প্রাচীন কীলকাকার লিপি এবং বাইবেল
প্রাচীন কীলকাকার লিপি এবং বাইবেল
বাবিলে মানবজাতির ভাষাভেদের পর, বিভিন্ন ধরনের লিখনপদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। মেসোপটেমিয়ায় বসবাসরত লোকেরা যেমন, সুমেরীয় ও বাবিলীয়রা কীলকাকার লিপি ব্যবহার করত। এই শব্দটি “প্রিজমের মতো আকারবিশিষ্ট” চিহ্নের জন্য ব্যবহৃত ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে এবং এটি একটা তীক্ষ্ণ শলাকা, যেটা কাদামাটিতে ছাপ ফেলার জন্য ব্যবহার করা হতো, সেটা দিয়ে তৈরি ত্রিভুজাকৃতির চিহ্নকে নির্দেশ করে।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে যেসমস্ত কীলকাকার লিপির পাঠ্যাংশ আবিষ্কার করেছে, সেগুলো শাস্ত্রে উল্লেখিত লোকেদের ও ঘটনাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করে। এই প্রাচীন লিখনপদ্ধতি সম্বন্ধে আমরা কী জানি? আর এই ধরনের পাঠ্যাংশগুলো বাইবেলের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগায়?
যে-নথিগুলো অক্ষত রয়েছে
পণ্ডিত ব্যক্তিরা মনে করে যে, মেসোপটেমিয়ায় প্রথমদিকে যে-লিখনপদ্ধতি ব্যবহৃত হতো, তা ছিল চিত্রলিপি, যে-পদ্ধতিতে একটা প্রতীক বা চিত্র কোনো শব্দ বা ধারণাকে চিত্রিত করে। উদাহরণস্বরূপ, একটা ষাঁড়কে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত চিহ্নটি দেখতে মূলত একটা ষাঁড়ের মাথার মতোই ছিল। কিন্তু, নথি সংরক্ষণের প্রয়োজন বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কীলকাকার লিপির উদ্ভব হয়েছিল। “চিহ্নগুলো এখন শুধুমাত্র শব্দগুলোকেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে শব্দাংশগুলোকেও চিত্রিত করতে পারে, যেগুলোর বেশ কয়েকটাকে কোনো একটি শব্দের শব্দাংশকে চিত্রিত করার জন্য যুক্ত করা যেতে পারে,” এনআইভি আর্কিঅলজিক্যাল স্টাডি বাইবেল ব্যাখ্যা করে। শেষপর্যন্ত, প্রায় ২০০টি আলাদা আলাদা চিহ্নের কারণে কীলকাকার লিপি “শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণের সমস্ত জটিলতাসহ বাচনভঙ্গিকে সঠিকভাবে প্রকাশ করেছিল।”
সাধারণ কাল পূর্ব প্রায় ২,০০০ সালে অব্রাহামের সময়কালে, কীলকাকার লিপি বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী ২০ শতাব্দী সময়কালের মধ্যে, প্রায় ১৫টি ভাষা এই লিপিকে গ্রহণ করেছিল। যেসমস্ত কীলকাকার লিপির পাঠ্যাংশ পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রায় ১০০ ভাগ লিপিই কাদামাটির ফলকের ওপর লিখিত। বিগত ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঊর, ইউরুক, বাবিল, নিমরুদ, নিপুর, আশূর, নীনবী, মারি, এবলা, উগারিত এবং অ্যামারনাতে এই ধরনের অসংখ্য ফলক পাওয়া গিয়েছে। আর্কিঅলজি অডিসি বর্ণনা করে: “বিশেষজ্ঞরা অনুমান করে যে, খনন করে ইতিমধ্যেই প্রায় দশ থেকে কুড়ি লক্ষের মতো কীলকাকার লিপি ফলক পাওয়া গিয়েছে আর প্রতি বছর ২৫,০০০ কিংবা তারও বেশি ফলক পাওয়া যাচ্ছে।”
পৃথিবীব্যাপী, কীলকাকার লিপি বিষয়ক পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য অনুবাদের এক বিশাল কার্যভার রয়েছে। একটা হিসেব অনুসারে, “জানামতে বিদ্যমান কীলকাকার লিপির পাঠ্যাংশগুলোর মধ্যে প্রায় ১০ ভাগের মাত্র ১ ভাগই আধুনিক সময়ে শুধুমাত্র একবার পড়তে পারা গিয়েছে।”
