অধ্যায় ২১
যিশু “ঈশ্বর হইতে প্রজ্ঞা” প্রকাশ করেন
১-৩. যিশুর একসময়ের প্রতিবেশীরা তাঁর শিক্ষার প্রতি কীভাবে সাড়া দিয়েছিল এবং তারা তাঁর সম্বন্ধে কোন বিষয় বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল?
শ্রোতারা একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। যুবক যিশু সমাজগৃহে তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি তাদের কাছে অপরিচিত কেউ ছিলেন না—তিনি তাদের শহরে বড় হয়েছেন এবং বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের মধ্যে এক ছুতোর মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেছেন। সম্ভবত তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই বাড়িগুলোতে বাস করছিল, যেগুলো বানাতে যিশু সাহায্য করেছিলেন বা সেই সমস্ত লাঙ্গল দিয়ে তাদের জমি চাষ করছিল, যেগুলো তিনি নিজ হাতে বানিয়েছিলেন। a কিন্তু এই প্রাক্তন ছুতোর মিস্ত্রির শিক্ষার প্রতি তারা কীভাবে সাড়া দেবে?
২ অধিকাংশ শ্রোতাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল: “ইহার এমন জ্ঞান [“প্রজ্ঞা,” NW] . . . কোথা হইতে হইল?” কিন্তু সেইসঙ্গে তারা আরও বলেছিল: “এ . . . সেই সূত্রধর, মরিয়মের সেই পুত্ত্র।” (মথি ১৩:৫৪-৫৮; মার্ক ৬:১-৩) দুঃখের বিষয় যে, যিশুর একসময়ের প্রতিবেশীরা যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘এই সূত্রধর আমাদের মতোই স্থানীয় একজন।’ তাঁর কথাগুলোতে প্রজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, তারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা এই বিষয়ে অল্পই জেনেছিল যে, তিনি যে-প্রজ্ঞা বন্টন করেছিলেন, সেটা তাঁর নিজের ছিল না।
৩ যিশু এই প্রজ্ঞা কোথা থেকে পেয়েছিলেন? “আমার উপদেশ আমার নহে,” তিনি বলেছিলেন, “কিন্তু যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার।” (যোহন ৭:১৬) প্রেরিত পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, যিশু “হইয়াছেন আমাদের জন্য ঈশ্বর হইতে জ্ঞান [“প্রজ্ঞা,” NW]।” (১ করিন্থীয় ১:৩০) যিহোবার নিজস্ব প্রজ্ঞা তাঁর পুত্র যিশুর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। বাস্তবিকই এটা এতখানিই সত্য ছিল যে, যিশু বলতে পেরেছিলেন: “আমি ও পিতা, আমরা এক।” (যোহন ১০:৩০) আসুন আমরা তিনটে ক্ষেত্র পরীক্ষা করে দেখি, যেগুলোতে যিশু “ঈশ্বর হইতে প্রজ্ঞা” প্রদর্শন করেছিলেন।
তিনি যা শিক্ষা দিয়েছিলেন
৪. (ক) যিশুর বার্তার মূল বিষয় কী ছিল এবং কেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল? (খ) যিশুর পরামর্শ কেন সবসময় ব্যবহারিক এবং তাঁর শ্রোতাদের কাছে সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় ছিল?
