আজকের দিনে ‘অলৌকিক আরোগ্যসাধন’ এটা কি ঈশ্বর থেকে?
আজকের দিনে ‘অলৌকিক আরোগ্যসাধন’ এটা কি ঈশ্বর থেকে?
কি ছু কিছু দেশে, তীর্থযাত্রীদের তীর্থস্থানগুলো পরিদর্শন করতে দেখা অতি সাধারণ বিষয়, যেখানে গিয়ে অনেকে তাদের “দুরারোগ্য” ব্যাধি ও অসুস্থতাগুলো থেকে সুস্থ হয়েছে বলে দাবি করে থাকে। অন্য দেশগুলোতে, ওঝারা অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা লোকেদেরকে সুস্থ করেছে বলে দাবি করে। আবার অন্যান্য জায়গায়, ধর্মীয় আবেগসম্পন্ন সমাবেশগুলো অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অসুস্থ লোকেরা হয়তো তাদের হুইলচেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় অথবা তাদের ক্রাচগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর আরোগ্য লাভ করার দাবি করে।
যারা এই ধরনের সুস্থ করার কাজগুলো করে, তাদের অধিকাংশই অন্য ধর্মাবলম্বী আর একে অন্যকে ধর্মত্যাগী, মিথ্যা বা পৌত্তলিক বলে দোষারোপ করে থাকে। তাহলে এই প্রশ্নটা হয়তো জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে, ঈশ্বর কি প্রায়ই পরস্পরবিরোধী এই মাধ্যমগুলোর দ্বারা অলৌকিক কাজগুলো করে থাকেন? বস্তুতপক্ষে, বাইবেল বলে: “ঈশ্বর গোলযোগের ঈশ্বর নহেন, কিন্তু শান্তির।” (১ করিন্থীয় ১৪:৩৩) তাই, এই ধরনের ‘অলৌকিক আরোগ্যসাধন’ কি প্রকৃতই ঈশ্বরের কাছ থেকে হয়ে থাকে? কিছু আরোগ্যকারী যিশুর শক্তি দ্বারা আরোগ্যসাধন করার বিষয়ে দাবি করে। আসুন আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে, যিশু কীভাবে অন্যদেরকে সুস্থ করেছিলেন।
যিশু যেভাবে লোকেদেরকে আরোগ্য করেছিলেন
যিশু যে-উপায়গুলোতে অসুস্থ ব্যক্তিদের আরোগ্য করেছিলেন, তা আধুনিক দিনের আরোগ্যকারীদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, যিশু তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য আসা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আরোগ্য করেছিলেন। তিনি ভিড়ের মধ্যে থেকে বাছাই করা নির্দিষ্ট কিছু লোককে আরোগ্য করেননি আর বাকিদেরকে সুস্থ না করেই পাঠিয়ে দেননি। যিশু পুরোপুরিভাবে সুস্থ করেছিলেন এবং বেশিরভাগ সময়ই তা তৎক্ষণাৎ করেছিলেন। বাইবেল বলে: “সমস্ত লোক তাঁহাকে স্পর্শ করিতে চেষ্টা করিল, কেননা তাঁহা হইতে শক্তি নির্গত হইয়া সকলকে সুস্থ করিতেছিল।”—লূক ৬:১৯.
আধুনিক দিনের বিশ্বাস দ্বারা আরোগ্যকারীরা, যারা আরোগ্যসাধিত না হলে অসুস্থ ব্যক্তিকে প্রায়ই তার বিশ্বাসের অভাব রয়েছে বলে দোষারোপ করে থাকে, তাদের বিপরীতে যিশু এমনকী এমন কিছু ব্যক্তিকেও আরোগ্য করেছিলেন, যারা তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেনি। উদাহরণস্বরূপ, একবার একজন অন্ধ ব্যক্তি যিশুকে না ডাকা সত্ত্বেও, তিনি তার কাছে গিয়েছিলেন ও তাকে সুস্থ করেছিলেন। পরে যিশু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তুমি কি ঈশ্বরের পুত্ত্রে বিশ্বাস করিতেছ?” সেই ব্যক্তি উত্তর দিয়েছিলেন: “প্রভু, তিনি কে? আমি যেন তাঁহাতে বিশ্বাস করি।” যিশু তাকে বলেছিলেন: “তিনিই তোমার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।”—যোহন ৯:১-৭, ৩৫-৩৮.
