সমাজগৃহ যেখানে যিশু ও তাঁর শিষ্যরা প্রচার করেছিল
সমাজগৃহ যেখানে যিশু ও তাঁর শিষ্যরা প্রচার করেছিল
“পরে যীশু সমুদয় গালীলে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; তিনি লোকদের সমাজ-গৃহে সমাজ-গৃহে উপদেশ দিলেন, রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করিলেন।”—মথি ৪:২৩.
সুসমাচারের বিবরণে বার বার আমরা যিশুকে কোনো সমাজগৃহে দেখতে পাই। নাসরতে, যে-নগরে তিনি বড়ো হয়ে উঠেছিলেন অথবা কফরনাহূমে, যে-নগরে তিনি প্রায়ই থাকতেন কিংবা তাঁর সাড়ে তিন বছরের ব্যস্ত পরিচর্যার সময়ে তিনি যে-নগর ও গ্রামগুলো পরিদর্শন করেছিলেন, তা যেখানেই হোক না কেন, ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে প্রচার করার ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য যিশু প্রায়ই সমাজগৃহকে বেছে নিতেন। বস্তুতপক্ষে, তাঁর পরিচর্যার কথা স্মরণ করে যিশু বলেছিলেন: “আমি সর্ব্বদা সমাজ-গৃহে ও ধর্ম্মধামে শিক্ষা দিয়াছি, যেখানে যিহূদীরা সকলে একত্র হয়।”—যোহন ১৮:২০.
একইভাবে, যিশুর প্রেরিতরা ও অন্য প্রাথমিক খ্রিস্টানরা প্রায়ই যিহুদিদের সমাজগৃহগুলোতে শিক্ষা দিত। কিন্তু, কীভাবে যিহুদিরা সমাজগৃহগুলোকে উপাসনার জন্য ব্যবহার করা শুরু করেছিল? আর যিশুর দিনে উপাসনার সেই গৃহগুলো কেমন ছিল? আসুন আমরা তা ভালো করে পরীক্ষা করি।
যিহুদিদের জীবনযাত্রার এক মুখ্য বৈশিষ্ট্য বছরের মধ্যে তিন বার, যিহুদি পুরুষরা যিরূশালেমের পবিত্র
মন্দিরে অনুষ্ঠিত উৎসবগুলোর জন্য সেখানে যাত্রা করত। কিন্তু দৈনন্দিন উপাসনার জন্য স্থানীয় সমাজগৃহ তাদের প্রয়োজনগুলো মেটাত, তা তারা প্যালেস্টাইনে অথবা প্যালেস্টাইনের বাইরে প্রতিষ্ঠিত যিহুদি উপনিবেশগুলোর কোনো একটাতে, যেখানেই বাস করুক না কেন।কখন থেকে সমাজগৃহের ব্যবহার শুরু হয়েছিল? কেউ কেউ মনে করে যে, যিহুদিরা বাবিলে বন্দি থাকাকালীন (সা.কা.পূ. ৬০৭-৫৩৭ সালে) এটার ব্যবহার শুরু হয়েছিল, যে-সময়ে যিহোবার মন্দির ধ্বংসাবস্থায় ছিল। অথবা হতে পারে যিহুদিরা বাবিলের বন্দিত্ব থেকে ফিরে আসার পর পরই, যখন যাজক ইষ্রা তার লোকেদেরকে ঈশ্বরের ব্যবস্থার গভীর জ্ঞান ও বোধগম্যতা লাভ করার জন্য জোরালো পরামর্শ দিয়েছিলেন।—ইষ্রা ৭:১০; ৮:১-৮; ১০:৩.
মূলত, ‘সমাজ-গৃহ’ শব্দটি সাধারণভাবে “সমাবেশ” অথবা “মণ্ডলীকে” বোঝাত। ইব্রীয় শাস্ত্র-এর গ্রিক অনুবাদ, সেপ্টুয়াজিন্ট-এ এটি এভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, পরে এই শব্দটি একটা গৃহকে বোঝাত, যেখানে লোকেরা উপাসনার জন্য সমবেত হতো। সা.কা. প্রথম শতাব্দীর মধ্যে, বলতে গেলে যিশু পরিদর্শন করেছিলেন এমন প্রত্যেকটা নগরে এর নিজস্ব সমাজগৃহ ছিল; শহরগুলোতে বেশ কিছু এবং যিরূশালেমেও অনেক সমাজগৃহ ছিল। সেই গৃহগুলো দেখতে কেমন ছিল?