৪ প্রথমে, যিশু কী শিখিয়েছিলেন তা বিবেচনা করুন। তাঁর বার্তার মূল বিষয় ছিল “ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার।” (লূক ৪:৪৩) সেটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ যিহোবার সার্বভৌমত্বের যথার্থতা প্রতিপাদনে ও মানবজাতির জন্য চিরস্থায়ী আশীর্বাদ নিয়ে আসার ক্ষেত্রে রাজ্য এক ভূমিকা রাখবে। যিশু তাঁর শিক্ষায় প্রতিদিনের জীবনযাপনের জন্য বিজ্ঞ পরামর্শও দিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে ভবিষ্যদ্বাণীকৃত “আশ্চর্য্য মন্ত্রী” হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। (যিশাইয় ৯:৬) সত্যিই, তাঁর পরামর্শ কি চমৎকার না হয়ে পারে? ঈশ্বরের বাক্য ও ইচ্ছা সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল, মানুষের স্বভাব সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ বোধগম্যতা এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল। তাই, তাঁর পরামর্শ সবসময়ই ব্যবহারিক ছিল এবং তাঁর শ্রোতাদের সর্বোত্তম উপকার নিয়ে এসেছিল। যিশু “অনন্ত জীবনের কথা” বলেছিলেন। হ্যাঁ, যখন পালন করা হয়, তাঁর পরামর্শ পরিত্রাণের দিকে পরিচালিত করে।—যোহন ৬:৬৮.
৫. কিছু বিষয় কী, যা যিশু পর্বতে দত্ত উপদেশে বলেছিলেন?
৫ পর্বতে দত্ত উপদেশ হল, যিশুর শিক্ষায় পাওয়া অতুলনীয় প্রজ্ঞার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। মথি ৫:৩–৭:২৭ পদে লিপিবদ্ধ এই উপদেশ বলার জন্য সম্ভবত মাত্র ২০ মিনিট লাগবে। কিন্তু, এর পরামর্শ সবসময়ের জন্য উপযোগী, এমনকি আজকেও একইরকমভাবে প্রযোজ্য যতখানি কি না প্রথম যখন জানানো হয়েছিল, তখন ছিল। যিশু বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে ছিল অন্যদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক ভাল করা যায় (৫:২৩-২৬, ৩৮-৪২; ৭:১-৫, ১২), নৈতিক দিক দিয়ে কীভাবে শুচি থাকা যায় (৫:২৭-৩২) এবং কীভাবে এক উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবনযাপন করা যায় (৬:১৯-২৪; ৭:২৪-২৭)। কিন্তু, যিশু তাঁর শ্রোতাদের কেবল প্রজ্ঞা কী, তা বলার চেয়েও আরও বেশি কিছু করেছিলেন; তিনি ব্যাখ্যা করার, যুক্তি ও প্রমাণ দেওয়ার মাধ্যমে তা করে দেখিয়েছিলেন।
৬-৮. (ক) চিন্তা এড়ানোর জন্য যিশু কোন জোরালো কারণগুলো জোগান? (খ) কী দেখায় যে, যিশুর পরামর্শ ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে?
৬ উদাহরণস্বরূপ, বস্তুগত বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ার সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেই সম্বন্ধে যিশুর বিজ্ঞ পরামর্শ বিবেচনা করুন, যা মথি ৬ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। “‘কি ভোজন করিব, কি পান করিব’ বলিয়া প্রাণের বিষয়ে, কিম্বা ‘কি পরিব’ বলিয়া শরীরের বিষয়ে ভাবিত হইও না,” যিশু আমাদের পরামর্শ দেন। (২৫ পদ) খাদ্য ও বস্ত্র হল মৌলিক চাহিদা আর এগুলো লাভ করার জন্য চিন্তিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যিশু আমাদের বলেন যে, এই বিষয়গুলোর জন্য “ভাবিত হইও না।” b কেন?
