আপনি এটাকে ধরে রাখতে পারেন না, তাই এর সদ্ব্যবহার করুন
আপনি এটাকে ধরে রাখতে পারেন না, তাই এর সদ্ব্যবহার করুন
সময় এক মূল্যবান সম্পদ। এটা হচ্ছে বহুল প্রচলিত এক প্রবাদ। যদিও বাস্তবে, সম্পদ অথবা অন্যান্য বস্তুগত বিষয় থেকে সময় অনেক আলাদা। ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য আপনি টাকাপয়সা, খাবারদাবার, জ্বালানি দ্রব্য অথবা অন্যান্য বিষয় যেভাবে আলাদা করে রাখতে পারেন, সময়কে সেভাবে আলাদা করে রাখা যায় না। সময়কে ব্যবহার না করে এটাকে ধরে রাখার যেকোনো চেষ্টাই নিষ্ফল হয়। যদি আপনি আট ঘন্টা ঘুমান আর দিনের বাকি সময় কোনোকিছু না করে এটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন, তা হলে কী হয়? দিনের শেষে, সেই অব্যবহৃত ঘন্টাগুলো আর ফিরে পাওয়া যায় না।
সময়কে একটা বড়, খরস্রোতা নদীর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এটা সবসময় সামনের দিকেই প্রবাহিত হয়। আপনি এর প্রবাহকে থামাতে পারেন না অথবা প্রবাহিত জলের প্রতিটা কণাকে ব্যবহারও করতে পারেন না। শত শত বছর আগে, লোকেরা নদীর তীরে জলচালিত চাকা তৈরি করতে শুরু করেছিল। এই চাকাগুলোর সাহায্যে তারা প্রবাহিত জলকে নিয়ন্ত্রণে এনে শানপাথর, স-মিল, পাম্প এবং দুরমুশ চালানোর জন্য শক্তি উৎপাদন করতে ব্যবহার করেছিল। একইভাবে, আপনি সময়কে ধরে রাখার জন্য নয় বরং উত্তম কাজ সম্পাদনে সময়কে ব্যবহার করার জন্য এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কিন্তু, তা করতে গিয়ে আপনাকে অবশ্যই দুটো প্রধান সময়চোরকে—দীর্ঘসূত্রতা এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে—প্রতিরোধ করতে হবে। আসুন, আমরা প্রথমে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টা বিবেচনা করি।
দীর্ঘসূত্রতা এড়িয়ে চলুন
একটা সুপরিচিত প্রবাদ বলে যে, তুমি আজ যা করতে পারো, তা কখনো কালকের জন্য ফেলে রেখ না। কিন্তু, কিছু লোক এই উপদেশ মেনে চলে না। কোনো কঠিন ও ক্লান্তিকর কাজের মুখোমুখি হলে, তারা দীর্ঘসূত্রতাকেই এক সহজ সমাধান বলে মনে করে। একটি অভিধান অনুসারে, “দীর্ঘসূত্রতা” অর্থ হল, “কার্যাদি সম্পাদনে ইচ্ছাপূর্বক বিলম্ব করা বা গড়িমসি করা।” একজন দীর্ঘসূত্রী ব্যক্তির জন্য কাজ ফেলে রাখা এক অভ্যাসে পরিণত হয়। অনেক বেশি চাপের দ্বারা জর্জরিত হলে তিনি সেই কাজ পরে করবেন বলে স্থগিত রেখে স্বস্তি লাভ করেন এবং তার নতুন “অবসর সময়কে” উপভোগ করেন—সেই সময় পর্যন্ত, যতক্ষণ না আবারও চাপের দ্বারা জর্জরিত হন।
মাঝে মাঝে, আমাদের শারীরিক ও আবেগগত অবস্থার প্রয়োজনে আমরা হয়তো আমাদের কিছু কাজ অথবা এমনকি সমস্ত কাজ স্থগিত রাখি। এ ছাড়া, প্রত্যেকেরই রোজকার তালিকা থেকে মাঝেমধ্যে বিরতির দরকার হয়। এমনকি ঈশ্বরের পুত্রও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। যিশু তাঁর পরিচর্যায় অনেক ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু তারপরও তিনি নিজের ও তাঁর শিষ্যদের জন্য অবসর সময় বের করে নিয়েছিলেন। (মার্ক ৬:৩১, ৩২) এই ধরনের সাময়িক বিরতি উপকারজনক। কিন্তু, দীর্ঘসূত্রতা হল ভিন্ন ব্যাপার; এটা সাধারণত ক্ষতিকর হয়ে থাকে। একটা উদাহরণ বিবেচনা করুন।
গণিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য একজন ছাত্রীর হাতে
তিন সপ্তাহ সময় রয়েছে। তাকে অনেক নোট ও বইপত্র পড়তে হবে। এতে সে চাপ অনুভব করে। দীর্ঘসূত্রতা তাকে প্রলোভিত করে আর সে এর ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সে টেলিভিশন দেখতে শুরু করে। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য তার যা করা দরকার, সে দিনের পর দিন সেটাকে ফেলে রাখে। এরপর পরীক্ষার আগের রাতে, অবশেষে সে পুরো পড়াটা সামনে নিয়ে বসে। ডেস্কে বসে সে তার নোট ও বইপত্র পড়তে শুরু করে।ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়। পরিবারের অন্যান্য সদস্য যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখনও সে জোর করে অনেক সময় ধরে বিভিন্ন সমীকরণ, ত্রিকোণমিতির সূত্র এবং বর্গমূল মুখস্থ করতে থাকে। পরদিন, স্কুলে সে প্রশ্ন নিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়ে কারণ তার ক্লান্ত মন উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে না। সে পরীক্ষায় খুবই কম নম্বর পায় আর সেই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। তাকে আবারও সেই বিষয়বস্তু পড়তে হবে এবং সম্ভবত সে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হবে না।
দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেই ছাত্রীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। কিন্তু বাইবেলের একটি নীতি রয়েছে, যা লোকেদের তার মতো পরিস্থিতি এড়াতে সাহায্য করতে পারে। “তোমরা ভাল করিয়া দেখ, কিরূপে চলিতেছ; অজ্ঞানের ন্যায় না চলিয়া জ্ঞানবানের ন্যায় চল। সুযোগ কিনিয়া লও,” প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন। (ইফিষীয় ৫:১৫, ১৬) পৌল যদিও খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য তাদের সুযোগ বা সময়কে বিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন কিন্তু জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও এই নীতিটি সাহায্যকারী হতে পারে। আমরা সাধারণত নির্ণয় করতে পারি যে একটা কাজ কখন শেষ করতে হবে, তাই সেই কাজটা শুরু করার সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় বেছে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা আরও ভাল ফলাফল দেখতে পাব এবং আরও দ্রুত কাজটা শেষ করতে পারব। শাস্ত্রপদ যেমন দেখায় যে, এটাই হল “জ্ঞানবানের” বৈশিষ্ট্য।
সেই অল্পবয়সি ছাত্রীর ক্ষেত্রে গণিত পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করার সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় কখন হতো? সম্ভবত প্রতি রাতে ১৫ মিনিটের মতো সময় নিয়ে সে অল্প অল্প করে বিষয়বস্তু পড়ে রাখতে পারত। এভাবে পড়লে পরীক্ষার আগের রাতে না বুঝে মুখস্থ করার পরিবর্তে সে বরং সেই সময়ে ঘুমাতে পারত। পরীক্ষার দিন, সে বিশ্রাম নিয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে পারত এবং তার পক্ষে ভাল নম্বর পাওয়া সম্ভব হতো।
তাই, যখন আপনাকে কোনো কাজ দেওয়া হয়, তখন তা করার সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় নির্ধারণ করুন এবং তখনই কাজটা করুন। তা হলেই, আপনি দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদ এবং এর পরিণতিগুলো এড়াতে পারবেন। এ ছাড়া, আপনি একটা কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তিও লাভ করতে পারবেন। এটা বিশেষভাবে সেই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ যখন কাজটা অন্যদের প্রভাবিত করবে যেমন, খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর বিভিন্ন কার্যভার।
অপ্রয়োজনীয় বিষয় পরিহার করুন
আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমাদের মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টা হল অপ্রয়োজনীয় বিষয় এড়িয়ে চলা। আমরা ভাল করেই জানি যে বিভিন্ন বিষয় গোছগাছ করার, সেগুলো ব্যবহার করার, পরিষ্কার করার, সংরক্ষণ করার, দেখাশোনা করার জন্য সময়ের প্রয়োজন। যত বেশি জিনিস থাকে, তত বেশি সময়ের দরকার হয়। খোলামেলা জায়গা ও পরিপাটি ঘরের চেয়ে জিনিসপত্রে বোঝাই একটা রুম বা বাড়িতে কাজ করার জন্য অনেক সময় নষ্ট হয় আর তা করা বিরক্তিকর। এ ছাড়া, যত বেশি জিনিস জমানো হয়, একটা প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে বের করার জন্য তত বেশি সময়ের দরকার হয়।
গৃহরক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ ব্যক্তিরা বলে যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে লোকেরা যে-সময় ব্যয় করে, তার প্রায় অর্ধেকটাই “আবর্জনা ও বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা অন্যান্য জিনিস গোছানোর ও সরানোর” পিছনে নষ্ট হয়ে থাকে। সম্ভবত জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা যায়। তাই, আপনি যদি আপনার সময়কে আরও ভালভাবে ব্যবহার করতে চান, তা হলে আপনার
