অধ্যায় দশ
পরিবারের কোনো সদস্য যখন অসুস্থ হয়
১, ২. ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা ভেঙে ফেলার চেষ্টায় শয়তান কীভাবে দুঃখজনক ঘটনা ও অসুস্থতাকে ব্যবহার করে?
ইয়োবকে অবশ্যই সেই ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করতে হবে, যারা সুখী পারিবারিক জীবন উপভোগ করেছিল। বাইবেল তাকে “পূর্ব্বদেশের লোকদের মধ্যে . . . সর্ব্বাপেক্ষা মহান্” বলে অভিহিত করে। তার সাত ছেলে ও তিন মেয়ে অর্থাৎ মোট দশজন সন্তান ছিল। এ ছাড়া, ভালভাবে পরিবারের ভরণপোষণ জোগানোর জন্য তার যথেষ্ট সহায়সম্পদ ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তিনি আধ্যাত্মিক কার্যক্রমগুলোতে নেতৃত্ব নিতেন এবং যিহোবার সামনে তার সন্তানদের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতেন। এই সমস্তকিছু ঘনিষ্ঠ ও সুখী পারিবারিক বন্ধনে অবদান রেখেছিল।—ইয়োব ১:১-৫.
২ ইয়োবের পরিস্থিতি যিহোবা ঈশ্বরের প্রধান শত্রু শয়তানের দৃষ্টি এড়ায়নি। শয়তান, যে সর্বদা ঈশ্বরের দাসদের নীতিনিষ্ঠা ভেঙে ফেলার বিভিন্ন উপায় খোঁজে, সে ইয়োবের সুখী পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে আক্রমণ করে। এরপর সে ‘ইয়োবের আপাদমস্তকে আঘাত করিয়া দুষ্ট স্ফোটক জন্মায়।’ এভাবে, শয়তান ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা ভেঙে ফেলার জন্য দুঃখজনক ঘটনা ও অসুস্থতাকে ব্যবহার করে।—ইয়োব ২:৬, ৭.
৩. ইয়োবের অসুস্থতার লক্ষণগুলো কী ছিল?
৩ বাইবেল ইয়োবের অসুস্থতার চিকিৎসাগত কোনো নাম সম্বন্ধে জানায় না। তবে, এটি আমাদেরকে লক্ষণগুলো সম্বন্ধে জানায়। তার দেহ কীটে ভরে যায় এবং তার চামড়া ফেটে যায় ও পচন ধরে। ইয়োবের শ্বাস দুর্গন্ধযুক্ত হয় এবং তার দেহ থেকে পচা গন্ধ বের হয়। তিনি বেদনায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। (ইয়োব ৭:৫; ১৯:১৭; ৩০:১৭, ৩০) নিদারুণ যন্ত্রণায় ইয়োব ভস্মের ওপরে বসে মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরো দিয়ে শরীর ঘষেন। (ইয়োব ২:৮) সত্যিই এক করুণ দৃশ্য!
৪. সময়ে সময়ে প্রত্যেক পরিবার কোন অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে?
৪ আপনি যদি এইরকম এক গুরুতর রোগে আক্রান্ত হতেন, তাহলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতেন? আজকে, ঈশ্বরের দাসদেরকে শয়তান ইয়োবের মতো অসুস্থতা দিয়ে আঘাত করে না। তা সত্ত্বেও, মানব অসিদ্ধতা, রোজকার জীবনের চাপ এবং আমরা যে-অধঃপতিত পরিবেশে বাস করছি, সেগুলোর কারণে কেবল এটাই আশা করা যায় যে, মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হবে। বিভিন্ন প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও আমরা সকলেই অসুস্থতার দ্বারা আক্রান্ত হই, যদিও অল্প কয়েক জন ইয়োবের মতো এতটা কষ্টভোগ করে থাকে। আমাদের ঘরে যখন অসুস্থতা আক্রমণ করে, তখন তা সত্যিই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। তাই, আসুন আমরা দেখি যে, কীভাবে বাইবেল আমাদেরকে মানবজাতির এই চিরশত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য সাহায্য করতে পারে।—উপদেশক ৯:১১; ২ তীমথিয় ৩:১৬.
এই বিষয়ে আপনি কেমন বোধ করেন?
৫. সাময়িক অসুস্থতার বেলায় পরিবারের সদস্যরা সাধারণত কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়?