৭ যিশু যে-দৃঢ়প্রত্যয় উৎপাদক যুক্তি দেখান, তা শুনুন। যেহেতু যিহোবা আমাদের জীবন ও শরীর দিয়েছেন, তা হলে তিনি কি বেঁচে থাকার জন্য খাবার ও আচ্ছাদনের জন্য বস্ত্র জোগাতে পারেন না? (২৫ পদ) ঈশ্বর যদি পাখিদের খাবার জোগান এবং ফুলদের সৌন্দর্য দিয়ে বিভূষিত করেন, তা হলে তাঁর মানব উপাসকদের তিনি কত যত্নই না নেবেন! (২৬, ২৮-৩০ পদ) সত্যিই, অযথা চিন্তিত হওয়া অর্থহীন। এটা আমাদের আয়ু এমনকি সামান্যও বাড়াতে পারে না। c (২৭ পদ) কীভাবে আমরা চিন্তা এড়াতে পারি? যিশু আমাদের পরামর্শ দেন: ঈশ্বরের উপাসনাকে সবসময় জীবনে প্রথম স্থান দাও। যারা তা করে তারা নিশ্চিত হতে পারে যে তাদের রোজকার প্রয়োজনগুলো তাদের স্বর্গীয় পিতার মাধ্যমে তাদের “দেওয়া হইবে।” (৩৩ পদ) শেষে, যিশু অত্যন্ত এক ব্যবহারিক পরামর্শ দিয়েছিলেন—শুধু সেই দিনের জন্যই ভাবিত হও। আজকের চিন্তাগুলোর সঙ্গে কেন আগামীকালের চিন্তাগুলো যুক্ত করবেন? (৩৪ পদ) এ ছাড়া, যা হয়তো কখনও ঘটবে না, তা নিয়ে অযথা কেন উদ্বিগ্ন হবেন? এইরকম বিজ্ঞ পরামর্শ কাজে লাগানো এই চাপপূর্ণ জগতের অনেক মনোদুঃখ থেকে আমাদের স্বস্তি এনে দিতে পারে।
৮ স্পষ্টতই, যিশু যে-পরামর্শ দিয়েছিলেন তা প্রায় ২,০০০ বছর আগে যতখানি ব্যবহারিক ছিল, আজও ঠিক ততখানিই ব্যবহারিক। এটা কি ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞার প্রমাণ নয়? এমনকি মানব পরামর্শদাতাদের কাছ থেকে আসা সর্বোত্তম উপদেশও সেকেলে হয়ে যায় এবং কিছুদিনের মধ্যেই সংশোধিত হয় বা বদলে যায়। কিন্তু, যিশুর শিক্ষাগুলো দীর্ঘদিন পরেও অখণ্ডনীয় ও উপকারী রয়েছে। কিন্তু, তা আমাদের অবাক করে না কারণ এই চমৎকার পরামর্শদাতা “ঈশ্বরের বাক্য” বলেছিলেন।—যোহন ৩:৩৪.
তাঁর শিক্ষার ধরন
৯. যিশুর শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু সৈন্য কী বলেছিল আর কেন তা একটুও বাড়িয়ে বলা হয়নি?
৯ দ্বিতীয় যে-ক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রজ্ঞাকে যিশু প্রতিফলিত করেছিলেন, তা ছিল তাঁর শিক্ষার ধরন। একবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার জন্য কিছু সৈন্যকে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তারা তা না করে খালি হাতে ফিরে গিয়ে বলেছিল: “এ ব্যক্তি যেরূপ কথা বলেন, কোন মানুষে কখনও এরূপ কথা কহে নাই।” (যোহন ৭:৪৫, ৪৬) এটা একটুও বাড়িয়ে বলা হয়নি। সর্বকালের সমস্ত মানুষের মধ্যে “ঊর্দ্ধ্বস্থানের” যিশুর গ্রহণ করার মতো জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ ভাণ্ডার ছিল। (যোহন ৮:২৩) সত্যিই তিনি এমনভাবে শিক্ষা দিতেন, যা অন্য কোনো মানুষ দিতে পারত না। এই বিজ্ঞ শিক্ষকের কেবল দুটো পদ্ধতি বিবেচনা করে দেখুন।
“লোকসমূহ তাঁহার উপদেশে চমৎকার জ্ঞান করিল”
১০, ১১. (ক) যিশুর দৃষ্টান্ত ব্যবহার করা দেখে কেন আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না? (খ) নীতিগল্প কী এবং কোন উদাহরণ দেখায় যে, শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে যিশুর নীতিগল্পগুলো খুবই কার্যকরী?
