যিহোবা আমাকে জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছেন
জীবন কাহিনী
যিহোবা আমাকে জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছেন
বলেছেন ডেল ইরউইন
“আটটাই যথেষ্ট! জোড়া যমজ, দ্বিগুণ সমস্যা রোজ।” আমাদের চার মেয়ের পরিবারে আরও জোড়া যমজ বাচ্চার জন্মের বিষয়টাকে স্থানীয় একটা সংবাদপত্রের শিরোনামে এভাবেই ঘোষণা করা হয়েছিল। যুবকাবস্থায় আমার মধ্যে বিয়ে করারই কোনো ইচ্ছে ছিল না আর বাবা হওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু, এই আমিই —আট সন্তানের বাবা হয়েছিলাম!
আমি অস্ট্রেলিয়ার মেরিবা শহরে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করি। তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। পরে আমাদের পরিবার ব্রিসবেনে চলে যায়, যেখানে আমার মা মেথডিস্ট গির্জার সানডে স্কুলে শিক্ষা দিতেন।
১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে, স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে খবর বের হয় যে, যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয় থেকে আসা জোসেফ এফ. রাদারফোর্ডকে অস্ট্রেলিয়াতে প্রবেশ করার অনুমতি না-ও দেওয়া হতে পারে। “তার প্রতি কেন তারা এরকম করছে?” মা এই খবর পড়ার পর, পরবর্তী সময়ে যে-সাক্ষি আমাদের বাড়িতে আসেন, তাকে এই কথা জিজ্ঞেস করেন। সেই সাক্ষি উত্তর দেন: “যিশু কি বলেননি যে, লোকেরা তাঁর অনুসারীদের তাড়না করবে?” তারপর মা কিওর নামে একটি পুস্তিকা নেন, যেটিতে সত্য ও মিথ্যা ধর্মের মধ্যে অনেক পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছিল। * সেই পুস্তিকাটি পড়ে অভিভূত হয়ে মা আমাদের সব ভাইবোনকে সঙ্গে নিয়ে পরের রবিবারে যিহোবার সাক্ষিদের একটা সভায় যান। প্রথমে আমার বাবা দৃঢ়ভাবে আপত্তি জানান কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে, বাইবেল থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন লিখে মাকে দিতেন, যাতে তিনি কোনো একজন ভাইকে সেটা দিতে পারেন। পরে, সেই ভাই ওই প্রশ্নগুলোর শাস্ত্রভিত্তিক উত্তর লিখে বাবাকে দেওয়ার জন্য মার কাছে সেটা ফেরত দিতেন।
যিহোবার সাক্ষিদের প্রতি বাবা তার অসন্তোষ প্রকাশ করার জন্য এক রবিবারে তিনি আমাদের সঙ্গে সভাতে আসেন। কিন্তু, যে-ভ্রমণ অধ্যক্ষ সেই সময়ে মণ্ডলী পরিদর্শন করছিলেন, তার
সঙ্গে কথা বলার পর বাবা তার মনোভাব পরিবর্তন করেন আর এমনকি আমাদের বাড়িকে সাপ্তাহিক বাইবেল অধ্যয়নের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতিও দেন, যেখানে আমাদের এলাকার আগ্রহী ব্যক্তিরা উপস্থিত হতো।আমার বাবামা ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাপ্তিস্ম নেয়। আমি ও আমার ভাইবোনেরা ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে, নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনিতে হারগ্রেভ পার্কে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিই। আমার বয়স তখন সাত বছর। তারপর থেকে, আমি আমার বাবামার সঙ্গে নিয়মিতভাবে ক্ষেত্রের পরিচর্যায় অংশ নিয়েছি। সেই সময়ে সাক্ষিরা বহনযোগ্য ফোনোগ্রাফ নিয়ে ঘরে ঘরে যেত আর গৃহকর্তাদের কাছে বাইবেলের বক্তৃতাগুলো বাজিয়ে শোনাত।
বার্ট হর্টন নামে একজন সাক্ষির কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার একটা সাউন্ড কার ছিল—শক্তিশালী লাউডস্পিকারে সজ্জিত একটা মোটরগাড়ি এবং এর ছাদে একটা বড় স্পিকার লাগানো ছিল। বিশেষ করে আমার বয়সি একটা বাচ্চা ছেলের কাছে বার্টের সঙ্গে কাজ করা ছিল রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। উদাহরণস্বরূপ, একটা পাহাড়ের ওপর থেকে বাইবেলের বক্তৃতা সম্প্রচার করার সময়, আমরা প্রায়ই দেখতাম যে পুলিশের গাড়ি আমাদের দিকে আসছে। বার্ট সঙ্গে সঙ্গে তার যন্ত্রপাতি বন্ধ করে, কয়েক কিলোমিটার দূরে অন্য আরেকটা পাহাড়ে চলে যেতেন এবং আরেকটা রেকর্ড বাজাতে শুরু করতেন। বার্ট এবং তার মতো অন্যান্য অনুগত ও সাহসী ভাইদের কাছ থেকে আমি যিহোবার ওপর নির্ভর করার বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছিলাম।—মথি ১০:১৬.
আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন আমি আমার স্কুল ছুটির পর নিয়মিতভাবে একা একাই সাক্ষ্য দিতাম। একবার আ্যডশেড নামে এক পরিবারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের বাবামা, আটজন ছেলেমেয়ে সকলে এবং তাদের অনেক নাতিনাতনি সত্য শেখে। এই চমৎকার পরিবারের কাছে বাইবেলের সত্য জানাতে যিহোবা যে আমার মতো সামান্য এক বাচ্চা ছেলেকে ব্যবহার করেছেন, সেইজন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিই।—মথি ২১:১৬.
অল্পবয়সে পাওয়া পরিচর্যার বিশেষ সুযোগগুলো
১৮ বছর বয়সে আমি একজন পূর্ণসময়ের অগ্রগামী পরিচারক হই এবং আমাকে নিউ সাউথ ওয়েলসের মেইটল্যান্ডে কার্যভার দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে আমি সিডনির অস্ট্রেলিয়া শাখা অফিসে সেবা করার আমন্ত্রণ পাই। সেখানে ২০ জন কর্মীর মধ্যে, প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিল অভিষিক্ত ব্যক্তি, যাদের খ্রিস্টের সঙ্গে তাঁর স্বর্গীয় রাজ্যে শাসন করার আশা ছিল। তাদের সঙ্গে কাজ করা কী এক বিশেষ সুযোগই না ছিল!—লূক ১২:৩২; প্রকাশিত বাক্য ১:৬; ৫:১০.
আমার অবিবাহিত থাকার দৃঢ়সংকল্প ভেঙে যায়, যখন জুডি হেলবার্গ নামে একজন সুন্দরী অগ্রগামী বোনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যাকে শাখা অফিসে এক বড় প্রকল্পে সাময়িকভাবে আমাকে সাহায্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জুডি ও আমি প্রেমে পড়ি আর দুবছর পরে আমরা বিয়ে করি। তারপর, আমরা সীমার কাজ শুরু করি, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ভাইবোনদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রত্যেক সপ্তাহে যিহোবার সাক্ষিদের একটা করে মণ্ডলী পরিদর্শন করা।
১৯৬০ সালে আমাদের প্রথম মেয়ে কিমের জন্ম হয়। আজকের দিনে, বাচ্চা থাকার মানে হল সীমার কাজ ত্যাগ করা ও কোনো একটা জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা। কিন্তু, আমাদের অবাক করে দিয়ে, আমাদের মণ্ডলী পরিদর্শনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেক প্রার্থনা করার পর, আমরা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করি আর পরবর্তী সাত মাস ধরে, কুইন্সল্যাণ্ড ও উত্তর টেরিটোরির দূরবর্তী মণ্ডলীগুলোতে সেবা করার জন্য বাস, প্লেন এবং ট্রেনে করে কিম আমাদের সঙ্গে ১৩,০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করে। সেই সময় আমাদের নিজস্ব কোনো গাড়ি ছিল না।
আমরা সবসময় ভাইবোনদের বাড়িতে থাকতাম। ক্রান্তীয় আবহাওয়ার কারণে সেই সময় বাড়িগুলোতে সাধারণত দরজার পরিবর্তে, পর্দা দেওয়া থাকত, যার ফলে কিম রাতে কাঁদতে থাকলে সেটা আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হতো। একটা শিশুর যত্ন নেওয়ার