৫ কারণ যা-ই হোক না কেন, জীবনের স্বাভাবিক তালিকা ব্যাহত হওয়া সবসময়ই কঠিন আর এটা বিশেষভাবে সেই সময় সত্য, যদি দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার কারণে তা হয়ে থাকে। এমনকি অল্পসময়ের অসুস্থতার জন্যও রদবদল করা, ছাড় দেওয়া এবং ত্যাগস্বীকার করার প্রয়োজন হয়। পরিবারের সুস্থ সদস্যদের হয়তো নীরব থাকতে হবে, যাতে অসুস্থ ব্যক্তি বিশ্রাম নিতে পারে। তাদেরকে হয়তো কিছু কাজ বাদ দিতে হতে পারে। তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ পরিবারে এমনকি অল্পবয়সি সন্তানরাও তাদের অসুস্থ সহোদর কিংবা বাবা অথবা মায়ের জন্য করুণা বা সমবেদনা বোধ করে, যদিও তাদেরকে হয়তো মাঝে মাঝে বিবেচক হওয়ার বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। (কলসীয় ৩:১২) সাময়িক অসুস্থতার ক্ষেত্রে পরিবার সাধারণত যা প্রয়োজন, তা করার জন্য প্রস্তুত থাকে। অধিকন্তু, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই অনুরূপ বিবেচনা আশা করে থাকে, যদি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।—মথি ৭:১২.
৬. পরিবারের কোনো সদস্য যদি গুরুতর, স্থায়ী অসুস্থতার দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মাঝে মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়?
৬ তবে, অসুস্থতা যদি অত্যন্ত গুরুতর হয় এবং তা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে চরমভাবে ও দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যাহত করে, তাহলে? উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের কেউ যদি স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, আলজেইমারস্ রোগের কারণে অক্ষম হয়ে পড়ে অথবা অন্যান্য অসুস্থতার কারণে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে, তাহলে কী? কিংবা পরিবারের কোনো সদস্য যদি মানসিক অসুস্থতার, যেমন সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলেই বা কী বলা যায়? সাধারণত প্রথম প্রতিক্রিয়া হল মমতা বোধ করা—প্রিয়জন অনেক কষ্ট পাচ্ছে দেখে, সেটার জন্য দুঃখবোধ করা। কিন্তু, মমতা বোধ করার পরে হয়তো অন্যান্য প্রতিক্রিয়াও দেখা যেতে পারে। একজন ব্যক্তির অসুস্থতার কারণে পরিবারের সদস্যরা যখন দেখতে পায় যে, তারা অত্যন্ত প্রভাবিত হচ্ছে এবং তাদের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা হয়তো বিরক্ত বোধ করতে পারে। তারা হয়তো ভাবতে পারে: “কেন এটা আমার প্রতিই ঘটল?”
৭. ইয়োবের স্ত্রী তার স্বামীর অসুস্থতার প্রতি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এবং স্পষ্টতই তিনি কোন বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলেন?
৭ ইয়োবের স্ত্রীর মনেও হয়তো অনুরূপ কোনো অনুভূতি দেখা গিয়েছিল। মনে রাখবেন যে, তিনি ইতিমধ্যেই তার সন্তানদের হারিয়েছেন। সেই দুঃখজনক ঘটনাগুলো যখন ঘটেছিল, তখন কোনো সন্দেহ নেই যে, ধীরে ধীরে তিনি আরও বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে, তিনি যখন তার একসময়কার সক্রিয় ও শক্তসমর্থ স্বামীকে বেদনাদায়ক এবং জঘন্য রোগের দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখেছিলেন, তখন তিনি হয়তো সেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলেন, যা সমস্ত দুঃখজনক ঘটনাকে ম্লান করে দিত আর তা হল ঈশ্বরের সঙ্গে নিজের ও তার স্বামীর সম্পর্ক। বাইবেল বলে: “তখন [ইয়োবের] স্ত্রী তাঁহাকে কহিলেন, তুমি কি এখনও তোমার সিদ্ধতা [“নীতিনিষ্ঠা,” NW] রক্ষা করিতেছ? ঈশ্বরকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রাণত্যাগ কর।”—ইয়োব ২:৯.
৮. পরিবারের কোনো সদস্য যখন খুবই অসুস্থ হয়, তখন কোন শাস্ত্রপদ পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে এক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করবে?
