‘সদাপ্রভু তাহাদের প্রতি আপন মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন’
‘সদাপ্রভু তাহাদের প্রতি আপন মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন’
মানুষের মুখমণ্ডলে ৩০টারও বেশি পেশি রয়েছে। শুধু আপনার হাসির জন্যই ১৪টা পেশিকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়! এই পেশিগুলো ছাড়া আপনার কথোপকথন কেমন হবে, তা একটু কল্পনা করুন। তা কি আবেদনময় হবে? কখনোই না। কিন্তু বধির ব্যক্তিদের জন্য মুখমণ্ডলের পেশিগুলো, কথোপকথনকে প্রাণবন্ত করে তোলার চেয়ে আরও বেশি কিছু করে থাকে। যখন সেগুলো শারীরিক অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সেগুলো চিন্তাভাবনা ও ধারণাকে প্রকাশ করার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে। সাংকেতিক ভাষা যেভাবে এমনকী প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বিষয়সহ জটিল চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রকাশ করতে পারে, তা দেখে অনেকে বিস্মিত হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশ্বব্যাপী বধির ব্যক্তিরা এমন এক মুখমণ্ডল দেখতে পেয়েছে, যা যেকোনো মানব মুখমণ্ডলের চেয়ে অভিব্যক্তিতে এবং বর্ণবৈচিত্র্যে আরও সমৃদ্ধ। রূপকভাবে বললে, তারা ‘প্রভুর সম্মুখ [‘যিহোবার মুখমণ্ডল,’ NW]’ দেখতে পেয়েছে। (বিলাপ ২:১৯) এটা হঠাৎ করেই ঘটেনি। যিহোবা দীর্ঘসময় ধরে বধির ব্যক্তিদের প্রতি মহৎ প্রেম দেখিয়ে আসছেন। তিনি এমনকী অনেক আগে, প্রাচীন ইস্রায়েল জাতির সময় থেকেই তা দেখিয়ে আসছেন। (লেবীয়. ১৯:১৪) আধুনিক সময়েও, বধির ব্যক্তিদের জন্য তাঁর প্রেম খুবই স্পষ্ট হয়েছে। “[ঈশ্বরের] ইচ্ছা এই, যেন সমুদয় মনুষ্য পরিত্রাণ পায়, ও সত্যের তত্ত্বজ্ঞান পর্য্যন্ত পঁহুছিতে পারে।” (১ তীম. ২:৪) বস্তুতপক্ষে, ঈশ্বর সম্বন্ধীয় সত্যের তত্ত্বজ্ঞান বা সঠিক জ্ঞান নেওয়ার দ্বারা অনেক বধির ব্যক্তি তাঁর মুখমণ্ডল দেখতে পেয়েছে। বধির ব্যক্তিরা শুনতে না পেরেও কীভাবে তা করতে সক্ষম হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, আসুন আমরা বিবেচনা করি বধির লোকেদের জন্য সাংকেতিক ভাষা কেন গুরুত্বপূর্ণ।
দর্শনেই শ্রবণ
বধির লোকেদের এবং সাংকেতিক ভাষা সম্বন্ধে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। আসুন সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা আমরা শুধরে নিই। বধির ব্যক্তিরা গাড়ি চালাতে পারে। তাদের পক্ষে ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে কথা বোঝা খুবই কঠিন। সাংকেতিক ভাষার সঙ্গে ব্রেইলের কোনো মিল নেই আর এটা নিছক নির্বাক অভিনয় নয়। সর্বজনীন সাংকেতিক ভাষা বলে কিছু নেই। অধিকন্তু, সংকেত দেওয়ার সময় বধির ব্যক্তিদের নিজস্ব আঞ্চলিক বাচনভঙ্গি রয়েছে।
বধির ব্যক্তিরা কি পড়তে পারে? যদিও কেউ কেউ ভালো পড়তে পারে, কিন্তু সত্য বিষয়টা হল অধিকাংশ বধির ব্যক্তিরই পড়তে অসুবিধা হয়। কেন? কারণ ছাপানো পৃষ্ঠায় যা রয়েছে, সেটার উৎস হল কথ্য ভাষা। শোনার ক্ষমতা রয়েছে এমন একটা বাচ্চা কীভাবে ভাষা শেখে, তা বিবেচনা করুন। জন্মের মুহূর্ত থেকেই সে এমন লোকেদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, যারা স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। অল্প সময়ের মধ্যেই, সে শব্দগুলোকে একসঙ্গে যুক্ত করতে এবং বাক্য গঠন করতে সক্ষম হয়। যে-ভাষাটা বলা হয়, তা শুধুমাত্র শোনার মাধ্যমে এটা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকে। তাই, শুনতে সক্ষম বাচ্চারা যখন পড়তে শুরু করে, তখন যে-বিষয়টা শিখতে হয় তা হল, পৃষ্ঠার কালো অক্ষরগুলো সেই ধ্বনি ও শব্দগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, যেগুলো তারা ইতিমধ্যেই জানে।