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, ‘যিশুর দ্বারা আরোগ্য লাভ করার জন্য বিশ্বাস যদি আবশ্যিক বিষয় না হয়ে থাকে, তাহলে কেন যিশু যাদেরকে সুস্থ করতেন, তাদেরকে প্রায়ই বলতেন: “তোমার বিশ্বাস তোমাকে সুস্থ করিল?”’ (লূক ৮:৪৮; ১৭:১৯; ১৮:৪২) এটা বলার দ্বারা যিশু এই নির্দেশ করছিলেন যে, যারা বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাঁকে খুঁজে বের করেছে, তারা সুস্থ হয়েছে আর অন্যদিকে যে-লোকেরা তাঁর কাছে আসতে চায়নি, তারা সুস্থ হওয়ার সুযোগ হারিয়েছে। যারা আরোগ্য লাভ করেছিল, তারা তাদের বিশ্বাস দ্বারা আরোগ্য লাভ করেনি; তারা ঈশ্বরের শক্তির দ্বারা আরোগ্য লাভ করেছিল। যিশুর বিষয়ে বাইবেল বলে: “ঈশ্বর তাঁহাকে পবিত্র আত্মাতে ও পরাক্রমে অভিষেক করিয়াছিলেন; তিনি হিতকার্য্য করিয়া বেড়াইতেন, এবং দিয়াবল কর্ত্তৃক প্রপীড়িত সকল লোককে সুস্থ করিতেন; কারণ ঈশ্বর তাঁহার সহবর্ত্তী ছিলেন।”—প্রেরিত ১০:৩৮.
সাধারণত, আজকের দিনের তথাকথিত আরোগ্যসাধনের পিছনে টাকাপয়সা এক বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্বাস দ্বারা আরোগ্যকারীরা টাকাপয়সা সংগ্রহের চেষ্টার জন্য পরিচিত। রিপোর্ট অনুযায়ী, এইরকম একজন আরোগ্যকারী তার বিশ্বব্যাপী কাজকর্মের মাধ্যমে এক বছরে ৮ কোটি ৯০ লক্ষ (মার্কিন ডলার) আয় করেছিলেন। গির্জার সংগঠনগুলোও সেই তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে মুনাফা লাভ করে থাকে, যারা সুস্থ হওয়ার আশা নিয়ে তীর্থস্থানগুলোতে গিয়ে থাকে। এর বিপরীতে, যিশু সেই ব্যক্তিদের কাছ থেকে কখনো টাকাপয়সা সংগ্রহ করেননি, যাদেরকে তিনি আরোগ্য করেছিলেন। একটা ঘটনায়, তিনি এমনকী তাদের জন্য খাবারও জুগিয়েছিলেন। (মথি ১৫:৩০-৩৮) যিশু যখন তার শিষ্যদেরকে প্রচার করতে পাঠিয়েছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে বলেছিলেন: “পীড়িতদিগকে সুস্থ করিও, মৃতদিগকে উত্থাপন করিও, কুষ্ঠীদিগকে শুচী করিও, ভূতদিগকে ছাড়াইও; তোমরা বিনামূল্যে পাইয়াছ, বিনামূল্যই দান করিও।” (মথি ১০:৮) তাহলে, কেন আধুনিক দিনের আরোগ্যকারীদের কাজকর্ম যিশুর থেকে এত আলাদা?
“আরোগ্যসাধন” কোন উৎস থেকে?
বছরের পর বছর ধরে, চিকিৎসা সংক্রান্ত পেশায় থাকা কিছু ব্যক্তি ধর্মীয় আরোগ্যকারীদের দাবিগুলোকে পরীক্ষা করে দেখেছে। তারা কী জানতে পেরেছে? লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ অনুযায়ী, ইংল্যান্ডের একজন ডাক্তার, যিনি এই বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য ২০ বছর ব্যয় করেছেন, তিনি বলেছিলেন: “যারা অলৌকিক আরোগ্যসাধনের শক্তি থাকার দাবি করে, তাদের রিপোর্টগুলোর একটাও চিকিৎসাগত সাক্ষ্যপ্রমাণের দ্বারা সমর্থিত নয়।” তা সত্ত্বেও, বহু লোক আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা কোনো সাধুসন্ন্যাসীর দেহাবশেষ, তীর্থস্থান বা ধর্মীয় আরোগ্যকারীর শক্তিতে সুস্থ হয়েছে। এমনটা কি হতে পারে যে, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে?
যিশু তাঁর বিখ্যাত পর্বতেদত্ত উপদেশে বলেছিলেন যে, ধর্মীয় প্রতারকরা তাঁকে বলবে: “হে প্রভু, হে প্রভু, আপনার নামেই আমরা . . . কি অনেক পরাক্রম-কার্য্য করি নাই?” কিন্তু, তিনি উত্তরে বলবেন: “আমি কখনও তোমাদিগকে জানি নাই; হে অধর্ম্মাচারীরা, আমার নিকট হইতে দূর হও।” (মথি ৭:২২, ২৩) এই ধরনের ব্যক্তিরা শক্তির যে-উৎস সম্বন্ধে দাবি করে থাকে, সেই বিষয়ে প্রেরিত পৌল সাবধান করেছিলেন: “সেই ব্যক্তির আগমন শয়তানের কার্য্যসাধন অনুসারে মিথ্যার সমস্ত পরাক্রম ও নানা চিহ্ন ও অদ্ভুত লক্ষণ সহকারে হইবে, এবং . . . অধার্ম্মিকতার সমস্ত প্রতারণা সহকারে হইবে।”—২ থিষলনীকীয় ২:৯, ১০.
