণ্ডলীগুলোকে শক্তিশালী করার এবং নিরাপত্তা পুলিশবাহিনীর তৎপরতার কারণে যে-সহসাক্ষিরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাদেরকে সাহায্য করার জন্য অন্য ভাইদের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। ক্রমাগত পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা ভাইবোনদের উৎসাহিত করেছিলাম। পরবর্তী বছরগুলোতে, এই ভাইবোনেরা সাহসের সঙ্গে ভ্রমণ অধ্যক্ষদের সমর্থন করেছিল এবং গোপনে বাইবেল সাহিত্যাদি ছাপানো ও বিতরণের কাজ চালিয়ে গিয়েছিল।
১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসের একদিন, একটা খ্রিস্টীয় সভায় যোগদান করার পর, নিরাপত্তা পুলিশবাহিনী আমাকে রাস্তায় গ্রেপ্তার করে, যারা আমার ওপর কড়া নজর রেখেছিল। যেহেতু আমি তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাই তারা আমাকে বিড্গশের একটা কারাগারে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেই রাতেই আমাকে জেরা করতে শুরু করেছিল। জল ও খাবার ছাড়াই এবং অফিসারদের সিগারেটের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে আমাকে ছয় দিন ছয় রাত একটা দেওয়ালের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আমাকে একটা মুগুর দিয়ে পেটানো হয়েছিল এবং সিগারেটের আগুন দিয়ে ছেঁকা দেওয়া হয়েছিল। আমি যখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, তখন তারা আমার ওপরে জল ঢেলে দিয়েছিল এবং পুনরায় জেরা করেছিল। সহ্য করার জন্য আমি যিহোবার কাছে শক্তি চেয়ে প্রার্থনা করেছিলাম এবং তিনি আমাকে শক্তি জুগিয়েছিলেন।
বিড্গশ কারাগারে থাকার কিছু ভাল দিকও ছিল। সেখানে আমি সেই লোকেদের কাছে বাইবেলের সত্য জানাতে পেরেছিলাম, যাদের কাছে অন্যভাবে পৌঁছানো যেত না। আর সত্যিই, সেখানে সাক্ষ্যদান করার অনেক সুযোগ ছিল। বন্দিরা তাদের দুঃখজনক, বলতে গেলে একেবারে নিরাশাজনক পরিস্থিতির কারণে সহজেই সুসমাচারের প্রতি সাড়া দিয়েছিল।
দুটো গুরত্বপূর্ণ পরিবর্তন
১৯৫২ সালে ছাড়া পাওয়ার পর পরই, একজন উদ্যোগী অগ্রগামী বোন নিলার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সে দক্ষিণ পোল্যান্ডে অগ্রগামীর কাজ করছিল। পরে, সে একটা ‘বেকারিতে’ কাজ করত, যেটা ছিল একটা গুপ্ত স্থান যেখানে আমাদের সাহিত্যাদি ছাপানো হতো। কাজটা অনেক কঠিন ছিল এবং এর জন্য সতর্কতা ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন ছিল। আমরা ১৯৫৪ সালে বিয়ে করি এবং আমাদের মেয়ে লিডিয়ার জন্ম হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমি যাতে ভ্রমণের কাজ চালিয়ে যেতে পারি, সেইজন্য আমরা স্থির করেছিলাম যে, নিলা পূর্ণসময়ের পরিচর্যা বন্ধ করে দেবে এবং বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের মেয়ের দেখাশোনা করবে।