দায়িত্ব এবং আমাদের কার্যভার পরিশেষে খুবই কঠিন বলে প্রমাণিত হয়। তাই আমরা ব্রিসবেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করি এবং আমি বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড লেখার কাজ শুরু করি। কিমের জন্মের দুবছর পর পেটিনা নামে আমাদের আরেকটা মেয়ে হয়।দুঃখজনক ঘটনার সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করা
১৯৭২ সালে যখন মেয়েদের বয়স ছিল ১২ ও ১০ বছর, সেই সময় জুডি লসিকা সংক্রান্ত এক ধরনের রোগ হোজ্কীন ডিজিজে মারা যায়। এই ক্ষতি আমাদের পরিবারের জন্য প্রায় অসহনীয় ছিল। তা সত্ত্বেও, জুডির অসুস্থতার সময়ে ও তার মৃত্যুর পরেও যিহোবা তাঁর বাক্য, তাঁর পবিত্র আত্মা এবং ভ্রাতৃসমাজের মাধ্যমে আমাদের সান্ত্বনা প্রদান করেছিলেন। এ ছাড়া, সেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটার ঠিক পরেই আমরা যে-প্রহরীদুর্গ পত্রিকাটি পেয়েছিলাম সেটি থেকেও শক্তি পেয়েছিলাম। এই পত্রিকাটিতে একটা প্রবন্ধ ছিল যেটা ব্যক্তিগত পরীক্ষাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিল, যার মধ্যে প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকের বিষয়ও ছিল এবং সেটা দেখিয়েছিল যে, কীভাবে পরীক্ষাগুলো ধৈর্য, বিশ্বাস ও নীতিনিষ্ঠার মতো ঈশ্বরীয় গুণগুলো গড়ে তুলতে আমাদের সাহায্য করে। *—যাকোব ১:২-৪.
জুডির মৃত্যুর পর, আমার সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, একইসঙ্গে মা ও বাবা উভয়ের ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত কঠিন লড়াই ছিল। তবে আমার চমৎকার মেয়ে দুটো সেই কাজকে অনেকটাই সহজতর করে দিয়েছিল।
পুনর্বিবাহ এবং এক সম্প্রসারিত পরিবার
পরে আমি আবার বিয়ে করি। আমার নতুন স্ত্রী মেরি ও আমার মধ্যে বেশ কয়েকটা দিক দিয়ে মিল ছিল। সেও তার বিবাহসঙ্গীকে হোজ্কীন ডিজিজে হারিয়েছিল। এ ছাড়া, তারও কলিন ও জেনিফার নামে দুটো মেয়ে ছিল। কলিন, পেটিনার থেকে প্রায় তিন বছরের ছোট ছিল। তাই এখন আমাদের পরিবার চার মেয়েকে নিয়ে গঠিত হয়, যাদের বয়স যথাক্রমে ১৪, ১২, ৯ এবং ৭ বছর।
মেরি ও আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সন্তানরা তাদের সৎবাবা বা মায়ের নির্দেশনা গ্রহণ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা দুজনে প্রথম দিকে যে যার নিজ সন্তানদের শাসন করব। আমার ও মেরির, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম ছিল। প্রথমত, আমরা কখনো সন্তানদের সামনে আমাদের মতপার্থক্যগুলো প্রদর্শন করতাম না এবং দ্বিতীয়ত, ইফিষীয় ৪:২৬ পদে লিপিবদ্ধ বাইবেলের নীতির সঙ্গে মিল রেখে, যতক্ষণ না বিষয়গুলোর মীমাংসা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেটা নিয়ে কথা বলে যেতাম—এমনকি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে!
