মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড়ের শিকার ব্যক্তিরা ত্রাণসামগ্রী পেয়েছিল
মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড়ের শিকার ব্যক্তিরা ত্রাণসামগ্রী পেয়েছিল
ঘূ র্ণিঝড় নার্গিস, ২০০৮ সালের ২ মে মিয়ানমারের ওপর ধ্বংসাত্মক আঘাত হেনেছিল এবং খুব শীঘ্র আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠেছিল। ঝড়ের কারণে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ ইরাবতি ব-দ্বীপ অঞ্চলকে গ্রাস করার পর, প্রায় ১,৪০,০০০ লোক মারা গিয়েছে বা নিখোঁজ হয়েছে বলে রিপোর্ট করা হয়েছিল।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, সেই এলাকার অনেক যিহোবার সাক্ষির মধ্যে একজনও ক্ষতিগ্রস্ত হননি। তাদের রক্ষা পাওয়ার পিছনে একটা বড়ো কারণ ছিল, তারা ভালোভাবে নির্মিত তাদের কিংডম হলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। একটা জায়গায় বন্যার জল যখন ৫ মিটার উঠে গিয়েছিল, তখন ২০ জন সাক্ষি এবং অন্য ৮০ জন গ্রামবাসী কিংডম হলের ছাদে নয় ঘন্টা ধরে বসে ছিল। তারা সকলেই রক্ষা পেয়েছিল। দুঃখের বিষয় যে, সেই গ্রামের অন্য ৩০০ জন লোক প্রাণ হারিয়েছিল। অনেক গ্রামে কিংডম হলই ছিল একমাত্র ভবন, যা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।
ঘূর্ণিঝড়ের দু-দিন পর, ইয়ানগনে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিস, ব-দ্বীপের মুখে অবস্থিত বোথিংগোন মণ্ডলীতে ত্রাণ কর্মীদের একটা দলকে পাঠিয়েছিল। বিধ্বস্ত এলাকাগুলোর মধ্য দিয়ে যাত্রা করে, লুঠকারীদের এড়িয়ে আর পচাগলা মৃতদেহগুলোর পাশ দিয়ে গিয়ে সেই দল প্রচুর পরিমাণ চাল, শুকনো নুড্লস, জল এবং মোমবাতি নিয়ে বোথিংগোনে পৌঁছেছিল। এই ত্রাণ দলই সবচেয়ে প্রথমে সেই এলাকায় পৌঁছেছিল। স্থানীয় সাক্ষিদের সেই ত্রাণসামগ্রীগুলো দেওয়ার পর, তাদের উৎসাহিত করার জন্য সেই দল বাইবেলভিত্তিক বিভিন্ন বক্তৃতা দিয়েছিল এবং তাদের কাছে বাইবেল ও বাইবেল সাহিত্যাদি ছেড়ে এসেছিল, যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ে তাদের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাক্ষিদের মনোভাব সত্যিই উল্লেখযোগ্য ছিল। বিধ্বস্ত ইরাবতি অঞ্চলের একটা মণ্ডলীর একজন সাক্ষি বলেছিলেন: “আমাদের যা ছিল সবই গিয়েছে। আমাদের ঘরবাড়ি সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমাদের সমস্ত শস্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বন্যার ফলে পানীয় জল দূষিত হয়ে
গিয়েছে। কিন্তু, ভাই ও বোনেরা অন্যদের মতো উদ্বিগ্ন নয়। তারা যিহোবা এবং তাঁর সংগঠনের ওপর নির্ভর করে। আমরা গ্রামে থাকি বা অন্য যেখানেই যাই না কেন, যে-নির্দেশনা পাব, তা আমরা অনুসরণ করব।”এ ছাড়া, ৩০ জন সাক্ষির একটা দল, যারা সবকিছুই হারিয়েছিল, তারা ত্রাণ দলগুলো যেখানে তাদের জন্য খাবারদাবার, জামাকাপড় এবং আশ্রয় জুগিয়েছিল, সেখানে যাওয়ার দশ ঘন্টার যাত্রাপথে আনন্দের সঙ্গে রাজ্যের গানগুলো গেয়েছিল। তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগে, তারা জানতে পেরেছিল যে, কাছাকাছি একটা শহরে যিহোবার সাক্ষিদের সীমা সম্মেলন হচ্ছে। তারা প্রথমে সেই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যাতে করে তারা আধ্যাত্মিক খাদ্য গ্রহণ এবং খ্রিস্টীয় মেলামেশা উপভোগ করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সমগ্র এলাকার মধ্যে সাক্ষিদের ৩৫টা বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, ১২৫টা ঘর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ৮টা কিংডম হলের সামান্য ক্ষতি হয়েছিল। আনন্দের বিষয় যে, শাখা অফিসের ভবনগুলো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
প্রথম দিকে, ঘূর্ণিঝড়ের ফলে শাখা অফিস পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, কারণ বড়ো বড়ো গাছ পড়ে গিয়ে কাছাকাছি রাস্তাগুলো আটকে গিয়েছিল। ঝড় থেমে যাওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে শাখা অফিসের কর্মীদের মধ্যে থেকে ৩০ জনেরও বেশি সদস্য হাতে করেই গাছগুলো সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু করেছিল। তারা যখন কাজ করছিল, তখন লোকেরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই, সাক্ষি বোনেদের একটা দল কর্মীদের জন্য এবং সেইসঙ্গে সেই প্রতিবেশীদের জন্য ঠান্ডা পানীয় ও তাজা ফল নিয়ে এসেছিল, যারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে, তারা কী দেখছে। যা ঘটছিল, তা যখন একজন সাংবাদিক লক্ষ করেছিলেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এই লোকেরা কারা যারা এত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে?” তাকে জানানোর পর, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “যদি যিহোবার সাক্ষিদের মতো আরও বেশি লোক এইরকম সত্যিকারের সামাজিক মনোভাব দেখাতো!”