কীলকাকার লিপির লিখনপদ্ধতিতে দ্বিভাষিক ও ত্রিভাষিক পাঠ্যাংশগুলোর আবিষ্কারই ছিল এই লিপির পাঠোদ্ধার করার চাবিকাঠি। পণ্ডিত ব্যক্তিরা বুঝতে পেরেছে যে, এই নথিগুলোতে একই পাঠ্যাংশ বিভিন্ন ভাষায় রয়েছে, যেগুলোর সবই কীলকাকার লিপির আকারে লেখা। যে-বিষয়টা পাঠোদ্ধার করার পদ্ধতিতে সাহায্য করেছিল, সেটা হল এটা বুঝতে পারা যে, নাম, উপাধি, শাসকদের বংশবৃত্তান্ত আর এমনকি আত্মপ্রশংসার অভিব্যক্তিগুলোকে প্রায়ই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
১৮৫০-এর দশকের মধ্যে পণ্ডিত ব্যক্তিরা, কীলকাকার লিপিতে লিখিত প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য, অ্যাকেদীয় অথবা অ্যাসিরো-বাবিলের প্রচলিত ভাষা পড়তে পেরেছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ব্যাখ্যা করে: “অ্যাকেদীয় ভাষার লিপিটি একবার পাঠোদ্ধার করার ফলে, এই পদ্ধতির উৎস সম্বন্ধে বোধগম্যতা লাভ করা গিয়েছে আর কীলকাকার লিপিতে প্রাপ্ত অন্যান্য ভাষা অনুবাদ করার এক আদর্শ পাওয়া গিয়েছে।” কীভাবে এই লিখনগুলো শাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?
যে-সাক্ষ্যপ্রমাণটি বাইবেলের সঙ্গে মিল রাখে
বাইবেল জানায় যে, সা.কা.পূ. প্রায় ১০৭০ সালে দায়ূদ যিরূশালেম জয় করার আগে পর্যন্ত, সেটা কনানীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। (যিহো. ১০:১; ২ শমূ. ৫:৪-৯) কিন্তু, কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি এই বিষয়ে সন্দেহ করেছিল। যা-ই হোক, ১৮৮৭ সালে, একজন মহিলা কৃষক মিশরের অ্যামারনাতে একটি মাটির ফলক খুঁজে পেয়েছিলেন। পরিশেষে সেখানে প্রাপ্ত প্রায় ৩৮০টি পাঠ্যাংশের অনুবাদ দেখিয়েছিল যে, মিশরের শাসক (আমেনহোটেপ ৩য় ও আখেনাটোন) এবং কনানীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক চিঠিপত্রের আদান-প্রদান ছিল। ছটি চিঠি ছিল যিরূশালেমের শাসক অব্দাই-হিবার কাছ থেকে।
বাইবেল সম্বন্ধীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার পুনরালোচনা (ইংরেজি) জানায়: “যিরূশালেমকে এক এলাকা হিসেবে নয় বরং একটা নগর হিসেবে এবং অব্দাই-হিবার, যার যিরূশালেমে একটা বাসভবন ও ৫০ জন মিশরীয় সৈন্যের এক সামরিক ঘাঁটি ছিল, তার পদকে . . . একজন দেশাধ্যক্ষ হিসেবে, অ্যামারনার ফলকগুলোতে প্রাপ্ত স্পষ্ট উল্লেখ ইঙ্গিত করে যে, যিরূশালেম ছিল একটা ছোটো পাহাড়ি রাজ্য।” সেই একই পত্রিকা পরে জানিয়েছিল: “অ্যামারনার পত্রগুলোর ওপর ভিত্তি করে, আমরা হয়তো নিশ্চিত হতে পারি যে, তখনকার দিনে অন্যান্য নগরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা নগর সেই সময়ে অস্তিত্বে ছিল।
অশূরীয় ও বাবিলীয় নথিগুলোতে বিদ্যমান নামগুলো
অশূরীয়রা ও পরে বাবিলীয়রা তাদের ইতিহাস মাটির ফলক, সেইসঙ্গে বেলনাকার বস্তু, ত্রিপার্শ্বীয় আকৃতির বস্তু এবং স্মৃতিস্তম্ভের ওপর লিখে রেখেছিল। তাই, পণ্ডিত ব্যক্তিরা যখন অ্যাকেদীয় কীলকাকার লিপির পাঠোদ্ধার করেছিল, তখন তারা দেখেছিল যে, পাঠ্যাংশগুলোতে যে-লোকেদের বিষয়ে উল্লেখ করা আছে, বাইবেলেও তাদের নামগুলো রয়েছে।