এখন নিজেকে বিদেশে কাচের তৈরি শব্দ নিরোধক এক কক্ষের মধ্যে কল্পনা করুন। আপনি কখনো স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে শোনেননি। প্রতিদিন স্থানীয় লোকেরা আপনার কাছে এসে কাচের মধ্যে দিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। তারা কী বলছে, আপনি তা শুনতে পান না।
আপনি শুধু দেখেন যে, তাদের ঠোঁট নড়ছে। আপনি যে তাদের কথা বুঝতে পারছেন না তা উপলব্ধি করে তারা সেই একই শব্দগুলো এক টুকরো কাগজে লেখে এবং তারা যা লিখেছে, তা কাচের মধ্যে দিয়েই আপনাকে দেখায়। তারা মনে করে যে, আপনি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারবেন। কতটা ভালোভাবে আপনি তা বুঝতে পারবেন বলে আপনি মনে করেন? এই পরিস্থিতিতে আপনি হয়তো ভাববিনিময় করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করবেন। কেন? কারণ যা লেখা রয়েছে তা এমন এক ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যে-ভাষা আপনি কখনো বলতে শোনেননি। অধিকাংশ বধির ব্যক্তি ঠিক একই পরিস্থিতিতে নিজেদের দেখতে পায়।বধির লোকেদের জন্য সাংকেতিক ভাষা হল ভাববিনিময় করার এক নিখুঁত মাধ্যম। একজন ব্যক্তি ধারণাগুলো তুলে ধরার জন্য তার দেহের চারপাশের ফাঁকা জায়গাতে সংকেত ব্যবহার করে থাকে। সেই ফাঁকা জায়গাতে তার নড়াচড়া ও সেইসঙ্গে তার মৌখিক অভিব্যক্তি সাংকেতিক ভাষার ব্যাকরণের নিয়মগুলোকে অনুসরণ করে। এভাবে এক চাক্ষুষ ভাষা গঠিত হয়, যার ফলে চোখের সামনে তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব হয়।
বস্তুতপক্ষে, একজন বধির ব্যক্তি সংকেত দেওয়ার সময় তার হাত, দেহ এবং মুখমণ্ডল দিয়ে যে-প্রত্যেকটা অঙ্গভঙ্গি করে থাকেন, তার প্রায় প্রত্যেকটারই অর্থ রয়েছে। মৌখিক অভিব্যক্তিগুলো শুধুমাত্র নাটকীয় প্রভাব ফেলার জন্য করা হয় না। সেগুলো হল সাংকেতিক ভাষার ব্যাকরণের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উদাহরণস্বরূপ: ভ্রূ উঁচু করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে, তা হয় এমন প্রশ্নকে নির্দেশ করে, যার উত্তর চাওয়া হয় না নতুবা এমন কোনো প্রশ্নকে নির্দেশ করে, যেটার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না বলার দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যদি ভ্রূ নামানো থাকে, তাহলে তা কে, কী, কোথায়, কখন, কেন বা কীভাবে প্রশ্নকে নির্দেশ করতে পারে। মুখের নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গভঙ্গি হয়তো কোনো বস্তুর আকার বা কোনো কাজের ব্যাপকতাকে নির্দেশ করতে পারে। একজন বধির ব্যক্তি যেভাবে তার মাথা নাড়েন, কাঁধ তোলেন, গাল নাড়াচাড়া করেন এবং চোখ খোলেন ও বন্ধ করেন এইসবই যে-চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে যোগ করে।
এই শারীরিক অঙ্গভঙ্গিগুলো দর্শককে তথ্যটা অত্যন্ত উপভোগ্য এক উপায়ে বুঝতে সাহায্য করে। যে-বধির ব্যক্তিরা সাংকেতিক ভাষা ভালোভাবে জানে, তারা বৈচিত্র্যময় এই অভিব্যক্তিগুলো ব্যবহার করে যেকোনো ধারণা—কাব্যিক থেকে পারিভাষিক, রোমান্টিক থেকে রসিকতাপূর্ণ, বাস্তব থেকে অবাস্তব ধারণা—প্রকাশ করার জন্য সজ্জিত থাকে।
সাংকেতিক ভাষার প্রকাশনাদি প্রভাব ফেলে
যিহোবা বিষয়ক জ্ঞান যখন সাংকেতিক ভাষায় চাক্ষুষভাবে প্রকাশ করা হয়, তখন একজন বধির ব্যক্তি মূলত সেই বার্তা শুনতে এবং বার্তার উদ্যোক্তার ওপর ‘বিশ্বাস করিতে’ সমর্থ হন। তাই, বিশ্বব্যাপী বধির লোকেদের কাছে প্রচার করার এবং তাদের উপকারার্থে বিষয়বস্তু জোগানোর জন্য যিহোবার সাক্ষিরা অধ্যবসায়ী প্রচেষ্টা করেছে। (রোমীয় ১০:১৪) বর্তমানে, সারা পৃথিবীতে ৫৮টা সাংকেতিক ভাষার অনুবাদ দল রয়েছে এবং ডিভিডি-তে সাংকেতিক ভাষার প্রকাশনাদি এখন ৪০টা ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে। এইসমস্ত কাজ কি সার্থক হয়েছে?