সেই বছরই, আমরা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমাকে এমন এক অঞ্চলে একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচর্যা করতে বলা হয়েছিল, যে-অঞ্চলটা পোল্যান্ডের এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে ছিল। আমরা প্রার্থনাপূর্বক বিষয়টা বিবেচনা করেছিলাম। আমি জানতাম যে, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা ভাইবোনদের শক্তিশালী করা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে, অনেক ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাই সেখানে আধ্যাত্মিক উৎসাহের খুবই প্রয়োজন ছিল। নিলার সমর্থন পেয়ে, আমি কার্যভারটি গ্রহণ করেছিলাম। ৩৮ বছর ধরে একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচর্যা করার জন্য যিহোবা আমাকে সাহায্য করেছেন।
‘বেকারিগুলোর’ ইনচার্জ
সেই সময়ে, জেলা অধ্যক্ষ নির্জন স্থানগুলোতে অবস্থিত ‘বেকারিগুলোর’ দায়িত্বে ছিলেন। পুলিশ সবসময় আমাদের অনুসরণ করত, ছাপাখানা খুঁজে বের করে ছাপার কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করত। কখনো কখনো তারা সফল হয়েছিল কিন্তু আমাদের কখনো প্রয়োজনীয় আধ্যাত্মিক খাদ্যের অভাব হয়নি। এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ছিল যে, যিহোবা আমাদের যত্ন নিচ্ছিলেন।
ছাপার এই কঠিন ও বিপদজনক কাজ করার জন্য আমন্ত্রিত হলে, একজন ব্যক্তিকে অনুগত, সতর্ক, আত্মত্যাগী এবং বাধ্য হতে হতো। এগুলো ছিল সেই গুণাবলি, যেগুলো একটা ‘বেকারিকে’ নিরাপদে কাজ চালিয়ে যেতে সম্ভবপর করেছিল। এ ছাড়া, গোপনে ছাপানোর জন্য একটা ভাল জায়গা খুঁজে পাওয়াও কঠিন ছিল। কিছু জায়গাকে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল কিন্তু সেখানকার ভাইরা তেমন বিচক্ষণ ছিল না। আবার অন্য জায়গাগুলোতে ভাইয়েরা বেশ বিচক্ষণ থাকা সত্ত্বেও জায়গা উপযুক্ত ছিল না। ভাইয়েরা অসাধারণ ত্যাগস্বীকার করতে ইচ্ছুক ছিল। সেই সমস্ত ভাইবোনকে আমি সত্যিই মূল্যবান বলে মনে করি যাদের সঙ্গে আমার কাজ করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল।
সুসমাচারের পক্ষ সমর্থন করা
সেই কঠিন বছরগুলোতে, আমাদেরকে সবসময় অবৈধ, বিধ্বংসী কাজ করার দোষে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা একটা সমস্যা ছিল কারণ আমাদের পক্ষ সমর্থন করার জন্য আমাদের কোনো উকিল ছিল না। কিছু উকিল সহানুভূতিশীল ছিল কিন্তু অধিকাংশই প্রচারণাকে ভয় পেত এবং তারা কর্তৃপক্ষদের অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চাইত না। কিন্তু, যিহোবা আমাদের প্রয়োজন সম্বন্ধে অবগত ছিলেন আর তাই নিরূপিত সময়ে তিনি বিষয়গুলোকে সেই অনুসারে কৌশলে পরিচালনা করেছিলেন।
ক্রেকাউ থেকে আসা একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ এলআইজি প্রসটেককে জেরা করার সময় তার সঙ্গে এত নির্মমভাবে আচরণ করা হয়েছিল যে, তাকে কারাগারের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মুখে তার দৃঢ় পদক্ষেপ তাকে হাসপাতালের অন্যান্য বন্দির সম্মান ও প্রশংসা অর্জন করার যোগ্য করে তুলেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ভিটল্ড লিস-অল্শিভ্স্কি নামে এক উকিল, যিনি ভাই প্রসটেকের সাহস দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বেশ কয়েক বার তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, “আমি ছাড়া পাওয়ার পর পুনরায় আবার আমার ওকালতি শুরু করার অনুমতি পাওয়া মাত্র, আমি যিহোবার সাক্ষিদের পক্ষ সমর্থন করব।” তিনি যা বলেছিলেন তা করেছিলেন।
