সৎ হওয়া উপকারজনক
সৎ হওয়া উপকারজনক
সেই এদন উদ্যান থেকেই অসততা বিদ্যমান। তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ সংস্কৃতি ও সমাজে সততার মূল্য রয়েছে এবং মিথ্যা ও প্রতারণাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও নিন্দনীয় হিসেবে দেখা হয়। নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া গর্বের বিষয়। কিন্তু, আধুনিক সমাজে টিকে থাকার জন্য দিন দিন অসততাকে আবশ্যিক বলে মনে করা হয়। এই সম্বন্ধে আপনি কেমন বোধ করেন? সততা কি এমন একটা গুণ, যা গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা করা উপযুক্ত? কোনটা সৎ আচরণ এবং কোনটা নয়, তা নির্ধারণ করার বিষয়ে আপনার মানদণ্ড কী?
ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য আমাদের কথাবার্তা ও জীবনধারায় সৎ হতে হবে। প্রেরিত পৌল সহখ্রিস্টানদের উপদেশ দিয়েছিলেন: “প্রত্যেকে আপন আপন প্রতিবাসীর সহিত সত্য আলাপ করিও।” (ইফিষীয় ৪:২৫) পৌল আরও লিখেছিলেন: “সর্ব্ববিষয়ে সদাচরণ করিতে বাঞ্ছা করিতেছি।” (ইব্রীয় ১৩:১৮) সৎ হওয়ার পিছনে আমাদের উদ্দেশ্য সহমানবদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া নয়। আমরা সৎ কারণ আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে সম্মান করি ও তাঁকে খুশি করতে চাই।
নিজের আসল অবস্থা লুকিয়ে রাখবেন না
অনেক দেশে লোকেরা জীবনে সুযোগ-সুবিধা লাভ করার জন্য নিজেদের ভুলভাবে তুলে ধরে। তারা কোনো একটা দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করার অথবা একটা চাকরি বা যে-পদের জন্য তারা যোগ্য নয়, তা পাওয়ার জন্য প্রতারণামূলক প্রমাণপত্র, ডিপ্লোমা এবং পরিচয়পত্র নিয়ে থাকে। কোনো কোনো বাবামা তাদের সন্তানদের জন্মের জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে, যাতে ছেলেমেয়েরা আরও বেশি সময় ধরে স্কুলে যেতে পারে।
কিন্তু, ঈশ্বরকে খুশি করতে হলে আমরা প্রতারণাপূর্ণ হতে পারি না। বাইবেল বলে যে, যিহোবা হলেন “সত্যের ঈশ্বর” আর তিনি সেই ব্যক্তিদের কাছ থেকে সত্যতা আশা করেন, যাদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা রয়েছে। (গীতসংহিতা ৩১:৫) আমরা যদি যিহোবার সঙ্গে এক নিকট সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই, তা হলে আমরা সেই “অলীক লোকদের” অনুকরণ করতে পারি না, যারা ‘ছদ্মবেশী’ বা নিজের আসল অবস্থা লুকিয়ে রাখে।—গীতসংহিতা ২৬:৪.
এ ছাড়া, অন্যায় কাজের জন্য শাসন লাভ করার সম্ভাবনার মুখোমুখি হলেও, সত্যকে আড়াল করা লোকেদের জন্য খুবই সাধারণ বিষয়। এমনকি খ্রিস্টীয় মণ্ডলীতেও একজন ব্যক্তি তা করার জন্য প্রলুব্ধ হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একটা মণ্ডলীতে একজন যুবক প্রাচীনদের কাছে স্বীকার করেছিল যে, সে কিছু পাপ করেছে। কিন্তু, সে চুরি করার বিষয়টা স্বীকার করেনি, যদিও সে তা করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। অবশেষে তাকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল এবং মণ্ডলী থেকে সমাজচ্যুত করা হয়েছিল। তার জন্য কি সম্পূর্ণরূপে সৎ হওয়া এবং যিহোবার সঙ্গে তার মূল্যবান সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করার জন্য সাহায্য লাভ করা বিজ্ঞতার কাজ হতো না? বস্তুতপক্ষে বাইবেল বলে: “প্রভুর [“যিহোবার,” NW] শাসন তুচ্ছ করিও না, তাঁহার দ্বারা অনুযুক্ত ইব্রীয় ১২:৫, ৬.