উপাসনার জন্য এক সাধারণ গৃহ সমাজগৃহ নির্মাণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়, যিহুদিরা সাধারণত একটা উঁচু জায়গা খুঁজে, সেখানে গৃহ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করত যাতে এটার প্রবেশদ্বার (১) যিরূশালেমের দিকে মুখ করা থাকে। মনে করা হয় যে, নির্মাণ সংক্রান্ত এই ধরনের মানগুলো যথেষ্ট নমনীয় ছিল যেহেতু সেগুলো সবসময় পূরণ করা যেত না।
নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে প্রায়ই দেখা যেত যে, সমাজগৃহ খুবই সাধারণ ও সেখানে সামান্য কিছু আসবাবপত্র রয়েছে। কিন্তু, এক মুখ্য বৈশিষ্ট্য ছিল একটা সিন্দুক (২) অথবা ভাণ্ডার যেটাতে সেই সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—পবিত্র শাস্ত্রের গোটানো পুস্তকগুলো থাকত। যখন সভাগুলো অনুষ্ঠিত হতো, তখন বহনযোগ্য সিন্দুকটাকে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হতো ও সেটাকে পরে এক সুরক্ষিত কক্ষে (৩) ফিরিয়ে নিয়ে আসা হতো।
সামনের আসনগুলো (৪) সিন্দুকের কাছাকাছি ও সমবেত লোকেদের দিকে মুখ করে ছিল, যেখানে সমাজগৃহের অধ্যক্ষরা ও কোনো বিশিষ্ট অতিথি বসত। (মথি ২৩:৫, ৬) হলের প্রায় মাঝামাঝিতে একটা উঁচু প্ল্যাটফর্ম ছিল যেখানে বক্তার (৫) জন্য একটা স্ট্যাণ্ড ও আসন থাকত। প্ল্যাটফর্মের দিকে মুখ করে তিন দিকে সমবেত লোকেদের (৬) জন্য বেঞ্চগুলো থাকত।
সাধারণত, স্থানীয় মণ্ডলী সমাজগৃহকে পরিচালনা ও সমর্থন করত। ধনী ও গরিব সকলের কাছ থেকে পাওয়া স্বেচ্ছাকৃত দান সমাজগৃহকে দেখাশোনা করার ও সুন্দর রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু, সমাজগৃহের সভাগুলো কেমন ছিল?
লসমাজগৃহে উপাসনা সমাজগৃহে উপাসনা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রশংসা গীত, প্রার্থনা, শাস্ত্র পাঠ আর সেইসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া ও প্রচার করা। শেমা, যেটা যিহুদি বিশ্বাসের স্বীকারোক্তিকে ইঙ্গিত করত, সেটা মুখস্থ বলার দ্বারা মণ্ডলীর সভা শুরু হতো। প্রথম শাস্ত্রপদের প্রথম যে-শব্দটি মুখস্থ বলা হতো সেটি থেকে এই নামটি এসেছে: “শোন [শেমা], ইস্রায়েল; আমাদের ঈশ্বর যিহোবা একই যিহোবা।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৪, NW.