১০ কার্যকরীভাবে বিভিন্ন দৃষ্টান্তের ব্যবহার। আমাদের বলা হয়, “যীশু দৃষ্টান্ত দ্বারা লোকসমূহকে কহিলেন, দৃষ্টান্ত ব্যতিরেকে তাহাদিগকে কিছুই কহিলেন না।” (মথি ১৩:৩৪) রোজকার বিষয়গুলোর মাধ্যমে গভীর সত্যগুলো শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর অতুলনীয় ক্ষমতা দেখে আমরা আশ্চর্য না হয়ে পারি না। কৃষকরা বীজ বুনছে, মহিলারা রুটি সেঁকার জন্য তৈরি হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা বাজারে খেলাধুলা করছে, জেলেরা জাল টেনে তুলছে, মেষপালকরা হারানো মেষ খুঁজে বেড়াচ্ছে—এই বিষয়গুলো তাঁর শ্রোতারা অনেক বার দেখেছে। গুরুত্বপূর্ণ সত্যগুলো যখন পরিচিত বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা হয়, তখন সেই সত্যগুলো খুব তাড়াতাড়ি এবং গভীরভাবে হৃদয় ও মনে গেঁথে যায়।—মথি ১১:১৬-১৯; ১৩:৩-৮, ৩৩, ৪৭-৫০; ১৮:১২-১৪.
১১ যিশু প্রায়ই নীতিগল্প ব্যবহার করতেন, যেগুলো হল ছোট গল্প যেখান থেকে নৈতিক বা আধ্যাত্মিক সত্যগুলো বের করে আনা হয়। দুর্বোধ্য ধারণাগুলোর চেয়ে গল্পগুলো বোঝা ও মনে রাখা যেহেতু সহজ, তাই নীতিগল্পগুলো যিশুর শিক্ষাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সাহায্য করেছিল। অনেক নীতিগল্পে যিশু সুস্পষ্ট দৃষ্টান্তগুলোর মাধ্যমে তাঁর পিতাকে বর্ণনা করেছিলেন, যা সহজে ভোলা যেত না। উদাহরণস্বরূপ, অপব্যয়ী পুত্রের নীতিগল্পের মূল বিষয়টা কেই বা না বুঝবে—যা হল বিপথে চলে যাওয়া একজন ব্যক্তি যখন প্রকৃত অনুতাপ দেখায়, তখন যিহোবা মমতা বোধ করবেন এবং তাকে আবার কোমলভাবে গ্রহণ করবেন?—লূক ১৫:১১-৩২.
১২. (ক) যিশু তাঁর শিক্ষায় কীভাবে বিভিন্ন প্রশ্ন ব্যবহার করতেন? (খ) কীভাবে যিশু তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন, যারা তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল?
১২ দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যবহার। যিশু বিভিন্ন প্রশ্ন ব্যবহার করতেন, যাতে তাঁর শ্রোতারা নিজেরা উপসংহারে পৌঁছাতে পারে, তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। (মথি ১২:২৪-৩০; ১৭:২৪-২৭; ২২:৪১-৪৬) ধর্মীয় নেতারা যখন জিজ্ঞেস করেছিল যে, তাঁর ঈশ্বর দত্ত কর্তৃত্ব আছে কি না, তখন যিশু উত্তর দিয়েছিলেন: “যোহনের বাপ্তিস্ম স্বর্গ হইতে হইয়াছিল, না মানুষ হইতে?” প্রশ্নটি শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে যুক্তি দেখিয়েছিল: “যদি বলি, স্বর্গ হইতে, তাহা হইলে এ বলিবে, তবে তোমরা তাঁহাকে বিশ্বাস কর নাই কেন? কিন্তু মানুষ হইতে হইল, ইহা কি বলিব? তাহারা লোকসাধারণকে ভয় করিত, কারণ সকলে যোহনকে সত্যই ভাববাদী বলিয়া মানিত।” শেষ পর্যন্ত তারা উত্তর দিয়েছিল: “আমরা জানি না।” (মার্ক ১১:২৭-৩৩; মথি ২১:২৩-২৭) একটা সাধারণ প্রশ্ন করে যিশু তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের হৃদয়ের কুটিলতা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন।
১৩-১৫. প্রতিবেশীসুলভ শমরীয়ের নীতিগল্পটা কীভাবে যিশুর প্রজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে?