হইলে ক্লান্ত হইও না। কেননা প্রভু [“যিহোবা,” NW] যাহাকে প্রেম করেন, তাহাকেই শাসন করেন।”—কখনো কখনো, মণ্ডলীতে দায়িত্বের জন্য আকাঙ্ক্ষী কোনো ভাই হয়তো ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো অথবা অতীতের অশোভন আচরণ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, সেবা করার বিশেষ কোনো সুযোগের জন্য আবেদনপত্র পূরণ করার সময় তিনি হয়তো এই কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্য ও নৈতিকতার বিষয়ে প্রশ্নগুলোর সম্পূর্ণ উত্তর না-ও লিখতে পারেন যে, এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে সত্য কথা লিখলে তিনি হয়তো অযোগ্য হয়ে পড়বেন। তিনি হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন, ‘আমি আসলে মিথ্যার আশ্রয় নিইনি,’ কিন্তু আসলেই কি তিনি অন্যদের সঙ্গে অকপট ও সৎ ছিলেন? হিতোপদেশ ৩:৩২ পদে যে-বিষয়টা তুলে ধরা হয়েছে, তা বিবেচনা করুন: “খল সদাপ্রভুর ঘৃণার পাত্র; কিন্তু সরলগণের সহিত তাঁহার গূঢ় মন্ত্রণা।”
সৎ হওয়ার মানে হল, প্রথমে নিজেদের প্রতি সৎ হওয়া। আমরা যা সঠিক বা সত্য তার পরিবর্তে বরং প্রায়ই সেটা বিশ্বাস করি, যা আমরা বিশ্বাস করতে চাই। নিজেদের দোষকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কত সহজ! উদাহরণস্বরূপ, রাজা শৌল অন্যদের ওপর দোষ চাপানোর মাধ্যমে নিজের অবাধ্যতাকে সত্য বলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে, যিহোবা তাকে রাজা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। (১ শমূয়েল ১৫:২০-২৩) রাজা দায়ূদের থেকে কত আলাদা, যিনি যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন: “আমি তোমার কাছে আমার পাপ স্বীকার করিলাম, আমার অপরাধ আর গোপন করিলাম না, আমি কহিলাম, ‘আমি সদাপ্রভুর কাছে নিজ অধর্ম্ম স্বীকার করিব,’ তাহাতে তুমি আমার পাপের অপরাধ মোচন করিলে।”—গীতসংহিতা ৩২:৫.
সততা আশীর্বাদ নিয়ে আসে
সততা অথবা এর অভাব, অন্যেরা আপনাকে যেভাবে দেখে, সেটার ওপর প্রভাব ফেলে। লোকেরা যদি জানতে পারে যে, এমনকি একবারের জন্য হলেও আপনি তাদেরকে প্রতারিত করেছেন, তা হলে আপনি তাদের নির্ভরতা হারাবেন এবং তা আর সহজে অর্জন করা যায় না। অন্যদিকে, আপনি যদি সত্যবাদী ও সৎ হয়ে থাকেন, তা হলে আপনি এমন নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে সুনাম গড়ে তুলবেন, যার ওপর নির্ভর করা যায়। যিহোবার সাক্ষিরা এইরকম সুনাম অর্জন করেছে। কিছু উদাহরণ বিবেচনা করুন।
একটা কোম্পানির একজন পরিচালক বুঝতে পারেন যে, তার অনেক কর্মী কোম্পানিকে ঠকাচ্ছিল, তাই তিনি পুলিশের সাহায্য চান। তিনি যখন জানতে পারেন যে, যে-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন যিহোবার সাক্ষি কর্মীও রয়েছেন, তখন তিনি পুলিশের কাছে যান, যাতে সেই সাক্ষিকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হয়। কেন? কারণ সেই পরিচালক জানতেন যে, এই ব্যক্তি একজন সৎ কর্মী ছিলেন আর তাই তিনি নির্দোষ। সেই সাক্ষি চাকরিতে বহাল থাকেন আর অন্যদের বরখাস্ত করা হয়। তার সহসাক্ষিরা এটা জেনে আনন্দিত হয়েছিল যে, তার আচরণ যিহোবার নামের জন্য সম্মান নিয়ে এসেছিল।
