“বলিদান অপেক্ষা আজ্ঞাপালন উত্তম”
“বলিদান অপেক্ষা আজ্ঞাপালন উত্তম”
প্রাচীন ইস্রায়েলের প্রথম রাজা ছিলেন শৌল। যদিও শৌল সত্য ঈশ্বরের দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু ক্রমান্বয়ে তিনি অবাধ্য হয়ে পড়েছিলেন।
শৌল কোন ভুলগুলো করেছিলেন? তিনি কি সেগুলো এড়াতে পারতেন? তার উদাহরণ বিবেচনা করার মাধ্যমে আমরা কীভাবে উপকৃত হতে পারি?
যিহোবা তাঁর মনোনীত রাজা সম্বন্ধে জানান
শৌল রাজা হওয়ার আগে, ভাববাদী শমূয়েল ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ইস্রায়েলে সেবা করছিলেন। শমূয়েল তখন বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার ছেলেরা অবিশ্বস্ত ছিল। একই সময়ে, সেই জাতি তার শত্রুদের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। ইস্রায়েলের প্রাচীনবর্গ যখন শমূয়েলের কাছে তাদের ওপর এমন একজন রাজাকে নিযুক্ত করতে অনুরোধ করেছিল, যিনি তাদের বিচার করবেন ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন, তখন যিহোবা তাদের নায়ক বা নেতা হিসেবে শৌলকে অভিষিক্ত করার জন্য ভাববাদীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আর এই কথা বলেছিলেন: “সে পলেষ্টীয়দের হস্ত হইতে আমার প্রজাদিগকে নিস্তার করিবে।”—১ শমূ. ৮:৪-৭, ২০; ৯:১৬.
শৌল “সুন্দর যুবা পুরুষ” ছিলেন। কিন্তু, সুদর্শন হওয়া ছাড়াও শৌলের অন্যান্য উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি নম্রও ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, শৌল শমূয়েলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আমি কি ইস্রায়েল-বংশ সকলের মধ্যে ক্ষুদ্রতম বিন্যামীন বংশীয় নহি? আবার বিন্যামীন বংশের মধ্যে আমার গোষ্ঠী কি সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র নয়? তবে আপনি আমাকে কেন এই প্রকার কথা কহেন?” নিজের ও তার পরিবার সম্বন্ধে শৌলের এক বিনয়ী মনোভাব ছিল, এমনকী যদিও তার বাবা কীশ “বলবান বীর [“সম্মানিত ধনী লোক,” বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন]” ছিলেন।—১ শমূ. ৯:১, ২, ২১.
এ ছাড়া, শমূয়েল যখন লোকেদেরকে ইস্রায়েলের জন্য যিহোবার মনোনীত রাজা সম্বন্ধে জানিয়েছিলেন, তখন শৌল যে-প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তা বিবেচনা করুন। শমূয়েল প্রথমে শৌলকে একান্তে অভিষিক্ত করেছিলেন এবং তাকে বলেছিলেন: “তোমার হস্ত যাহা করিতে পায়, তাহা করিও, কেননা ঈশ্বর তোমার সহবর্ত্তী।” এরপর, ভাববাদী যিহোবার মনোনীত ব্যক্তি সম্বন্ধে লোকেদের জানানোর জন্য তাদের একত্রিত করেছিলেন। কিন্তু, যখন শৌলকে শনাক্ত করা হয়েছিল, তখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। লাজুক শৌল লুকিয়ে ছিলেন। যিহোবা বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি কোথায় আছেন এবং শৌলকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।—১ শমূ. ১০:৭, ২০-২৪.
যুদ্ধক্ষেত্রে
শৌল এমন যেকোনো ব্যক্তিকে ভুল বলে প্রমাণিত করেছিলেন, যিনি হয়তো শৌলের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন। অম্মোনীয়রা যখন ইস্রায়েলের একটা নগরকে হুমকির মুখে ফেলেছিল, তখন “ঈশ্বরের আত্মা শৌলের উপরে ১ শমূ. ১১:১-১৩.