১৩ যিশু মাঝে মাঝে তাঁর দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে চিন্তামূলক প্রশ্নগুলো করে দুটো পদ্ধতি একত্রে ব্যবহার করতেন। একজন যিহুদি ব্যবস্থাবেত্তা যখন যিশুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, অনন্তজীবন লাভ করার জন্য কী দরকার, তখন যিশু তাঁকে মোশির ব্যবস্থার বিষয়ে বলেছিলেন, যা ঈশ্বর ও প্রতিবেশীকে ভালবাসার আজ্ঞা দেয়। নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করতে চেয়ে সেই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আমার প্রতিবাসী কে?” এর উত্তরে যিশু একটা গল্প বলেছিলেন। একজন যিহুদি ব্যক্তি একাকী ভ্রমণ করার সময় দস্যুদলের কবলে পড়ে, যারা তাকে আধমরা করে ফেলে রেখে যায়। সেখানে দুজন যিহুদি ব্যক্তি আসে, প্রথমে একজন যাজক ও পরে একজন লেবীয়। দুজনেই তাকে উপেক্ষা করে চলে যায়। কিন্তু, সেখানে একজন শমরীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। মমতা বোধ করে তিনি যত্নের সঙ্গে আহত ব্যক্তির ক্ষতস্থান বেঁধে দেন এবং প্রেমের সঙ্গে সেই ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য তাকে একটা পান্থশালায় নিয়ে যান, যেখানে তিনি সুস্থ হতে পারবেন। গল্প বলা শেষ করে যিশু তাঁর প্রশ্নকারীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তোমার কেমন বোধ হয়, এই তিন জনের মধ্যে কে ঐ দস্যুদের হস্তে পতিত ব্যক্তির প্রতিবাসী হইয়া উঠিল?” লোকটি এই উত্তর দিতে বাধ্য হয়েছিল: “যে ব্যক্তি তাহার প্রতি দয়া করিল, সেই।”—লূক ১০:২৫-৩৭.
১৪ এই নীতিগল্পটা কীভাবে যিশুর প্রজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে? যিশুর দিনে যিহুদিরা “প্রতিবাসী” আখ্যাটা কেবল সেই ব্যক্তিদের প্রতি ব্যবহার করত, যারা তাদের পরম্পরাগত রীতিনীতি মেনে চলত—অবশ্যই শমরীয়দের প্রতি নয়। (যোহন ৪:৯) যিশু যদি সেই গল্পটিতে আহত ব্যক্তিকে শমরীয় ও সাহায্যকারীকে যিহুদি হিসেবে তুলে ধরতেন, তা হলে কি তাদের ভুল ধারণাটি ভাঙত? যিশু বিজ্ঞতার সঙ্গে সেই গল্পটা তৈরি করেছিলেন, যেখানে একজন শমরীয় কোমলভাবে একজন যিহুদির যত্ন নিয়েছিল। এ ছাড়া, গল্পের শেষে যিশু যে-প্রশ্নটা করেছিলেন, সেটাও লক্ষ করুন। তিনি “প্রতিবাসী” শব্দটার ধারণাকে পালটে দিয়েছিলেন। ব্যবস্থাবেত্তা মূলত জিজ্ঞেস করেছিলেন যে: ‘আমার প্রতিবেশীসুলভ ভালবাসা পাওয়ার ব্যক্তি কে?’ কিন্তু যিশু জিজ্ঞেস করেছিলেন: “এই তিন জনের মধ্যে কে . . . প্রতিবাসী হইয়া উঠিল?” যিনি দয়া লাভ করেছিলেন, সেই আহত ব্যক্তির প্রতি নয় কিন্তু যিনি দয়া দেখিয়েছিলেন অর্থাৎ সেই শমরীয়ের প্রতি যিশু মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। একজন প্রকৃত প্রতিবেশী, জাতিগত পটভূমিকা যাই হোক না কেন, অন্যদের প্রতি ভালবাসা দেখানোর জন্য প্রথমে এগিয়ে আসে। যিশু মূল যে-বিষয়টা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তা এর চেয়ে কার্যকরীভাবে আর বলতে পারতেন না।
১৫ এটা কি অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় যে, লোকেরা যিশুর “উপদেশে” চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর কাছে এসেছিল? (মথি ৭:২৮, ২৯) একবার তাঁর সঙ্গে তিন দিন “লোকের ভিড়” ছিল, এমনকি কোনো খাবার ছাড়াই!—মার্ক ৮:১, ২.