৮ অনেকেই হতাশ ও এমনকি ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে, যখন অন্য কারো অসুস্থতার কারণে তাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তবে, যে-খ্রিস্টান সেই পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তি করেন, তিনি অবশেষে উপলব্ধি করবেন যে, এই পরিস্থিতি তাকে অকৃত্রিম প্রেম দেখানোর এক সুযোগ করে দেয়। প্রকৃত প্রেম “চিরসহিষ্ণু, . . . মধুর, . . . [এবং] স্বার্থ চেষ্টা করে না, . . . সকলই বহন করে, সকলই বিশ্বাস করে, সকলই প্রত্যাশা করে, সকলই ধৈর্য্যপূর্ব্বক সহ্য করে।” (১ করিন্থীয় ১৩:৪-৭) তাই, নেতিবাচক আবেগঅনুভূতিকে প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়ার পরিবর্তে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য করা অপরিহার্য।—হিতোপদেশ ৩:২১.
৯. কোনো সদস্য যখন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়, তখন কোন আশ্বাসগুলো একটা পরিবারকে আধ্যাত্মিক ও আবেগগতভাবে সাহায্য করতে পারে?
৯ পরিবারের কোনো সদস্য যখন গুরুতর অসুস্থ থাকে, তখন একটা পরিবারের আধ্যাত্মিক ও আবেগগত মঙ্গলকে রক্ষা করার জন্য কী করা যেতে পারে? অবশ্য, প্রতিটা অসুস্থতার জন্য আলাদা আলাদা যত্ন ও চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োজন আর এই প্রকাশনায় কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি অথবা হোম-কেয়ারপদ্ধতি সম্বন্ধে সুপারিশ করা সঠিক হবে না। তা সত্ত্বেও, আধ্যাত্মিক অর্থে যিহোবা “অবনত সকলকে উত্থাপন করেন।” (গীতসংহিতা ১৪৫:১৪) রাজা দায়ূদ লিখেছিলেন: “ধন্য সেই জন, যে দীনহীনের পক্ষে চিন্তাশীল; বিপদের দিনে সদাপ্রভু তাহাকে নিস্তার করিবেন। সদাপ্রভু তাহাকে রক্ষা করিবেন, জীবিত রাখিবেন, . . . ব্যাধিশয্যাগত হইলে সদাপ্রভু তাহাকে ধরিয়া রাখিবেন।” (গীতসংহিতা ৪১:১-৩) যিহোবা তাঁর দাসদের আধ্যাত্মিকভাবে বাঁচিয়ে রাখেন, এমনকি সেই সময়েও, যখন তারা নিজেদের সাধ্যের অতিরিক্ত আবেগগত চাপের মুখোমুখি হয়। (২ করিন্থীয় ৪:৭) পরিবারের অনেক সদস্য, যারা নিজেদের ঘরে গুরুতর অসুস্থতার মুখোমুখি হচ্ছে, তারা গীতরচকের এই কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে: “আমি অতিশয় দুঃখার্ত্ত; হে সদাপ্রভু, তোমার বাক্যানুসারে আমাকে সঞ্জীবিত কর।”—গীতসংহিতা ১১৯:১০৭.
এক আরোগ্যকর মনোভাব
১০, ১১. (ক) একটা পরিবারকে যদি অসুস্থতার সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে কী অতীব গুরুত্বপূর্ণ? (খ) কীভাবে একজন মহিলা তার স্বামীর অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন?
১০ বাইবেলের একটা প্রবাদ বলে, “মানুষের আত্মা তাহার পীড়া সহিতে পারে, কিন্তু ভগ্ন আত্মা কে বহন করিতে পারে?” (হিতোপদেশ ১৮:১৪) প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট একটা পরিবারের মনোভাবকে ও সেইসঙ্গে ‘মানুষের আত্মাকে’ বা মনোভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কিন্তু, “শান্ত হৃদয় শরীরের জীবন।” (হিতোপদেশ ১৪:৩০) একটা পরিবার গুরুতর অসুস্থতার সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করবে কি করবে না, তা অনেকাংশে পরিবারের সদস্যদের আত্মার বা মনোভাবের ওপর নির্ভর করে।—তুলনা করুন, হিতোপদেশ ১৭:২২.