সবলে আসিলেন।” তিনি কর্তৃত্বের সঙ্গে ইস্রায়েলের যোদ্ধাদের একত্রিত করেছিলেন, তাদের সুসংগঠিত করেছিলেন এবং তাদেরকে জয়ী হতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু, শৌল এই কথা বলার দ্বারা এই জয়ের কৃতিত্ব ঈশ্বরকে দিয়েছিলেন: “অদ্য সদাপ্রভু ইস্রায়েলের মধ্যে নিস্তার সাধন করিলেন।”—শৌলের উত্তম গুণাবলি ছিল আর তার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল। এ ছাড়া, তিনি যিহোবার শক্তিকেও স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু, ইস্রায়েলীয়দের ও তাদের রাজার ধারাবাহিক সফলতা একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। শমূয়েল ইস্রায়েলের লোকেদের বলেছিলেন: “যদি তোমরা সদাপ্রভুকে ভয় কর, তাঁহার সেবা কর, ও তাঁহার রবে কর্ণপাত কর, এবং সদাপ্রভুর আজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ না কর, আর তোমরা ও তোমাদের উপরে কর্ত্তৃত্বপ্রাপ্ত রাজা, উভয়ে যদি আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুর অনুবর্ত্তী হও, [তবে ভাল]।” ইস্রায়েলীয়রা যদি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকত, তাহলে তারা কোন বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারত? “সদাপ্রভু আপন মহানামের গুণে আপন প্রজাদিগকে ত্যাগ করিবেন না,” শমূয়েল বলেছিলেন, “কেননা তোমাদিগকে আপন প্রজা করিতে সদাপ্রভুর অভিমত হইয়াছে।”—১ শমূ. ১২:১৪, ২২.
বাধ্যতা ছিল ঈশ্বরের অনুমোদন লাভের চাবিকাঠি আর এখনও এই বিষয়টা সত্য। যিহোবার দাসেরা যখন তাঁর আজ্ঞার বাধ্য হয়, তখন তিনি তাদের আশীর্বাদ করেন। কিন্তু, তারা যদি যিহোবার অবাধ্য হয়, তাহলে?
“তুমি অজ্ঞানের কর্ম্ম করিয়াছ”
পলেষ্টীয়দের বিরুদ্ধে শৌলের পরবর্তী পদক্ষেপের কারণে পলেষ্টীয়রা ক্রোধান্বিত হয়েছিল। “সমুদ্রতীরস্থ বালুকার ন্যায় অসংখ্য” সৈন্য শৌলের বিরুদ্ধে এসেছিল। “ইস্রায়েল লোকেরা আপনাদিগকে বিপদ্গ্রস্ত দেখিল, কেননা লোকেরা উপদ্রুত হইতেছিল; তখন লোকেরা গুহাতে, ঝোপে, শৈলে, দৃঢ় গৃহে ও গর্ত্তে লুকাইল।” (১ শমূ. ১৩:৫, ৬) শৌল কী করবেন?
শমূয়েল শৌলকে গিল্গলে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন, যেখানে ভাববাদী বলি উৎসর্গ করবেন। শৌল সেখানে অপেক্ষা করেছিলেন কিন্তু শমূয়েলের আসতে দেরি হয়েছিল আর শৌলের সৈন্যরা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাই, শৌল নিজেই বলি উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি তা করতে না করতেই শমূয়েল সেখানে এসে পৌঁছেছিলেন। শৌল যা করেছেন, তা শোনার পর শমূয়েল তাকে বলেছিলেন: “তুমি অজ্ঞানের কর্ম্ম করিয়াছ; তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাকে যে আজ্ঞা দিয়াছেন, তাহা পালন কর নাই; করিলে সদাপ্রভু এখন ইস্রায়েলের উপরে তোমার রাজত্ব চিরকাল স্থায়ী করিতেন। কিন্তু এখন তোমার রাজত্ব স্থির থাকিবে না; সদাপ্রভু আপন মনের মত এক জনের অন্বেষণ করিয়া তাহাকেই আপন প্রজাদের অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করিয়াছেন; কেননা সদাপ্রভু তোমাকে যাহা আজ্ঞা করিয়াছিলেন, তুমি তাহা পালন কর নাই।”—১ শমূ. ১০:৮; ১৩:৮, ১৩, ১৪.