জেরেমি, যার বাবা-মা দুজনেই বধির, তিনি বলেন: “আমার মনে আছে যে, আমার বাবা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একটি প্রবন্ধের শুধু কয়েকটা অনুচ্ছেদ বোঝার চেষ্টায় সেগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা তার শোবার ঘরে ব্যয় করছিলেন। হঠাৎ তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং
উত্তেজিত হয়ে সাংকেতিক ভাষায় বোঝান যে: ‘আমি বুঝতে পেরেছি! আমি বুঝতে পেরেছি!’ তারপর আমার কাছে তিনি বিষয়বস্তুর অর্থ ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। তখন আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। আমি অনুচ্ছেদটি একঝলক দেখি, তারপর সাংকেতিক ভাষায় বোঝাই: ‘বাবা, আমার মনে হয় অর্থটা তা নয়। এটার অর্থ হল . . . ’ তিনি আমাকে থামতে ইশারা করেন এবং নিজে নিজে সেই লিখিত পাঠ্যাংশের অর্থ বের করার জন্য তার ঘরে ফিরে যান। তার চেহারায় যে-হতাশার ছাপ দেখা গিয়েছিল এবং তাকে তার শোবার ঘরে ফিরে যেতে দেখে আমি যে-শ্রদ্ধা বোধ করেছিলাম, তা আমি কখনো ভুলবো না। কিন্তু, ডিভিডি-তে সাংকেতিক ভাষার প্রকাশনাদি পাওয়া যায় বলে এখন তার পক্ষে তথ্যগুলো আরও ভালোভাবে বোঝা সম্ভবপর হয়েছে। যিহোবা সম্বন্ধে তিনি কেমন অনুভব করেন তা প্রকাশ করার সময় তার চেহারায় যে-আনন্দময়, অভিব্যক্তিপূর্ণ দৃষ্টি দেখা যায়, সেটাকে আমি হালকাভাবে নিই না।”এ ছাড়া, এক সাক্ষি দম্পতির অভিজ্ঞতাটাও বিবেচনা করুন, যারা চিলিতে হেসেনিয়া নামে একজন বধির যুবতীর সঙ্গে কথা বলেছিল। হেসেনিয়াকে চিলির সাংকেতিক ভাষায় আমার বাইবেলের গল্পের বই—ডিভিডি-তে দেখানোর জন্য তার মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার পর, তারা রিপোর্ট করেছিল: “হেসেনিয়া যখন গল্পটা দেখতে শুরু করেছিল, তখন সে প্রথমে হাসতে শুরু করে এবং তারপর কাঁদতে থাকে। তার মা যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে কেন সে কাঁদছে, তখন সে উত্তর দিয়েছিল যে, সে যা দেখছে, তা তার ভালো লাগছে। তার মা তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, ডিভিডি-তে দেখা সবকিছু সে বুঝতে পেরেছিল।”
ভেনেজুয়েলার এক গ্রাম্য এলাকায় একজন বধির ভদ্রমহিলা বাস করতেন, যার একটি সন্তান ছিল এবং তার গর্ভে আরেকটি সন্তান ছিল। তিনি ও তার স্বামী মনে করেছিলেন যে, আর্থিক কারণে আরেকটি সন্তানের ভরণপোষণ করার সামর্থ্য তাদের নেই আর তাই তারা গর্ভপাত করানোর কথা চিন্তা করছিল। এইসমস্ত বিষয় সম্বন্ধে কিছু না জেনেই যিহোবার সাক্ষিরা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল এবং তাদেরকে ভেনেজুয়েলার সাংকেতিক ভাষায় ঈশ্বর আমাদের কাছ থেকে কী চান? ভিডিও থেকে পাঠ ১২ দেখিয়েছিল। এই পাঠ গর্ভপাত এবং হত্যা সম্বন্ধে ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে। পরে, সেই ভদ্রমহিলা সাক্ষিদের বলেছিলেন যে, সেই পাঠ অধ্যয়ন করতে পেরে তিনি কতখানি কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এর ফলে তারা গর্ভপাত না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ডিভিডি-তে সাংকেতিক ভাষার একটি প্রকাশনার জন্য একটি জীবন রক্ষা পেয়েছিল!