আ্যটর্নিদের নিয়ে মি. অল্শিভ্স্কির নিজস্ব দল ছিল, যাদের প্রতিশ্রুতি সত্যই প্রশংসনীয় ছিল। যে-সময়ে বিরোধিতা সবচেয়ে তীব্র ছিল, সেই সময়ে তারা প্রত্যেক মাসে প্রায় ৩০টা মামলায় ভাইদের পক্ষ সমর্থন করেছিল—দিনে একটা করে! যেহেতু সমস্ত মামলা সম্বন্ধে মি. অল্শিভ্স্কির ভালভাবে জানা প্রয়োজন, তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য আমাকে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬০ এর দশক থেকে ১৯৭০ এর দশকে, আমি সাত বছর ধরে তার সঙ্গে কাজ করেছিলাম।
সেই সময়ে আইন সংক্রান্ত কাজ সম্বন্ধে আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম। আমি প্রায়ই বিভিন্ন মামলা, উকিলদের মন্তব্য—ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই—আইন সংক্রান্ত পক্ষ সমর্থনের পদ্ধতিগুলো এবং অভিযুক্ত সহবিশ্বাসীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ লক্ষ করতাম। আদালতের সামনে কী বলতে হবে এবং কখন চুপ করে থাকতে হবে, সেই বিষয়ে আমাদের ভাইদেরকে, বিশেষ করে যাদেরকে মামলার সাক্ষি হিসেবে ডাকা হয়েছিল তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে এই সমস্তই খুবই সাহায্যকারী হয়ে উঠেছিল।
একটা মামলা চলাকালীন মি. অল্শিভ্স্কি প্রায়ই যিহোবার সাক্ষিদের বাড়িতে রাত কাটাতেন। তিনি একটা হোটেলে থাকার খরচ বহন করতে পারতেন না তা নয় কিন্তু একবার যেমন তিনি বলেছিলেন, “মামলার আগে, আমি আপনাদের মনোভাবের কিছুটা অর্জন করতে চাই।” তার সহযোগিতার কারণে, অনেক মামলা অনুকূলভাবে শেষ হয়েছিল। তিনি বেশ কয়েক বার আমার পক্ষ সমর্থন করেছিলেন আর তিনি কখনো আমার কাছ থেকে টাকাপয়সা নিতেন না। আরেকবার, তিনি ৩০টা মামলার জন্য টাকাপয়সা নিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কেন? তিনি বলেছিলেন: “আমি আপনাদের কাজে সামান্য অবদান রাখতে চাই।” আর তার ফি সামান্য পরিমাণের অর্থ ছিল না। মি. অল্শিভ্স্কির দলের কাজ কর্তৃপক্ষদের কাছে অলক্ষিত থাকেনি কিন্তু তা তাকে আমাদেরকে সহযোগিতা করা থেকে নিরুৎসাহিত করেনি।
সেই মামলাগুলোর সময়ে আমাদের ভাইয়েরা যে-উত্তম সাক্ষ্য দিয়েছিল, তা বর্ণনা করা কঠিন। অনেকে মামলাগুলো দেখতে এবং অভিযুক্ত ভাইদের শক্তিশালী করতে আদালতে এসেছিল। সেই শীর্ষ সংখ্যক মালমাগুলোর সময়ে, আমি এক বছরে এই ধরনের সমর্থকের ৩০,০০০ জনকে গণনা করেছিলাম। তা নিশ্চিতভাবেই সাক্ষিদের এক বিরাট জনতা ছিল।
এক নতুন কার্যভার
১৯৮৯ সালে আমাদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তিন বছর পর এক নতুন শাখা অফিস নির্মাণ করে তা উৎসর্গীকৃত করা হয়েছিল। সেখানে আমাকে হসপিটাল ইনফরমেশন সারভিসেস এর সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যে-কার্যভারকে আমি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম। তিন জন ব্যক্তির একটা দল হিসেবে কাজ করে, আমরা আমাদের ভাইবোনদেরকে রক্ত সংক্রান্ত বিষয়ের মোকাবিলা করতে সমর্থন করেছিলাম এবং খ্রিস্টীয় বিবেকের ওপর ভিত্তি করে তাদের দৃঢ় প্রেরিত ১৫:২৯.