বিশ্বাসের অভাব থাকায়, বলি উৎসর্গ করার জন্য শমূয়েলের আসার অপেক্ষা করতে ঈশ্বর যে-আজ্ঞা দিয়েছিলেন, শৌল উদ্ধতভাবে সেই আজ্ঞার অবাধ্য হওয়া বেছে নিয়েছিলেন। শৌলের আচরণ ইস্রায়েলের সৈন্যবাহিনীর একজন প্রাক্তন সেনাপতি গিদিয়োনের আচরণ থেকে কতই না আলাদা! যিহোবা গিদিয়োনকে তার সৈন্যদের সংখ্যা ৩২,০০০ থেকে কমিয়ে ৩০০ জন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আর গিদিয়োন সেই আজ্ঞার বাধ্য হয়েছিলেন। কেন? কারণ যিহোবার প্রতি তার বিশ্বাস ছিল। ঈশ্বরের সাহায্যে তিনি ১,৩৫,০০০ জন আক্রমণকারীকে পরাজিত করেছিলেন। (বিচার. ৭:১-৭, ১৭-২২; ৮:১০) যিহোবা শৌলকেও সাহায্য করতেন। কিন্তু, শৌলের অবাধ্যতার কারণে পলেষ্টীয়রা ইস্রায়েলে লুটপাট করেছিল।—১ শমূ. ১৩:১৭, ১৮.
আমরা যখন সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিই? বিশ্বাসের অভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিদের দৃষ্টিকোণ থেকে, ঐশিক নীতিগুলো উপেক্ষা করাকে ব্যবহারিক বলে মনে হতে পারে। শমূয়েল অনুপস্থিত থাকায়, শৌল হয়তো মনে করেছিলেন যে, তিনি যা করেছেন, সেটা যুক্তিসংগত। কিন্তু, যারা ঈশ্বরের অনুমোদন লাভ করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, তাদের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শাস্ত্রীয় নীতিগুলো মেনে চলাই হচ্ছে অনুসরণ করার মতো একমাত্র উপযুক্ত পথ।
যিহোবা শৌলকে অগ্রাহ্য করেন
অমালেকীয়দের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় শৌল আরেকটা গুরুতর দোষে দোষী হয়েছিলেন। ঈশ্বর অমালেকীয়দের অগ্রাহ্য করেছিলেন কারণ ইস্রায়েলীয়রা মিশর থেকে যাত্রা করার সময় তারা তাদের ওপর অযৌক্তিক আক্রমণ করেছিল। (যাত্রা. ১৭:৮; দ্বিতীয়. ২৫:১৭, ১৮) অধিকন্তু, বিচারকর্তাদের সময়ে অমালেকীয়রা ঈশ্বরের মনোনীত লোকেদের আবারও আক্রমণ করার জন্য অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। (বিচার. ৩:১২, ১৩; ৬:১-৩, ৩৩) তাই, যিহোবা অমালেকীয়দের কাজ লক্ষ করেছিলেন এবং শৌলকে তাদের ওপর বিচার নিয়ে আসতে আজ্ঞা দিয়েছিলেন।—১ শমূ. ১৫:১-৩.