তাঁর জীবনযাপন
১৬. কোন উপায়ে যিশু “ব্যবহারিক প্রমাণ” দিয়েছিলেন যে, তিনি ঐশিক প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন?
১৬ তৃতীয় যে-ক্ষেত্রে যিহোবার প্রজ্ঞাকে যিশু প্রতিফলিত করেছিলেন, তা ছিল তাঁর জীবনযাপনের ধরন। প্রজ্ঞা ব্যবহারিক; এটা কার্যকরী। “তোমাদের মধ্যে বিজ্ঞ কে?” শিষ্য যাকোব জিজ্ঞেস করেছিলেন। এরপর তিনি তার নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, এই বলে: “তার সঠিক আচরণই এর ব্যবহারিক প্রমাণ দিক।” (যাকোব ৩:১৩, দ্যা নিউ ইংলিশ বাইবেল) যিশু যেভাবে আচরণ করেছিলেন তা “ব্যবহারিক প্রমাণ” দিয়েছিল যে, তিনি ঐশিক প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। আসুন আমরা দেখি যে, কীভাবে তিনি প্রগাঢ় বিচারবুদ্ধি দেখিয়েছিলেন আর তা তাঁর জীবনযাপন ও অন্যদের সঙ্গে তাঁর আচরণ, উভয় ক্ষেত্রেই।
১৭. কোন ইঙ্গিত রয়েছে যে, যিশু তাঁর জীবনে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন?
১৭ আপনি কি লক্ষ করেছেন, যে-লোকেদের উত্তম বিচারবুদ্ধির অভাব রয়েছে, তারা প্রায়ই চরমে চলে যায়? হ্যাঁ, এর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ প্রজ্ঞার দরকার। ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা প্রতিফলিত করায় যিশু নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। সর্বোপরি, তিনি তাঁর জীবনে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে প্রথম স্থানে রেখেছিলেন। তিনি সুসমাচার ঘোষণা করার কাজে পুরোপুরি ব্যস্ত ছিলেন। “আমি . . . সেই জন্যই বাহির হইয়াছি,” তিনি বলেছিলেন। (মার্ক ১:৩৮) স্বাভাবিকভাবেই, বস্তুগত বিষয়গুলো তাঁর কাছে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; স্পষ্টতই, তাঁর কাছে খুব সামান্য বস্তুগত জিনিস ছিল। (মথি ৮:২০) তবে, তিনি একজন যোগীও ছিলেন না। তাঁর পিতা, “ধন্য [“সুখী,” NW] ঈশ্বরের” মতো তিনিও একজন আনন্দপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি অন্যদের আনন্দ বৃদ্ধি করতেন। (১ তীমথিয় ১:১১; ৬:১৫) তিনি যখন একটা বিবাহ ভোজে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে সাধারণত গানবাজনা এবং আনন্দ উল্লাস করা হতো, তখন সেখানে তিনি অনুষ্ঠানের আনন্দকে মাটি করে দেওয়ার জন্য যাননি। দ্রাক্ষারস ফুরিয়ে গেলে তিনি জলকে উত্তম দ্রাক্ষারসে পরিণত করেছিলেন, যে-পানীয়টা “মর্ত্ত্যের চিত্তানন্দ-জনক।” (গীতসংহিতা ১০৪:১৫; যোহন ২:১-১১) যিশু খাবারের অনেক নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন এবং এইরকম উপলক্ষগুলোকে তিনি প্রায়ই শিক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন।—লূক ১০:৩৮-৪২; ১৪:১-৬.