এরপর, মোশির দ্বারা লিখিত বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই, তোরাহ্ থেকে পাঠ করা ও সেটির অর্থ ব্যাখ্যা করা হতো। (প্রেরিত ১৫:২১) তারপর, ভাববাদীদের লেখাগুলো (হাফ্তারাহ্গুলো) থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহার করে আরেকটা পাঠ করা হতো এবং সেটিকে ব্যাখ্যা করা ও সেটির প্রয়োগ তুলে ধরা হতো। কখনো কখনো, অতিথি বক্তারা কার্যক্রমের এই অংশটি পরিচালনা করত, যেমন যিশু একবার করেছিলেন, যা লূক ৪:১৬-২১ পদে বর্ণিত রয়েছে।
অবশ্য, সেই সভায় যিশুকে যে-গোটানো পুস্তকটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি আমাদের আধুনিক দিনের বাইবেলগুলোর মতো অধ্যায় ও পদগুলোর দ্বারা চিহ্নিত ছিল না। তাই আমরা কল্পনা করতে পারি যে, যিশু বাম হাত দিয়ে গোটানো পুস্তকটি খুলছেন ও ডান হাত দিয়ে সেটি গোটাচ্ছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সেই অংশটুকু খুঁজে পান, যা তিনি খুঁজছিলেন। পাঠ করার পর, গোটানো পুস্তকটিকে আবার গুটিয়ে প্রথমাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হতো।
বেশিরভাগ সময়ই, মূল ইব্রীয় ভাষায় এই পাঠগুলো করা হতো এবং অরামীয় ভাষায় সেগুলো অনুবাদিত হতো। গ্রিক-ভাষী মণ্ডলীগুলোতে, সেপ্টুয়াজিন্ট ব্যবহৃত হতো।
রোজকার জীবনের অপরিহার্য এক বিষয় যিহুদিদের রোজকার জীবনে সমাজগৃহ এতই অপরিহার্য এক বিষয় ছিল যে, এটা ও এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য গৃহ অথবা একই জায়গার অন্য গৃহগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। কখনো কখনো, সেখানে আদালতের রায়গুলো শোনানো হতো ও সেইসঙ্গে সামাজিক সভা আর এমনকী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সংযুক্ত ভোজনালয়গুলোতে খাবার পরিবেশন করা হতো। মাঝেমধ্যে ভ্রমণকারীদেরকে সমাজগৃহের একই জায়গার থাকার ঘরগুলোতে থাকতে দেওয়া হতো।
সাধারণত প্রত্যেকটা নগরের সমাজগৃহে একটা স্কুলও থাকত যেটা প্রায়ই একই গৃহের মধ্যে থাকত। আমরা হয়তো অল্পবয়সি ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ এমন একটা ঘরের বিষয় কল্পনা করতে পারি, যেখানে তারা একটা মোমের ফলকের ওপর একজন শিক্ষকের লেখা বড়ো অক্ষরগুলোকে পড়তে শিখছে। মূলত এই স্কুলগুলোর জন্যই প্রাচীন যিহুদি সমাজ শিক্ষিত ছিল এবং সাধারণ লোকেরা শাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিল।
কিন্তু, সমাজগৃহের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিয়মিত উপাসনার জন্য একটা পরিবেশ প্রদান করা। তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানদের সভাগুলোর সঙ্গে সেই যিহুদি সমাজগৃহের সভাগুলোর অনেক মিল ছিল। একইভাবে খ্রিস্টীয় সভাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল প্রার্থনা, প্রশংসা গীত এবং ঈশ্বরের বাক্য পাঠ ও আলোচনা করার মাধ্যমে যিহোবাকে উপাসনা করা। এখানেই সাদৃশ্যগুলোর শেষ নয়। উভয় উপাসনাস্থলেই, স্বেচ্ছাকৃত দানের দ্বারা বিভিন্ন প্রয়োজন ও খরচ মেটানো হতো; উভয় স্থলেই ঈশ্বরের বাক্য পাঠ ও আলোচনা করার বিশেষ সুযোগের কোনোটাই পাদরি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; উভয় ক্ষেত্রেই, সভাগুলো দায়িত্বশীল প্রাচীনদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত হতো।
আজকে যিহোবার সাক্ষিরাও যিশু ও তাঁর প্রথম শতাব্দীর অনুসারীদের দ্বারা স্থাপিত আদর্শ অনুসরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাই, তাদের কিংডম হলের সভাগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সেই প্রাচীন সমাজগৃহের সভাগুলোর মিল রয়েছে। সর্বোপরি, সাক্ষিরা সেই একই উদ্দেশ্য নিয়ে মিলিত হয়, যেটার বিষয়ে সত্যের প্রেমিকরা সবসময় একমত আর তা হল ‘ঈশ্বরের নিকটবর্ত্তী হওয়া।’—যাকোব ৪:৮. (w১০-E ০৪/০১)
[১৬, ১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
এই পুনর্নির্মাণ প্রথম শতাব্দীর গামলা সমাজগৃহের পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
সমাজগৃহের স্কুলগুলো ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সি বালকদের শিক্ষা দিত