শত্রুভাবাপন্ন অমালেকীয়দের নিঃশেষে বিনষ্ট করার এবং তাদের ধনসম্পদ ও পশুপাল ধ্বংস করার বিষয়ে যিহোবার আজ্ঞার বাধ্য হওয়ার পরিবর্তে শৌল তাদের রাজাকে বন্দি করেছিলেন এবং তাদের উত্তম পশুগুলোকে জীবিত রেখেছিলেন। এই ব্যাপারে শমূয়েল যখন শৌলকে দোষারোপ করেছিলেন, তখন কী হয়েছিল? শৌল এই বলে সেই অভিযোগ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন: “সদাপ্রভুর উদ্দেশে বলিদান করিবার জন্য লোকেরা উত্তম উত্তম মেষের ও গোরুর প্রতি দয়া করিয়াছে।” শৌলের আসলেই সেই পশুগুলো বলি দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, তিনি অবাধ্য হয়েছিলেন। শৌল আর “আপনার দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র” ছিলেন না। তাই, ঈশ্বরের ভাববাদী বলেছিলেন যে, শৌল ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছেন। এরপর শমূয়েল বলেছিলেন: “সদাপ্রভুর রবে অবধান করিলে যেমন, তেমন কি হোমে ও বলিদানে সদাপ্রভু প্রসন্ন হন? দেখ, বলিদান অপেক্ষা আজ্ঞাপালন উত্তম . . . তুমি সদাপ্রভুর বাক্য অগ্রাহ্য করিয়াছ, এই জন্য তিনি তোমাকে অগ্রাহ্য করিয়া রাজ্যচ্যুত করিয়াছেন।”—১ শমূ. ১৫:১৫, ১৭, ২২, ২৩.
যিহোবা যখন শৌলের ওপর থেকে তাঁর পবিত্র আত্মা ও আশীর্বাদ সরিয়ে নিয়েছিলেন, তখন “এক দুষ্ট আত্মা” ইস্রায়েলের প্রথম রাজাকে পরিচালিত করতে শুরু করেছিল। শৌল দায়ূদকে—যাকে যিহোবা পরে রাজার পদ দিয়েছিলেন—সন্দেহ এবং ঈর্ষা করতে শুরু করেছিলেন। শৌল একাধিক বার দায়ূদকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। বাইবেল বলে, “সদাপ্রভু দায়ূদের সহবর্ত্তী” ছিলেন আর তা দেখে “শৌল সর্ব্বদাই দায়ূদের শত্রু থাকিলেন।” শৌল তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলেন আর এমনকী ৮৫ জন যাজক ও অন্যান্য লোককে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, যিহোবা শৌলকে পরিত্যাগ করেছিলেন!—১ শমূ. ১৬:১৪; ১৮:১১, ২৫, ২৮, ২৯; ১৯:১০, ১১; ২০:৩২, ৩৩; ২২:১৬-১৯.
পলেষ্টীয়রা যখন ইস্রায়েলকে আবারও আক্রমণ করেছিল, তখন শৌল প্রেতচর্চার মাধ্যমে সাহায্যের জন্য অনর্থক প্রচেষ্টা করেছিল। পরদিন, তিনি যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন এবং আত্মহত্যা করেছিলেন। (১ শমূ. ২৮:৪-৮; ৩১:৩, ৪) ইস্রায়েলের প্রথম অবাধ্য রাজা সম্বন্ধে শাস্ত্র বলে: “শৌল সদাপ্রভুর বিরুদ্ধে কৃত সত্যলঙ্ঘন হেতু মরিলেন; কারণ তিনি সদাপ্রভুর বাক্য পালন করেন নাই; আবার তিনি অনুসন্ধান জন্য ভূতড়িয়ার কাছে মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, সদাপ্রভুর কাছে অনুসন্ধান করেন নাই।”—১ বংশা. ১০:১৩, ১৪.
শৌলের মন্দ উদাহরণ স্পষ্টভাবে দেখায় যে, যিহোবার কাছে কোনো বলি উৎসর্গ করার চেয়ে তাঁর বাধ্য থাকা উত্তম। “ঈশ্বরের প্রতি প্রেম এই,” প্রেরিত যোহন লিখেছিলেন, “যেন আমরা তাঁহার আজ্ঞা সকল পালন করি; আর তাঁহার আজ্ঞা সকল দুর্ব্বহ নয়।” (১ যোহন ৫:৩) আমরা যেন কখনো এই মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা না করি: ঈশ্বরের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব তাঁর প্রতি আমাদের বাধ্যতার ওপর নির্ভর করে।
[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]
শৌল প্রথমে একজন নম্র নেতা ছিলেন
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কেন শমূয়েল শৌলকে এই কথা বলেছিলেন যে, “বলিদান অপেক্ষা আজ্ঞাপালন উত্তম”?