দ্যা বাইবেল ইন দ্যা ব্রিটিশ মিউজিয়াম বইটি বলে: “১৮৭০ সালে ড. স্যামুয়েল বার্চ নবগঠিত সোসাইটি অভ্ বিবলিক্যাল আর্কিঅলজি-র উদ্দেশে তার বক্তৃতায় [কীলকাকার লিপির পাঠ্যাংশগুলোতে] ইব্রীয় রাজা অম্রি, আহাব, যেহূ, অসরিয়, . . . মনহেম, পেকহ, হোশেয়, হিষ্কিয় এবং মনঃশি, অশূরীয় রাজা তিগ্লৎপিলেষর . . . [৩য়], সর্গোন, সন্হেরীব, এসর-হদ্দোন, অশূরবানীপাল . . . এবং অরামীয় বিন্হদদ, হসায়েল ও রৎসীনের [নাম] শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।”
দ্যা বাইবেল অ্যান্ড রেডিওকার্বন ডেটিং বইটি প্রাচীন কীলকাকার লিপির পাঠ্যাংশগুলোর সঙ্গে ইস্রায়েল ও যিহূদা সম্বন্ধীয় বাইবেলের ইতিহাসের তুলনা করে। এর ফল কী হয়? “সেই সময়কার অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া নথিগুলোতে সবমিলিয়ে যিহূদা ও ইস্রায়েলের ১৫ বা ১৬ জন রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়, যে-নামগুলো [বাইবেলের বই] রাজাবলিতে দেওয়া নাম ও সময়ের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া নথিগুলোতে উল্লেখিত সমস্ত রাজার নাম ইতিমধ্যেই বাইবেলের রাজাবলি বইগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।”
১৮৭৯ সালে প্রাপ্ত কোরস সিলিন্ডার নামে একটি বিখ্যাত কীলকাকার অভিলিখন সাক্ষ্য দেয় যে, সা.কা.পূ. ৫৩৯ সালে বাবিল জয় করার পর, কোরস বন্দিদেরকে তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া সম্বন্ধীয় তার কর্মপন্থা প্রয়োগ করেছিলেন। যারা উপকৃত হয়েছিল, তাদের মধ্যে যিহুদিরা ছিল। (ইষ্রা ১:১-৪) ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বাইবেলে উদ্ধৃত এই আদেশের সত্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু, কোরস সিলিন্ডারসহ পারস্য যুগের কীলকাকার লিপির নথিগুলো, যার অন্তর্ভুক্ত কোরস সিলিন্ডার, এই দৃঢ় প্রমাণ জোগায় যে, বাইবেলের বিবরণ সঠিক।
১৮৮৩ সালে বাবিলের নিকটবর্তী নিপুরে, ৭০০-রও বেশি কীলকাকার লিপির পাঠ্যাংশের এক সংরক্ষণাগার পাওয়া গিয়েছিল। উল্লেখিত ২,৫০০টি নামের মধ্যে প্রায় ৭০টি নামকে যিহুদি হিসেবে শনাক্ত করা যেতে পারে। ইতিহাসবেত্তা এডউইন ইয়ামাউচি বলেন, তারা “চুক্তিকারী দল, প্রতিনিধি, সাক্ষি, করগ্রাহী ও রাজকর্মচারী বলে” প্রতীয়মান হয়। এই সময়কালে যিহুদিরা যে বাবিলের কাছাকাছি জায়গাতে এই ধরনের কাজগুলো করে চলেছিল, সেটার প্রমাণ তাৎপর্যপূর্ণ। এটা বাইবেলের এই ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিবৃতিকে সত্য বলে সমর্থন করে যে, যদিও ইস্রায়েলের “অবশিষ্টাংশ” অশূর ও বাবিলের বন্দিত্ব থেকে যিহূদিয়াতে ফিরে এসেছিল কিন্তু অনেকে ফিরে আসেনি।—যিশা. ১০:২১, ২২.
সাধারণ কাল পূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের সময়ে, বর্ণের দ্বারা লিখিত লিপির পাশাপাশি কীলকাকার লিপিরও অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু, পরিশেষে অশূরীয় ও বাবিলীয় লোকেরা বর্ণানুক্রমিক লিপি গ্রহণ করায় কীলকাকার লিপিকে বাদ দিয়েছিল।
জাদুঘরে সংরক্ষিত হাজার হাজার ফলক এখনও গবেষণা করা বাকি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই যে-ফলকগুলোর পাঠোদ্ধার করেছে, সেগুলো বাইবেলের নির্ভরযোগ্যতার দৃঢ় সাক্ষ্যপ্রমাণ জুগিয়েছে। যে-পাঠ্যাংশগুলোকে এখনও গবেষণা করা হয়নি, সেগুলো আরও কোন অতিরিক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাবে, তা কে জানে?
[২১ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
Photograph taken by courtesy of the British Museum