ত্রাণ কাজকে সুসংগঠিত করার জন্য সাক্ষিরা খুব শীঘ্র দেশের আলাদা আলাদা জায়গায় দুটো দুর্যোগ ত্রাণ কমিটি গঠন করেছিল। শত শত স্বেচ্ছাসেবক ত্রাণ দলগুলোতে কাজ করেছিল। যে-সাক্ষিরা তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিল, কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের জন্য নতুন ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। যখন একটা ত্রাণ দল একজন সাক্ষির জন্য একটা নতুন ঘর নির্মাণ করতে এসেছিল, তখন তার প্রতিবেশীরা যেন তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। একজন প্রতিবেশী বলেছিলেন: “এই সাক্ষি মহিলার জন্য তার গির্জা আবারও ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। আমার বৌদ্ধ বন্ধুদের কেউই আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। তিনি যখন আমার কাছে প্রচার করেছিলেন, তখন আমার উচিত ছিল একজন সাক্ষি হয়ে যাওয়া!”
নির্মাণকর্মীরা এবং ত্রাণ কমিটি যখন তানলিনে একটা বাড়ি পরিদর্শন করেছিল, যেটা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন তারা সেই সাক্ষি পরিবারের কথা শুনে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, যারা তাদের বলেছিল: “কিছুই হয়নি। আমাদের ঘর ঠিকই আছে। এখানে থাকতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই! কোনো কোনো সাক্ষির কোনো ঘরই নেই। তাদেরকে সাহায্য করুন!”
ইয়ানগনের একটা এলাকায়, কিছু লোক স্থানীয় গির্জাগুলোর মধ্যে একটাতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, গির্জার দরজা বন্ধ ছিল আর কেউই ভিতরে ঢুকতে পারেনি। লোকেরা খুবই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং গির্জার দরজা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। এর বিপরীতে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় যিহোবার সাক্ষিরা অনেক লোককে কিংডম হলগুলোতে আশ্রয় নিতে সাহায্য করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, এক সাক্ষি দম্পতি ডালা কিংডম হলে ২০ জন প্রতিবেশীকে আশ্রয় দিয়েছিল, যারা সুরক্ষার জন্য দিশেহারা হয়ে সেই দিকে পালিয়ে গিয়েছিল। সকাল বেলায় সেই পরিবারগুলোর কোনো ঘর ছিল না, যেখানে তারা ফিরে যেতে পারে আর তারা ক্ষুধার্ত ছিল। স্বামীটি এমন একজন ব্যক্তিকে খুঁজে পেয়েছিলেন, যিনি চাল বিক্রি করছিলেন আর তিনি সবাইকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ চাল কিনে এনেছিলেন।
ইয়ানগনের একটা পরিবারের কয়েক জন সদস্য যিহোবার সাক্ষি আর বাকিরা বিভিন্ন গির্জায় যোগ দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের পরে, পুরো পরিবার কিংডম হলের সভাতে এসেছিল। কেন? পরিবারের একজন সদস্য ব্যাখ্যা করেছিলেন: “আমাদের গির্জা থেকে বলেছিল যে, ঝড়ের পরে তারা আসবে ও আমাদের সঙ্গে দেখা করবে কিন্তু তারা কখনো আসেনি।
শুধু সাক্ষিরা এসেছিল। আপনারা আমাদের চাল ও জল দিয়েছিলেন। আপনারা অন্যান্য গির্জার লোকেদের মতো নন!” পরিবারের ন-সাক্ষি সদস্যরা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার “যিহোবা আমাদের আর্তনাদ শোনেন” প্রবন্ধটির আলোচনা উপভোগ করেছিল আর এমনকী মন্তব্যও করেছিল।একজন ভদ্রমহিলা যিনি সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করছিলেন, তিনি ঘূর্ণিঝড়ের পরের সপ্তাহে মণ্ডলীর সভাতে এসেছিলেন। সভা চলাকালীন, শাখা অফিস থেকে পাওয়া একটা চিঠি পড়া হয়েছিল, যেটাতে সাহায্য করার জন্য যা করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং যারা রক্ষা পেয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। চিঠিটা পড়ার সময় সেই ভদ্রমহিলা কাঁদতে শুরু করেছিলেন। তিনি এটা শুনে অত্যন্ত অভিভূত ও আনন্দিত হয়েছিলেন যে, সব সাক্ষিকে পাওয়া গিয়েছে এবং তারা সুরক্ষিত। পরে, তাকে কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছিল ও তার বাড়ির পাশেই তার জন্য একটা তাঁবু খাটানো হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, সাক্ষিরা সত্যিই তার খুব ভালো যত্ন নিয়েছিল।
যিশু বলেছিলেন: “তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।” (যোহন ১৩:৩৫) আর শিষ্য যাকোব জোর দিয়েছিলেন যে, প্রকৃত বিশ্বাসের সঙ্গে ভালো কাজ করা জড়িত। (যাকোব ২:১৪-১৭) যিহোবার সাক্ষিরা এই কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয় আর যাদের প্রয়োজন রয়েছে, তাদের সাহায্য ও সমর্থন করার দ্বারা তারা এই ধরনের প্রেম দেখানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। (w০৯ ৩/১)
[২৭ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
বাইবেল বলে যে, প্রকৃত বিশ্বাসের সঙ্গে ভালো কাজ করা জড়িত