সৎপরিবারের জীবনযাপনের সঙ্গে প্রত্যেকেই বিস্ময়করভাবে মানিয়ে নিয়েছিল কিন্তু আমাদের সঙ্গীদের হারানোর স্মৃতিগুলো আমরা রাতারাতি মুছে ফেলতে পারিনি। উদাহরণস্বরূপ, মেরির জন্য সোমবার রাত ছিল “কান্নার রাত।” আমাদের পারিবারিক অধ্যয়নের পর মেয়েরা যখন শুতে চলে যেত, তখন প্রায়ই মেরি তার চেপে রাখা আবেগে ভেঙে পড়ত।
মেরি চেয়েছিল যেন আমাদের নিজস্ব একটা সন্তান হয়। দুঃখের বিষয় যে, তার গর্ভপাত ঘটে যায়। মেরি যখন আবারও গর্ভবতী হয়, তখন আমাদের জন্য একটা বড় চমক অপেক্ষা করছিল। আ্যলট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় জানা যায় যে, তার গর্ভে একটা নয় কিন্তু চারটে বাচ্চা রয়েছে! আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স ৪৭ বছর আর শীঘ্রই আমি আট সন্তানের বাবা হতে চলেছি! ৩২ সপ্তাহ পর, ১৯৮২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জোড়া যমজ বাচ্চার জন্ম হয়। জন্মের সময় অনুসারে তারা হল ক্লিন্ট, ১.৬ কেজি; সিনডি, ১.৯ কেজি; জেরেমি, ১.৪ কেজি; এবং ড্যানেট, ১.৭ কেজি। একজনও দেখতে একরকম ছিল না।
প্রসবের পর পরই মেরির ডাক্তার এসে আমার পাশে বসেন।
“আপনি কি বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করছেন?” তিনি জিজ্ঞেস করেন।
আমি বলেছিলাম যে, “আমি আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি।”
তার পরের কথাগুলো আমাকে সত্যিই চমকে দিয়েছিল ও উৎসাহিত করেছিল।
“আপনার মণ্ডলী আপনাকে কখনো নিরাশ করবে না,” তিনি বলেছিলেন। “আপনি শুধু একবার হাঁচি দেবেন আর দেখবেন যে, হাজার হাজার টিস্যুপেপার আপনার কাছে উপস্থিত!”
এই বিশিষ্ট ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ ও তার দলের দক্ষতার কারণে মাত্র দুমাসের মধ্য চারটে স্বাস্থ্যবান শিশু হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে এসেছিল।
জোড়া যমজ সন্তানদের বড় করে তোলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা
শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, মেরি ও আমি ২৪ ঘন্টার একটা তালিকা তৈরি করি। বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ার জন্য বড় চার মেয়ে সবচেয়ে সাহায্যকারী ছিল। আর ডাক্তারের সেই কথাগুলো সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল—সামান্য একটা “হাঁচি” দিতেই মণ্ডলী দল বেঁধে আমাদের সাহায্য করার জন্য উপস্থিত হয়েছিল। এর আগে, দীর্ঘদিনের বন্ধু জন ম্যাকআর্থার সাক্ষিদের সংগঠিত করেছিল, যারা আমাদের বাড়ি বড় করার জন্য কারিগর হিসেবে কাজ করেছিল। বাচ্চাদের জন্মের পর এক দল বোন তাদের যত্ন নিতে আমাদের সাহায্য করেছিল। এই সমস্ত দয়া দেখিয়েছিল যে, খ্রিস্টীয় প্রেম কার্যরত।—১ যোহন ৩:১৮.
এক অর্থে, জোড়া যমজ সন্তানরা ছিল “মণ্ডলীর সন্তান।” এমনকি আজ পর্যন্ত যমজ সন্তানরা সেইসব প্রেমময় ভাইবোনদেরকে পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখে থাকে, যারা আমাদের সাহায্য করেছিল। মেরি একজন অসাধারণ স্ত্রী ও মা বলে প্রমাণিত হয়েছে, যে তার সন্তানদের নিঃস্বার্থভাবে যত্ন নিয়েছে। সে ঈশ্বরের বাক্য ও সংগঠন থেকে যা শিখেছে সত্যি সত্যিই তা প্রয়োগ করেছে। এর চেয়ে ভাল পরামর্শ আর কোথাও পাওয়া যায় না!—গীতসংহিতা ১:২, ৩; মথি ২৪:৪৫.