অধিকন্তু, ধর্মীয় স্মৃতিচিহ্ন, প্রতিমা এবং মূর্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত “আরোগ্যসাধন” ঈশ্বরের কাছ থেকে হতে পারে না। কেন হতে পারে না? কারণ ঈশ্বরের বাক্য স্পষ্টভাবে আজ্ঞা দেয়: “প্রতিমাপূজা হইতে পলায়ন কর” এবং “প্রতিমাগণ হইতে আপনাদিগকে রক্ষা কর।” (১ করিন্থীয় ১০:১৪; ১ যোহন ৫:২১) এই ধরনের “আরোগ্যসাধন” সত্য উপাসনা থেকে লোকেদেরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দিয়াবলের কৌশলগুলোর মধ্যে একটা। বাইবেল বলে: “শয়তান আপনি দীপ্তিময় দূতের বেশ ধারণ করে।”—২ করিন্থীয় ১১:১৪.
যেকারণে যিশু ও প্রেরিতরা লোকেদের আরোগ্য করেছিল
খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্র-এ লিপিবদ্ধ প্রকৃত অলৌকিক আরোগ্যগুলো স্পষ্টরূপে দেখায় যে, যিশু ও প্রেরিতরা ঈশ্বরের কাছ থেকে ছিল। (যোহন ৩:২; ইব্রীয় ২:৩, ৪) এ ছাড়া, যিশুর অলৌকিক আরোগ্যসাধন, তিনি যে-বার্তা প্রচার করেছিলেন সেটাকেও সমর্থন করেছিল: “যীশু সমুদয় গালীলে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; তিনি লোকদের সমাজ-গৃহে সমাজ-গৃহে উপদেশ দিলেন, রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করিলেন, এবং লোকদের সর্ব্বপ্রকার রোগ ও সর্ব্বপ্রকার পীড়া ভাল করিলেন।” (মথি ৪:২৩) যিশুর পরাক্রম কাজগুলো—যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত শুধুমাত্র অসুস্থদের সুস্থ করাই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে হাজার হাজার লোককে খাওয়ানো, প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা আর এমনকী মৃতদের উত্থিত করাও—দেখিয়েছিল যে, তিনি তাঁর রাজ্যের শাসনাধীনে বাধ্য মানবজাতির জন্য কী সম্পাদন করবেন। সত্যিই, সুসংবাদ!
এই ধরনের পরাক্রম কাজগুলো বা পবিত্র আত্মার দানগুলো, যিশু ও প্রেরিতরা এবং তারা যাদেরকে সেগুলো প্রদান করেছিল, তাদের মৃত্যুর পর লোপ পেয়েছিল। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “যদি ভাববাণী থাকে, তাহার লোপ হইবে; যদি [অলৌকিকভাবে বলা] বিশেষ বিশেষ ভাষা থাকে, সে সকল শেষ হইবে; যদি [ঐশিকভাবে প্রকাশিত] জ্ঞান থাকে, তাহার লোপ হইবে।” (১ করিন্থীয় ১৩:৮) কেন? তাদের উদ্দেশ্য সম্পাদন করে ফেলেছে বলে—যিশুকে প্রতিজ্ঞাত মশীহ হিসেবে এবং খ্রিস্টীয় মণ্ডলীকে ঈশ্বরের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হিসেবে শনাক্ত করে ফেলেছে বলে—আরোগ্যসাধনসহ এই ধরনের পরাক্রম কাজগুলোর আর প্রয়োজন নেই; এগুলোর ‘লোপ হইয়াছে।’
তা সত্ত্বেও, যিশুর আলৌকিক আরোগ্যসাধন, আজকে আমাদের দিনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে যিশু যা শিখিয়েছেন, তার ওপর আমরা যদি মনোযোগ দিই এবং বিশ্বাস অনুশীলন করি, তাহলে আমরা সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে পারি, যখন এই অনুপ্রাণিত ভবিষ্যদ্বাণীটি আধ্যাত্মিক ও আক্ষরিক উভয়ভাবেই পরিপূর্ণ হবে: “নগরবাসী কেহ বলিবে না, আমি পীড়িত।”—যিশাইয় ৩৩:২৪; ৩৫:৫, ৬; প্রকাশিত বাক্য ২১:৪. (w০৮ ১২/১)