১১ একজন খ্রিস্টান মহিলা বিয়ের মাত্র ছয় বছর পরই তার স্বামীকে স্ট্রোকের কারণে অচল হতে দেখেছিলেন। “আমার স্বামীর বাক্শক্তি অত্যন্ত খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর তার সঙ্গে কথা বলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল,” তিনি স্মরণ করে বলেন। “সে কষ্ট করে যা বলার চেষ্টা করত, তা বুঝতে চেষ্টা করার মানসিক চাপ অত্যন্ত তীব্র ছিল।” এ ছাড়া, সেই স্বামী যে-নিদারুণ যন্ত্রণা ও হতাশা ভোগ করেছিলেন, সেটাও কল্পনা করে দেখুন। সেই দম্পতি কী করেছিল? যদিও তারা খ্রিস্টীয় মণ্ডলী থেকে দূরে বাস করত, তবুও সেই বোন সাম্প্রতিক সমস্ত সাংগঠনিক তথ্য ও সেইসঙ্গে প্রহরীদুর্গ এবং সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকায় নিয়মিতভাবে সরবরাহকৃত আধ্যাত্মিক খাদ্য সম্বন্ধে ভালভাবে অবগত থাকার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য যথাসাধ্য করেছিলেন। এইরকম করা তাকে তার প্রিয় স্বামী চার বছর পর মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার যত্ন নেওয়ার জন্য আধ্যাত্মিক শক্তি জুগিয়েছিল।
১২. ইয়োবের ক্ষেত্রে যেমন দেখা গিয়েছে, অসুস্থ ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে কোন অবদান রাখতে পারে?
১২ ইয়োবের ক্ষেত্রে তিনি নিজেই—আক্রান্ত ব্যক্তিই—দৃঢ় ছিলেন। “আমরা ঈশ্বর হইতে কি মঙ্গলই গ্রহণ করিব, অমঙ্গল গ্রহণ করিব না?” তিনি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। (ইয়োব ২:১০) এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, শিষ্য যাকোব পরবর্তী সময়ে ইয়োবকে ধৈর্য ও সহ্যশক্তির লক্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন! যাকোব ৫:১১ পদে আমরা পড়ি: “তোমরা ইয়োবের ধৈর্য্যের কথা শুনিয়াছ; প্রভুর [“যিহোবার,” NW] পরিণামও দেখিয়াছ, ফলতঃ প্রভু [“যিহোবা,” NW] স্নেহপূর্ণ ও দয়াময়।” একইভাবে আজকেও, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অসুস্থ সদস্যের সাহসী মনোভাব ঘরের অন্যান্য সদস্যকে এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।
১৩. গুরুতর অসুস্থতা ভোগ করছে এমন এক পরিবারের কোন তুলনা করা উচিত নয়?
১৩ পরিবারে অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই এই বিষয়ে একমত যে, পরিবারের সদস্যদের জন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াটাকে প্রথম প্রথম এক কঠিন সময় বলে মনে করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারা এও উল্লেখ করে যে, একজন ব্যক্তি পরিস্থিতিকে যেভাবে দেখেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গৃহস্থালির কাজের তালিকায় পরিবর্তন এবং রদবদল করার বিষয়টাকে শুরুতে হয়তো কঠিন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, একজন ব্যক্তি যদি সত্যিই প্রচেষ্টা করেন, তাহলে তিনি নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। তা করার সময় এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা আমাদের পরিস্থিতিকে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে তুলনা করব না, যাদের পরিবারে অসুস্থতা নেই, এইরকম মনে করব না যে, তাদের জীবন আরও সহজ আর ‘এটা খুবই অন্যায়!’ আসলে, কেউই সত্যিকারভাবে জানে না যে, অন্যদের কোন ভার সহ্য করতে হয়। সমস্ত খ্রিস্টান যিশুর এই কথাগুলো থেকে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারে: “হে পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত লোক সকল, আমার নিকটে আইস, আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব।”—মথি ১১:২৮.
অগ্রাধিকারগুলো স্থাপন করা
১৪. কীভাবে সঠিক অগ্রাধিকারগুলো স্থাপন করা যেতে পারে?