১৮. যিশু শিষ্যদের সঙ্গে আচরণ করার ক্ষেত্রে কীভাবে নিখুঁত বিচারবুদ্ধি দেখিয়েছিলেন?
১৮ যিশু অন্যদের সঙ্গে তাঁর আচরণে নিখুঁত বিচারবুদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। মানুষের বৈশিষ্ট্যের প্রতি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি তাঁর শিষ্যদের সম্বন্ধে তাঁকে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি জুগিয়েছিল। তিনি ভালভাবেই জানতেন যে, তারা সিদ্ধ ছিল না। তবুও, তিনি তাদের ভাল গুণগুলো উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি এই ব্যক্তিদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন, যাদের যিহোবা আকর্ষণ করেছেন। (যোহন ৬:৪৪) তাদের ভুলত্রুটি সত্ত্বেও, যিশু তাদের ওপর নির্ভর করতে ইচ্ছুক ছিলেন। সেই নির্ভরতা দেখিয়ে তিনি তাঁর শিষ্যদের ওপর এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তিনি তাদের সুসমাচার প্রচার করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন এবং তাদের প্রতি তাঁর এই আস্থা ছিল যে, সেই দায়িত্ব পূর্ণ করার ক্ষমতা তাদের আছে। (মথি ২৮:১৯, ২০) প্রেরিত বইটা সাক্ষ্য দেয় যে, তারা বিশ্বস্তভাবে সেই কাজ করে গিয়েছিল যা তিনি তাদের করতে আদেশ দিয়েছিলেন। (প্রেরিত ২:৪১, ৪২; ৪:৩৩; ৫:২৭-৩২) তাই, এটা খুবই স্পষ্ট যে যিশু তাদের ওপর আস্থা রাখার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা দেখিয়েছিলেন।
১৯. কীভাবে যিশু দেখিয়েছিলেন যে, তিনি ছিলেন “মৃদুশীল ও নম্রচিত্ত”?
১৯ আমরা ২০ অধ্যায়ে যেমন লক্ষ করেছি, বাইবেল প্রজ্ঞাকে নম্রতা ও মৃদুতার সঙ্গে সংযুক্ত করে। অবশ্যই যিহোবা এই ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উদাহরণ স্থাপন করেন। কিন্তু, যিশুর সম্বন্ধে কী বলা যায়? যিশু তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে আচরণের বেলায় যে-নম্রতা দেখিয়েছিলেন, তা দেখা হৃদয়গ্রাহী। সিদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে তিনি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তবুও, তিনি তাঁর শিষ্যদের নিচু চোখে দেখেননি। কখনও তিনি তাদের নিকৃষ্ট বা অযোগ্য মনে করার চেষ্টা করেননি। এর বিপরীতে, তিনি তাদের সীমাবদ্ধতার প্রতি বিবেচনাশীল ও তাদের ভুলত্রুটির ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল ছিলেন। (মার্ক ১৪:৩৪-৩৮; যোহন ১৬:১২) এটা কি লক্ষণীয় নয় যে, এমনকি ছোট বাচ্চারাও যিশুর কাছে এসে স্বচ্ছন্দ বোধ করত? নিশ্চিতভাবেই তারা তাঁর কাছে আসতে চাইত কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি ছিলেন “মৃদুশীল ও নম্রচিত্ত।”—মথি ১১:২৯; মার্ক ১০:১৩-১৬.