খ্রিস্টীয় সভাগুলো ও প্রচার কাজ আমাদের সাপ্তাহিক তালিকার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অব্যাহত ছিল, যদিও চারটে বাচ্চাকে সামলে তা করা ছিল এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেই সময়ের জন্য একটা আশীর্বাদ ছিল যে, দুজন বিবাহিত দম্পতি, যাদের আমরা বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম তারা অধ্যয়ন করার জন্য সদয়ভাবে আমাদের বাড়িতে আসত। যদিও এটা আমাদের কাজকে কিছুটা সহজতর করে দিয়েছিল, তবুও মেরি মাঝে মাঝে এত ক্লান্ত হয়ে যেত যে, অধ্যয়ন চলাকালে সে তার কোলে থাকা বাচ্চা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। শেষ পর্যন্ত, উভয় দম্পতিই আমাদের আধ্যাত্মিক ভাই ও বোন হয়ে ওঠে।
ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ
এমনকি তারা যখন হাঁটতে পর্যন্ত শেখেনি তখন থেকেই মেরি, বড় মেয়েরা এবং আমি তাদেরকে ক্ষেত্রের পরিচর্যায় সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। তারা যখন সবে হাঁটতে শিখেছে, সেই সময় মেরি দুজনকে ও আমি দুজনকে নিতাম এবং তারা আর বোঝাস্বরূপ ছিল না। বস্তুতপক্ষে, প্রায়ই তারা বন্ধুত্বপরায়ণ গৃহকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করার এক বিষয় হয়ে উঠত। একদিন এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, যিনি দাবি করেছিলেন যে, যদি আপনি একটা নির্দিষ্ট দিনে জ্যোতিষতত্ত্বের অন্তর্গত একটা নির্দিষ্ট রাশিতে জন্মগ্রহণ করেন, তা হলে ওই রাশির নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য আপনার ব্যক্তিত্বে প্রতিফলিত হবে। আমি তার সঙ্গে কোনোরকম তর্ক করিনি কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেদিন সকালেই আবার তার কাছে ফিরে আসতে পারি কি না, তা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি রাজি হয়েছিলেন, তাই আমি জোড়া যমজ সন্তানদের নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলাম। খুব অবাক হয়ে তিনি যখন তাদের দেখছিলেন, আমি তাদেরকে তাদের জন্মের ক্রম অনুসারে লাইন করে দাঁড় করাই। তারপর, শুধুমাত্র তাদের সুস্পষ্ট শারীরিক পার্থক্য নিয়েই নয় কিন্তু তাদের ব্যক্তিত্বের বিশাল পার্থক্য নিয়েও আমাদের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছিল, যা তার তত্ত্বকে খণ্ডন করেছিল। “এই তত্ত্ব আপনার কাছে বলা খুবই হাস্যকর হয়েছে,” তিনি বলেছিলেন, “আমাকে আরও গবেষণা করতে হবে, তাই না?”
ছেলেবেলায় তাদের চারজনকে দলগতভাবে শাসন করলে তারা বিরক্ত হতো, তাই তারা অবাধ্য হলে আমরা তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে সংশোধন করতাম। তা সত্ত্বেও, তারা শিখেছিল যে তাদের সকলের জন্যই একই নিয়ম প্রযোজ্য। স্কুলে যখন তারা বিবেক সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতো, তারা বাইবেলের নীতিগুলোর প্রতি অটল থাকত এবং একে অন্যকে সমর্থন করত আর এই ক্ষেত্রে সিনডি তাদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল। শীঘ্রই লোকেরা তাদের চারজনকে এক শক্তিশালী দল হিসেবে বিবেচনা করেছিল!