লোরেন নামে একজন বধির সাক্ষি ব্যাখ্যা করেন: “বাইবেল শেখা যেন একটা বড়ো পাজেলকে একসঙ্গে জোড়া লাগানোর মতো। পুরো চিত্রটা বোঝার ক্ষেত্রে আমার কিছু শূন্যস্থান—হারিয়ে যাওয়া টুকরো—ছিল। তা সত্ত্বেও, বাইবেলের সত্যগুলো যখন সাংকেতিক ভাষায় আরও প্রাপ্তিসাধ্য হয়েছিল, তখন সেই শূন্যস্থানগুলো পূরণ হয়ে গিয়েছিল।” জর্জ নামে একজন বধির ব্যক্তি, যিনি ৩৮ বছর ধরে একজন সাক্ষি, তিনি বলেন: “এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, কোনো বিষয় নিজে নিজে বোঝার ক্ষমতা আপনাকে কিছুটা আত্মসম্মানবোধ এবং আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। আমার মনে হয় যে, সাংকেতিক ভাষার ডিভিডি-গুলো আমার নিজের আধ্যাত্মিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলেছে।”
“আমার ভাষায় একটি সভা!”
সাংকেতিক ভাষার প্রকাশনাগুলো ছাড়াও, যিহোবার সাক্ষিরা এমন মণ্ডলীগুলো সংগঠিত করেছে, যেখানে সভাগুলো পুরোপুরি সাংকেতিক ভাষায় পরিচালনা করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে, বিশ্বব্যাপী সাংকেতিক ভাষার ১,১০০টারও বেশি মণ্ডলী রয়েছে। বধির শ্রোতাদের তাদের ভাষাতেই সম্বোধন করা হয় এবং বাইবেলের সত্যগুলো একজন বধির ব্যক্তি যেভাবে চিন্তা করেন—তার ভাষাতেই—সেভাবে উপস্থাপন করা হয়। সেগুলো এমনভাবে প্রকাশ করা হয়, যা তার সংস্কৃতি এবং জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতি সম্মান দেখায়।সাংকেতিক ভাষার মণ্ডলীগুলো গঠন করা কি সার্থক হয়েছে? সিরিলের অভিজ্ঞতাটা বিবেচনা করুন, যিনি ১৯৫৫ সালে একজন যিহোবার সাক্ষি হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। বছরের পর বছর ধরে, তিনি যতটা সম্ভব ভালোভাবে লিখিত প্রকাশনাদি অধ্যয়ন করতেন এবং নিয়মিতভাবে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিতেন। কখনো কখনো সাংকেতিক ভাষার অনুবাদকরা থাকত, আবার কখনো কখনো থাকত না। যখন কেউ থাকত না, তখন তিনি সেই সাক্ষিদের ওপর নির্ভর করতেন, যারা মঞ্চ থেকে যা বলা হতো সেই সম্বন্ধে নোট লিখে দেওয়ার মাধ্যমে প্রেমের সঙ্গে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করত। প্রায় ৩৪ বছর ধরে তিনি একজন সাক্ষি হিসেবে থাকার পর, ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে সাংকেতিক ভাষার প্রথম মণ্ডলী গঠিত হয়েছিল। সেই মণ্ডলীর একজন সদস্য হিসেবে সিরিল কেমন অনুভব করেছিলেন? “এটা ঠিক যেন বন থেকে বের হয়ে আসার মতো, এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আলোতে আসার মতো ছিল। আমার ভাষায় একটি সভা!”
