“এখন অক্ষম, তবে চিরকালের জন্য নয়!”
“এখন অক্ষম, তবে চিরকালের জন্য নয়!”
বলেছেন সারা ভ্যান দ্যর মঁ
লোকেরা আমাকে প্রায়ই বলে থাকে, “সারা, তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর। কেন তুমি সবসময় এত আনন্দিত থাকো?” আমি তাদেরকে বলি যে, আমার এক বিশেষ আশা রয়েছে। এটাকে এই কথাগুলোর দ্বারা সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, “আমি এখন অক্ষম, তবে চিরকালের জন্য নয়!”
উ নিশ-শো চুয়াত্তর সালে আমি ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মের সময় অনেক সমস্যা দেখা গিয়েছিল আর পরে আমার মস্তিস্কের পক্ষাঘাত ধরা পড়ে। আমি খুব বেশি নড়াচড়া করতে পারতাম না আর আমার কথা বোঝা অনেক কঠিন ছিল। এ ছাড়াও, পরে আমার মৃগীরোগ ধরা পড়ে এবং আমি সহজেই ইনফেকশনের শিকার হই।
আমার বয়স যখন দুই বছর, তখন আমার পরিবার অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলে আসে। এর দুই বছর পর, বাবা আমার মাকে এবং আমাকে ফেলে চলে যান। আমার যতদূর মনে পড়ে, সেই সময়ই আমি প্রথম বারের মতো ঈশ্বরের নিকটবর্তী বোধ করি। আমার মা হলেন একজন যিহোবার সাক্ষি আর তিনি আমাকে নিয়মিতভাবে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে নিয়ে যেতেন, যেখানে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, ঈশ্বর আমাকে ভালোবাসেন এবং আমার যত্ন নেন। এই বিষয়টা জানা ও সেইসঙ্গে মায়ের ভালোবাসা এবং আশ্বাস আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিগুলো সত্ত্বেও আমাকে নিরাপদ বোধ করতে সাহায্য করেছে।
মা আমাকে এও শিখিয়েছেন যে, কীভাবে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করতে হয়। আসলে, কথা বলার চেয়ে বরং প্রার্থনা করাকে আমার কাছে আরও সহজ বলে মনে হয়। প্রার্থনার সময় আমাকে শব্দগুলো ভাষায় প্রকাশ করার জন্য কষ্ট করতে হয় না কিন্তু আমি আমার মনের কথাগুলো স্পষ্ট “শুনতে” পারি। আর আমার কথা বোঝা যেহেতু কঠিন, তাই এটা জানা অনেক আশ্বাসজনক যে, যিহোবা সমস্তকিছু বুঝতে পারেন, তা সেটা আমি মনে মনে নীরবে অথবা অস্পষ্টভাবে, যেভাবেই বলি না কেন।—গীত. ৬৫:২.
সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করা
কিন্তু, আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন আমার পক্ষাঘাত এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, হাঁটার জন্য আমার ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি শক্ত ফলকের প্রয়োজন হয়। আর এমনকী এটা দিয়েও সোজাভাবে হাঁটা আমার পক্ষে অনেক কষ্টকর ছিল। আমার বয়স যখন ১১ বছর, তখন আমি এমনকী হাঁটতেও পারতাম না। পরবর্তী সময়ে, আমি আমার মটরচালিত হুইলচেয়ার থেকে মেশিনের সাহায্য ছাড়া বিছানায় উঠতে এবং নামতে পারতাম না। আমি আমার হুইলচেয়ারটা একটা বাটনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করি।
এটা সত্যি যে, মাঝেমধ্যে অক্ষমতার কারণে আমি অনেক হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু, সেই সময় আমি আমাদের পরিবারের আদর্শবাক্য স্মরণ করি: “তুমি যা করতে পারো না, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হোয়ো না। তুমি যা করতে পারো, সেটার ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করো।” এটা আমাকে ঘোড়ায়, নৌকায় এবং ডিঙি নৌকায় চড়তে, ক্যাম্পিং করতে এবং এমনকী বাড়ির আশেপাশের রাস্তায় গাড়ি চালাতে সাহায্য করেছিল! আমি আমার শৈল্পিক প্রতিভা ছবি আঁকা, সেলাই করা, কুশন তৈরি করা, এমব্রয়ডারি করা এবং সিরামিকের জিনিসপত্র তৈরি করার মাধ্যমে প্রকাশ করি।
আমার চরম অক্ষমতার কারণে, কেউ কেউ একজন বুদ্ধিমান
প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে ঈশ্বরের উপাসনা করার বিষয়ে আমার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। আমার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন স্কুলের একজন শিক্ষিকা আমাকে আমার মায়ের ধর্ম থেকে “পালিয়ে” আসার জন্য বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে চাপ দিয়েছিলেন। তিনি এমনকী আমাকে বাসস্থান খোঁজার ব্যাপারে সাহায্য করবেন বলেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু, আমি তাকে বলেছিলাম যে, আমি কখনো আমার বিশ্বাস পরিত্যাগ করব না এবং আমি একমাত্র সেই সময়ই বাড়ি ত্যাগ করব, যখন আমি আরও স্বাধীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত হব।আমার শিক্ষিকার সঙ্গে এই ঘটনার পর পরই, আমি যিহোবার একজন সাক্ষি হিসেবে বাপ্তাইজিত হয়েছিলাম। দুই বছর পর, আমি একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে উঠি। এখানে থাকতে পেরে আমি আনন্দিত কারণ আমার প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, উভয়ই রয়েছে।
এক অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব
বছরের পর বছর ধরে আমি বিশ্বাসের অন্যান্য পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি। একদিন আমি একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যখন একজন সহছাত্র—যিনি নিজেও অক্ষম ছিলেন—আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই কথা শুনে প্রথমে আমি বেশ আনন্দিতই হয়েছিলাম। অধিকাংশ যুবতীর মতো আমিও আমার জীবনে একজন সঙ্গী পাওয়ার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষী ছিলাম। কিন্তু, দুজন অক্ষম থাকলেই যে তা সুখী বিবাহের নিশ্চয়তা দেয় এমন নয়। অধিকন্তু, সেই যুবক আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমাদের বিশ্বাস, কাজ এবং লক্ষ্য পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। তাই, কীভাবে আমরা একসঙ্গে জীবনযাপন করতে পারি? এ ছাড়া, আমি কেবল একজন সহবিশ্বাসীকে বিয়ে করার ব্যাপারে ঈশ্বরের স্পষ্ট নির্দেশনার প্রতি বাধ্য থাকার জন্যও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। (১ করি. ৭:৩৯) তাই, আমি সদয়ভাবে সেই যুবককে বলেছিলাম যে, আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারব না।
এমনকী এখনও আমি মনে করি যে, আমি সঠিক বাছাই করেছিলাম। আর এটা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত নতুন জগতে আমি সুখী হবই। (গীত. ১৪৫:১৬; ২ পিতর ৩:১৩) সেই সময়ের আগে পর্যন্ত আমি যিহোবার প্রতি অনুগত থাকার এবং আমার এখনকার পরিস্থিতির মধ্যেও সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
আমি সেই সময়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি, যখন আমি আমার হুইল চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠতে পারব এবং বাতাসের বেগে দৌড়াতে পারব। তখন আমি চিৎকার করে বলতে পারব, “আমি অক্ষম ছিলাম কিন্তু এখন আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আর তা চিরকালের জন্য!”