চারপাশটা খুব ভাল করে লক্ষ করুন। অপ্রয়োজনীয় বিষয় কি আপনার জায়গা পরিপূর্ণ করছে, আপনার চলাফেরায় বাধা দিচ্ছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল, এটা কি আপনার সময় নষ্ট করছে? যদি তা-ই হয়, তা হলে অপ্রয়োজনীয় বিষয় পরিহার করুন।কিন্তু, অপ্রয়োজনীয় বিষয় ফেলে দেওয়া সহজ নয়। অপ্রয়োজনীয় কিন্তু সযত্নে গুছিয়ে রাখা হয়েছে এমন জিনিস ফেলে দেওয়া কঠিন—বলতে গেলে একজন ভাল বন্ধুকে হারানোর মতোই—হতে পারে। তাই একটা জিনিস রাখবেন নাকি ফেলে দেবেন, সেটা কীভাবে আপনি নির্ণয় করতে পারেন? অনেকে এমন নিয়ম করে নেয়: আপনি যদি এক বছর ধরে কোনো জিনিস ব্যবহার না করে থাকেন, তা হলে সেটা ফেলে দিন। এক বছর পরও যদি আপনার সেটা ফেলতে ইচ্ছা না হয়, তা হলে? আরও ছয় মাস এটাকে স্টোর রুমে রেখে দিন। আপনি যখন আবারও এটাকে দেখেন এবং বুঝতে পারেন যে বিগত দেড় বছর ধরে আপনি এটা ব্যবহার করেননি, তখন সেই জিনিসটা ফেলে দেওয়া হয়তো আপনার পক্ষে আরও সহজ হবে। যাই হোক না কেন, উদ্দেশ্য হল অপ্রয়োজনীয় বিষয় কমানো—আপনার সময়কে আরও ভালভাবে ব্যবহার করা।
অবশ্য, অপ্রয়োজনীয় বিষয় শুধু আপনার ঘর অথবা কর্মক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। যিশু “সংসারের চিন্তা ও ধনের মায়া” সম্বন্ধে বলেছিলেন, যা “বাক্য চাপিয়া” রাখতে এবং একজন ব্যক্তিকে সুসমাচারের বিষয়ে “ফলহীন” করতে পারে। (মথি ১৩:২২) একজন ব্যক্তির জীবন অপ্রয়োজনীয় অনেক কাজ ও বিষয়ের দ্বারা এতটাই জর্জরিত হয়ে যেতে পারে যে, তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আধ্যাত্মিক তালিকা ও ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সময় খুঁজে বের করা কঠিন বলে মনে করতে পারেন। ফলস্বরূপ, তিনি আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এবং শেষপর্যন্ত ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত নতুন জগতে প্রবেশ করার সুযোগ পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলতে পারেন, যেখানে প্রকৃত সন্তুষ্টি ও আনন্দ নিয়ে আসে এমন কিছু করার জন্য অফুরন্ত সময় থাকবে।—যিশাইয় ৬৫:১৭-২৪; ২ পিতর ৩:১৩.
আপনি কি এমন একটা তালিকার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অনবরত চেষ্টা করছেন, যেখানে আপনাকে সমস্তকিছু করতেই হবে বলে আপনি মনে করেন—হতে পারে সেগুলো আপনার চাকরি, বাড়ি, গাড়ি, বিভিন্ন শখ, ভ্রমণ, ব্যায়ামের তালিকা, সামাজিক অনুষ্ঠান অথবা অন্যান্য অসংখ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? যদি তা-ই হয়, তা হলে সম্ভবত এখনই বিবেচনা করার সময় যে, আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোতে আরও বেশি সময় দেওয়ার জন্য কীভাবে আপনি আপনার অপ্রয়োজনীয় বিষয় কমাতে পারেন।
আরেকটা সুপরিচিত প্রবাদ হল, সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। বস্তুত, সময় একটা গতিশীল নদীর মতো অপ্রতিরোধ্যভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এটাকে উলটে দেওয়া অথবা ধরে রাখা যায় না; একবার চলে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। কিন্তু, বাইবেলের কিছু সাধারণ নীতি মেনে চলে এবং কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা “বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর” যত্ন নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবহার করতে পারি, যেন আমরা অনন্তকালীন উপকার পাই এবং “এইরূপে যেন ঈশ্বরের গৌরব ও প্রশংসা হয়।”—ফিলিপীয় ১:১০, NW, ১১.
[৮, ৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রবল স্রোতের মতো সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে উত্তম কাজের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে
[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
তার পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করার সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় কখন?
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
অগোছালো জিনিসপত্রে ভরা একটা জায়গায় কাজ করা অনেকটা সময় কেড়ে নেয় এবং বিরক্তিকর হয়