যিহোবার সাক্ষিদের সাংকেতিক ভাষার মণ্ডলীগুলো হল এমন স্থান, যেখানে বধির ব্যক্তিরা ঈশ্বর সম্বন্ধে শেখার ও তাঁকে উপাসনা করার জন্য নিয়মিতভাবে একত্রিত হতে পারে। সেগুলো হল এমন স্থান, যেখানে ঈশ্বরের লোকেরা সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও উৎসাহিত বোধ করতে পারে। এমন এক জগতের মধ্যে যেখানে বধির লোকেরা হয়তো ভাষাগত দিক দিয়ে এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, সেখানে এই মণ্ডলীগুলো হল ভাববিনিময় ও মেলামেশা করার আশ্রয়স্থল। এই পরিবেশের মধ্যে বধির ব্যক্তিরা শিখতে, বৃদ্ধি পেতে এবং যিহোবার সেবায় তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। অনেক বধির সাক্ষি পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে সেবা করতে সক্ষম হয়েছে। কেউ কেউ বধির ব্যক্তিদের যিহোবার বিষয়ে শিখতে সাহায্য করার জন্য অন্যান্য দেশে চলে গিয়েছে। যে-খ্রিস্টান পুরুষরা বধির, তারা কার্যকারী শিক্ষক, সংগঠক ও পালক হতে শেখে আর তারপর অনেকে মণ্ডলীতে দায়িত্বগুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য সমর্থ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে সাংকেতিক ভাষার ১০০টারও বেশি মণ্ডলী এবং প্রায় ৮০টা দল রয়েছে। ব্রাজিলে সাংকেতিক ভাষার প্রায় ৩০০টা মণ্ডলী এবং ৪০০টারও বেশি দল রয়েছে। মেক্সিকোতে সাংকেতিক ভাষার প্রায় ৩০০টা মণ্ডলী রয়েছে। রাশিয়াতে সাংকেতিক ভাষার ৩০টারও বেশি মণ্ডলী এবং ১১৩টা দল রয়েছে। বিশ্বব্যাপী যে-বৃদ্ধি হচ্ছে, এগুলো হল তার মাত্র কয়েকটা উদাহরণ।
এ ছাড়া, যিহোবার সাক্ষিরা সাংকেতিক ভাষায় সম্মেলনগুলোরও আয়োজন করে থাকে। গত বছর সারা বিশ্বে বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় ১২০টারও বেশি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো বধির সাক্ষিদের এই বিষয়টা বুঝতে সমর্থ করে যে, তারা বিশ্বব্যাপী সেই খ্রিস্টীয় ভ্রাতৃসমাজের অংশ, যারা সময়োপযোগী আধ্যাত্মিক খাদ্য থেকে উপকার লাভ করছে।
লেনার্ড হলেন একজন বধির ব্যক্তি এবং তিনি ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন যিহোবার সাক্ষি। তিনি বলেন: “আমি সবসময়ই জানতাম যে, যিহোবা হলেন সত্য ঈশ্বর। তারপরও, আমি কখনোই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি যে, কেন তিনি দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন। কখনো কখনো, এই কারণে আমি তাঁর ওপর রাগ করতাম। কিন্তু সাংকেতিক ভাষার এক জেলা সম্মেলনে একটি নির্দিষ্ট বক্তৃতার সময়, আমি অবশেষে এর সঙ্গে জড়িত বিচার্য বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছিলাম। বক্তৃতাটি শেষ হওয়ার পর আমার স্ত্রী আমাকে কনুই দিয়ে আঘাত করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কি সন্তুষ্ট?’ আমি অকপটে বলতে পেরেছিলাম হ্যাঁ! ২৫ বছর পরেও আমি কৃতজ্ঞ যে, আমি কখনো যিহোবাকে পরিত্যাগ করিনি। আমি সবসময়ই তাঁকে ভালোবেসেছি কিন্তু তাঁকে পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারিনি। এখন আমি বুঝতে পারি!”
হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞ
যিহোবার বিষয়ে শেখার পর বধির ব্যক্তিরা তাঁর মুখমণ্ডলে কোন “অভিব্যক্তিগুলো” দেখতে পাচ্ছে? প্রেম, সমবেদনা, ন্যায়বিচার, আনুগত্য, প্রেমপূর্ণ-দয়া—এবং আরও অনেক কিছু।
বধির সাক্ষিদের আন্তর্জাতিক সমাজ যিহোবার মুখমণ্ডল দেখতে পাচ্ছে এবং এমনকী ক্রমাগত আরও স্পষ্টভাবে তা দেখতে থাকবে। বধির ব্যক্তিদের প্রতি তাঁর হৃদয় থেকে প্রেমবশত ‘সদাপ্রভু তাহাদের প্রতি আপন মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন।’ (গণনা. ৬:২৫) যিহোবাকে জানতে পেরেছে বলে এই বধির ব্যক্তিরা কতই না কৃতজ্ঞ!
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
বিশ্বব্যাপী সাংকেতিক ভাষার ১,১০০টারও বেশি মণ্ডলী রয়েছে
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
বধির ক্ষেত্রের ওপর যিহোবার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়েছে