কৈশোরের বছরগুলোতে ছেলেমেয়েদেরকে যিহোবার প্রতি অনুগত থাকার জন্য সাহায্য করার ক্ষেত্রে মেরি ও আমি স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর মুখোমুখি হয়েছি। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, এক প্রেমময় মণ্ডলীর সমর্থন ও যিহোবার সংগঠনের দৃশ্যত অংশের কাছ থেকে প্রচুর আধ্যাত্মিক খাদ্য না পেলে এই কাজ আমাদের জন্য আরও অনেক অনেক কঠিন হতো। আমরা নিয়মিত পারিবারিক বাইবেল অধ্যয়ন করার এবং ভাববিনিময়ের দরজা খোলা রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম, যদিও তা সবসময় সহজ ছিল না। তবুও, সেই প্রচেষ্টা আদৌ বিফলে যায়নি কারণ আমাদের আটজন সন্তানই যিহোবাকে সেবা করা বেছে নিয়েছে।
বার্ধক্যের সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করা
বছরের পর বছর ধরে, আমি বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিশেষ সুযোগ উপভোগ করেছি: মণ্ডলীর প্রাচীন, শহর অধ্যক্ষ এবং বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ। আমি স্থানীয় হসপিটাল লিয়েইজন কমিটির সদস্য হিসেবেও সেবা করেছি, যে-কমিটির কাজ হল, রক্ত গ্রহণের বিষয়টা যখন বিতর্কিত বিষয় হয়ে ওঠে, তখন সাক্ষি রোগীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ডাক্তারদের সাহায্য করা। এ ছাড়া, আমি ৩৪ বছর ধরে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার বিশেষ সুযোগ পেয়েছি। আমি প্রায় ৩৫০টা বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি, যেগুলোর মধ্যে আমার ছয় মেয়ের বিয়েও রয়েছে।
আমি প্রথমে জুডি এবং বর্তমানে মেরির কাছ থেকে যে-অনুগত সমর্থন পেয়েছি, তার জন্য যিহোবাকে সবসময় ধন্যবাদ দিই। (হিতোপদেশ ৩১:১০, ৩০) মণ্ডলীর একজন প্রাচীন হিসেবে আমার কাজে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে তারা পরিচর্যায়ও এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছে এবং সন্তানদের মধ্যে আধ্যাত্মিক গুণগুলো গেঁথে দিতে সাহায্য করেছে।
১৯৯৬ সালে আমার মস্তিষ্কের রোগ ধরা পড়ে, যেটার ফলে আমার হাত কাঁপতে থাকে এবং আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। তাই, আমি আর সাইনবোর্ড লেখার কাজ করতে পারি না। কিন্তু, যদিও আমি কিছুটা ধীরগতিতে কাজ করি, তবুও এখনও যিহোবার সেবায় আমি প্রচুর আনন্দ খুঁজে পাই। এর একটা উপকারজনক দিক হচ্ছে, আমি অন্য বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি আরও বেশি সহমর্মিতা গড়ে তুলেছি।
আমার জীবন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই কারণ তিনি সবসময় আমাকে ও আমার পরিবারকে আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে সাহায্য করেছেন। (যিশাইয় ৪১:১০) এ ছাড়া, আমাদের আট সন্তানসহ মেরি ও আমি, আধ্যাত্মিক ভাইবোনদের এক চমৎকার ও সমর্থনকারী পরিবারের জন্যও কৃতজ্ঞ। সকলেই অনেক অনেক উপায়ে তাদের ভালবাসা প্রমাণ করেছে, যা আমরা কখনোই গুণে শেষ করতে পারব না।—যোহন ১৩:৩৪, ৩৫.
[পাদটীকাগুলো]
^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।
^ ১৯৭২ সালের ১৫ই মার্চ প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ১৭৪-৮০ পৃষ্ঠা দেখুন।
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
মা, আমার দাদা গার্থ এবং দিদি ডনের সঙ্গে ১৯৪১ সালে সিডনিতে সম্মেলনে যাওয়ার জন্য তৈরি
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কুইন্সল্যাণ্ডে সীমার কাজে থাকার সময় জুডি ও শিশু কিমের সঙ্গে
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
জোড়া যমজ সন্তানদের জন্মের পর, আমাদের বড় চার মেয়ে ও মণ্ডলী দল বেঁধে আমাদের সাহায্য করার জন্য উপস্থিত হয়েছিল