পদক্ষেপকে সমর্থন করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করেছিলাম।—জনসাধারণ্যের পরিচর্যায়, যিহোবার সেবা করার বিশেষ সুযোগের জন্য আমার স্ত্রী ও আমি খুবই কৃতজ্ঞ। নিলা আমাকে সবসময়ই সমর্থন ও উৎসাহিত করেছে। আমি এইজন্য সবসময়ই কৃতজ্ঞ যে আমি যখন ঈশতান্ত্রিক কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলাম অথবা আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, বাড়িতে আমার অনুপস্থিতির ব্যাপারে সে কখনো অভিযোগ করেনি। কঠিন সময়গুলোতে, সে নিজে ভেঙে না পড়ে অন্যদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৪ সালে, অন্যান্য ভ্রমণ অধ্যক্ষের সঙ্গে আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যে-কয়েক জন ভাই এই সম্বন্ধে জেনেছিল, তারা কোমলভাবে আমার স্ত্রীকে তা জানাতে চেয়েছিল। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তারা জিজ্ঞেস করেছিল, “বোন নিলা, আপনি কি একটা চরম দুঃসংবাদ শোনার জন্য তৈরি আছেন?” প্রথমে সে ভয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিল, কারণ সে ভেবেছিল যে আমি মারা গিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে তা যখন সে জানতে পেরেছিল, তখন স্বস্তির সঙ্গে বলেছিল: “সে তো বেঁচে আছে! এটাই তার প্রথম কারাবরণ নয়।” ভাইয়েরা পরে আমাকে বলেছিল যে, তারা তার ইতিবাচক মনোভাব দেখে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
এমনকি অতীতে যদিও আমাদের কিছু কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল কিন্তু যিহোবা তাঁর পথে চলার জন্য সবসময়ই আমাদের প্রচুররূপে আশীর্বাদ করেছেন। আমরা কতই না আনন্দিত যে, আমাদের মেয়ে লিডিয়া ও তার স্বামী আ্যলফ্রেট দিরুশা, এক উদাহরণযোগ্য খ্রিস্টান দম্পতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। তারা তাদের ছেলে ক্রিস্টোফার ও যোনাথনকে ঈশ্বরের উৎসর্গীকৃত দাস হিসেবে মানুষ করে তুলেছে, যেটা আমাদের আনন্দকে বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া, আমার ভাই রিশের্ড ও আমার বোন উরসুলাও অনেক বছর ধরে বিশ্বস্ত খ্রিস্টান হিসেবে সেবা করে আসছে।
যিহোবা আমাদেরকে কখনো পরিত্যাগ করেননি আর আমরা সর্বান্তঃকরণে তাঁর সেবা করে যেতে চাই। আমরা ব্যক্তিগতভাবে গীতসংহিতা ৩৭:৩৪ পদের কথাগুলো সত্য হতে দেখেছি: “সদাপ্রভুর অপেক্ষায় থাক, তাঁহার পথে চল; তাহাতে তিনি তোমাকে দেশের অধিকার ভোগের জন্য উন্নত করিবেন।” আমাদের সমস্ত চিত্তে আমরা সেই সময়ের জন্য সানন্দে প্রতীক্ষা করে আছি।
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৬৪ সালে ক্রেকাউতে একজন ভাইয়ের বাগানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৬৮ সালে আমার স্ত্রী নিলা ও আমাদের মেয়ে লিডিয়ার সঙ্গে
[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]
রক্ত ছাড়া হার্ট অপারেশনের আগে একজন সাক্ষি ছেলের সঙ্গে
[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]
কাটোভিট্সা হাসপাতালে বাচ্চাদের রক্ত ছাড়া হার্ট অপারেশনের প্রধান সার্জন ড. ওয়াইটস্
[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]
২০০২ সালে নিলার সঙ্গে