২০. যে পরজাতীয় স্ত্রীলোকের মেয়েকে ভূতে ধরেছিল, তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় কীভাবে যিশু যুক্তিবাদিতা দেখিয়েছিলেন?
২০ যিশু আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে ঈশ্বরীয় নম্রতা দেখিয়েছিলেন। তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন ও মানিয়ে নিয়েছিলেন, যখন করুণা তা উপযুক্ত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ সেই সময়ের কথা মনে করে দেখুন, যখন একজন পরজাতীয় স্ত্রীলোক তার ভূতগ্রস্ত মেয়েকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে অনুরোধ করেছিলেন। তিনটি উপায়ে যিশু প্রথমে ইঙ্গিত করেছিলেন যে, তিনি তাকে সাহায্য করবেন না—প্রথমত, তাঁকে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থেকে; দ্বিতীয়ত, সরাসরি বলে যে, তাঁকে পরজাতীয়দের জন্য নয় কিন্তু যিহুদিদের জন্য পাঠানো হয়েছে; আর তৃতীয়ত একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে যা খুব সদয়ভাবে একই বিষয় বুঝিয়েছিল। কিন্তু, তবুও সেই স্ত্রীলোক নাছোড়বান্দা ছিলেন, তার অসাধারণ বিশ্বাসের প্রমাণ দিয়েছিলেন। এই ব্যতিক্রম পরিস্থিতিতে যিশু কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন? তিনি মূলত ঠিক তা-ই করেছিলেন, যা তিনি করবেন না বলে ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি সেই স্ত্রীলোকের মেয়েকে সুস্থ করেছিলেন। (মথি ১৫:২১-২৮) উল্লেখযোগ্য নম্রতা, তাই নয় কি? আর মনে রাখবেন যে, প্রকৃত প্রজ্ঞার ভিত্তিই হল নম্রতা।
২১. কেন আমাদের যিশুর ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তা ও কাজের ধরনকে অনুকরণ করার চেষ্টা করা উচিত?
২১ আমরা কতই না কৃতজ্ঞ হতে পারি যে, সুসমাচারের বিবরণগুলো আমাদের কাছে সর্বকালের সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তির কথা ও কাজগুলো প্রকাশ করে! আসুন আমরা মনে রাখি যে, যিশু ছিলেন তাঁর পিতার নিখুঁত প্রতিমূর্তি। যিশুর ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তা এবং কাজের ধরনগুলো অনুকরণ করে আমরা ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞাকে বাড়িয়ে চলব। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব যে, কীভাবে আমরা ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞাকে আমাদের জীবনে কাজে লাগাতে পারি।
a বাইবেলের সময়ে, ছুতোর মিস্ত্রিরা বাড়ি নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি এবং কৃষিকাজের সরঞ্জামাদি তৈরির কাজ করত। সা.কা. দ্বিতীয় শতাব্দীতে জাস্টিন মার্টার যিশুর বিষয়ে লিখেছিলেন: “তিনি লোকেদের মধ্যে থাকার সময় একজন ছুতোর মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন, লাঙ্গল ও জোয়াল তৈরি করতেন।”
b যে-গ্রিক ক্রিয়াপদকে ‘ভাবিত হওয়া’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, সেটার মানে হল, “মনকে বিক্ষিপ্ত হতে দেওয়া।” মথি ৬:২৫ পদে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা উদ্বেগপূর্ণ ভয়ের ইঙ্গিত করে, যা মনকে বিক্ষিপ্ত বা বিভক্ত করে, জীবনের আনন্দ কেড়ে নেয়।
c আসলে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখিয়েছে যে অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা এবং চাপ হৃদরোগ ও সেইসঙ্গে অন্যান্য অসুস্থতার কারণ হয়, যা আয়ুকে কমিয়ে দিতে পারে।