উত্তম আচরণ অলক্ষিত থাকে না। আফ্রিকার একটা সমাজে এক বিরাট নালার ওপর বিস্তৃত একটা সেতু মেরামত করার প্রয়োজন হয়েছিল কারণ কিছু কাঠের তক্তা চুরি হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় তক্তা লাগানোর জন্য স্থানীয় অধিবাসীরা অর্থ সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু সেই তহবিলের দেখাশোনা করার জন্য কে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হতে পারেন? সকলে একমত হয়েছিল যে, তাকে একজন যিহোবার সাক্ষি হতে হবে।
আফ্রিকার একটা দেশে যখন রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, তখন এক আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত একজন সাক্ষিকে তার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান অন্য জায়গায় বদলি করেছিল, কারণ তার জীবন ঝুঁকির মুখে ছিল। কোম্পানি তার জন্য ততদিন পর্যন্ত তাদের খরচে আরেকটা দেশে অনেক মাস কাজ করার ব্যবস্থা করে, যতদিন পর্যন্ত না পরিস্থিতি শান্ত হয়। কেন? কারণ এর আগে তিনি সেই ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যারা কোম্পানিকে ঠকানোর জন্য চক্রান্ত করছিল। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তার পূর্ণ সততার সুনাম সম্বন্ধে অবগত ছিল। তারা কি এই কর্মীকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক হতো, যদি তিনি সততার ব্যাপারে সন্দেহজনক আচরণ জন্য পরিচিত থাকতেন?
“ধার্ম্মিক আপন সিদ্ধতায় [“নীতিনিষ্ঠায়,” NW] চলে,” হিতোপদেশ ২০:৭ পদ বলে। একজন সৎ ব্যক্তি হলেন একজন নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি কখনো তার সহমানবকে ঠকাবেন না বা তার সঙ্গে প্রতারণা করবেন না। আপনি কি চান না যে, অন্যেরা আপনার সঙ্গে এভাবেই আচরণ করুক? সততা হল সত্য উপাসনার এক অপরিহার্য বিষয়। এটা হল ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের প্রেমের অভিব্যক্তি। সৎ হওয়ার মাধ্যমে আমরা যিশুর বর্ণিত এই আচরণের নীতি অনুসরণ করার আকাঙ্ক্ষা দেখাই: “অতএব সর্ব্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি সেইরূপ করিও।”—মথি ৭:১২; ২২:৩৬-৩৯.
সবসময় সৎ হতে গেলে হয়তো মূল্য দিতে হয় কিন্তু এর ফলে যে-শুদ্ধ বিবেক পাওয়া যায়, সেটা এর ফলে যে-মূল্যই দিতে হোক না কেন, তার চেয়ে মূল্যবান। পরিশেষে, সৎ ও নীতিনিষ্ঠ হওয়ার অনেক উপকার রয়েছে। সত্য বিষয়টা হল, যিহোবার সঙ্গে এক উত্তম সম্পর্ক অমূল্য। লোকেদের সম্মান হারানোর বিষয়টা এড়ানোর অথবা কিছু অবৈধ সুযোগ-সুবিধা অর্জনের জন্য অসৎ বিষয় অবলম্বন করার মাধ্যমে কেন সেই সম্পর্ক নষ্ট করবেন? আমরা যে-প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ভোগ করি না কেন, আমরা গীতরচকের এই কথাগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারি: “ধন্য সেই জন, যে সদাপভুকে আপন বিশ্বাসভূমি করে, এবং তাহাদের দিকে না ফিরে, যাহারা অহঙ্কারী ও মিথ্যাপথে ভ্রমণ করে।”—গীতসংহিতা ৪০:৪.
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
সত্য খ্রিস্টানরা প্রতারণামূলক প্রমাণপত্র কেনে না বা তা ব্যবহারও করে না