১৪ গুরুতর অসুস্থতার সময় একটা পরিবার এই অনুপ্রাণিত কথাগুলো স্মরণে রাখলে ভাল করবে: “পরামর্শদাতা অনেক হলে পরিকল্পনা সফল হয়।” (হিতোপদেশ ১৫:২২, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন) পরিবারের সদস্যরা কি একত্রিত হয়ে অসুস্থতার কারণে ঘটা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে পারে? প্রার্থনা সহকারে তা করা এবং নির্দেশনার জন্য ঈশ্বরের বাক্য পরীক্ষা করা নিশ্চিতভাবেই উপযুক্ত হবে। (গীতসংহিতা ২৫:৪) এই ধরনের আলোচনায় কী বিবেচনা করা উচিত? আসলে, সেখানে চিকিৎসাগত, আর্থিক এবং পারিবারিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া যেতে পারে। মূলত কে যত্ন নেবে? কীভাবে পরিবার সেই যত্নে সমর্থন জোগাতে পারে? যে-ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা কীভাবে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে প্রভাবিত করবে? মূলত যিনি যত্ন নেবেন, তার আধ্যাত্মিক ও অন্যান্য প্রয়োজনের দেখাশোনা কীভাবে করা যেতে পারে?
১৫. যে-পরিবারগুলো গুরুতর অসুস্থতা ভোগ করে, তাদের জন্য যিহোবা কোন সমর্থন জোগান?
১৫ যিহোবার নির্দেশনার জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা, তাঁর বাক্য নিয়ে ধ্যান করা এবং বাইবেলের দ্বারা নির্দেশিত পথ সাহসের সঙ্গে অনুসরণ করা প্রায়ই আমাদের জন্য আশাতীত আশীর্বাদ নিয়ে আসে। পরিবারের অসুস্থ সদস্যের রোগ হয়তো সবসময় সেরে ওঠে না। কিন্তু, যিহোবার ওপর নির্ভর করা যেকোনো পরিস্থিতিতে সবসময় সর্বোত্তম পরিণতির দিকে পরিচালিত করে। (গীতসংহিতা ৫৫:২২) গীতরচক লিখেছিলেন: “হে সদাপ্রভু, তোমার দয়া আমাকে সুস্থির রাখিত। আমার আন্তরিক ভাবনার বৃদ্ধিকালে তোমার দত্ত সান্ত্বনা আমার প্রাণকে আহ্লাদিত করে।”—গীতসংহিতা ৯৪:১৮, ১৯; এ ছাড়া দেখুন, গীতসংহিতা ৬৩:৬-৮.
সন্তানদের সাহায্য করা
১৬, ১৭. অল্পবয়সি সন্তানদের সঙ্গে কোনো সহোদরের অসুস্থতা সম্বন্ধে আলোচনা করার সময় কোন বিষয়গুলো বলা যেতে পারে?
১৬ গুরুতর অসুস্থতা পরিবারের সন্তানদের জন্য বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে বাবা-মা যেন সন্তানদেরকে উদ্ভূত প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে এবং সহযোগিতা করার জন্য তারা হয়তো যা করতে পারে, তা বুঝতে সাহায্য করে। কোনো সন্তান যদি অসুস্থ হয়ে থাকে, তাহলে সহোদরদের বুঝতে সাহায্য করতে হবে যে, অসুস্থ ভাই বা বোন যে-বাড়তি মনোযোগ ও যত্ন লাভ করছে, সেটার অর্থ এই নয় যে, অন্য সন্তানদের কম ভালবাসা হয়। অসন্তোষ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠতে দেওয়ার পরিবর্তে, বাবা-মায়েরা অন্য সন্তানদেরকে পরস্পরের প্রতি ঘনিষ্ঠবন্ধন গড়ে তুলতে এবং অসুস্থতার দ্বারা সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করায় সহযোগিতা করার সময় অকৃত্রিম স্নেহ দেখাতে সাহায্য করতে পারে।
১৭ অল্পবয়সি সন্তানরা সাধারণত আরও সহজে সাড়া দেবে, যদি বাবা-মা চিকিৎসাগত অবস্থা সম্বন্ধে দীর্ঘ ও জটিল ব্যাখ্যা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের অনুভূতিতে নাড়া দেয়। তাই, তাদেরকে এই বিষয়ে কিছু ধারণা দিতে হবে যে, পরিবারের অসুস্থ সদস্য কোন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সুস্থ সন্তানরা যদি বুঝতে পারে যে, তারা যে-বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক বলে মনে করে, সেগুলো করতে অসুস্থতা কীভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে বাধা দিচ্ছে, তাহলে তারা সম্ভবত আরও ‘ভ্রাতৃপ্রেম’ দেখাবে এবং “স্নেহবান্” হবে।—১ পিতর ৩:৮.
১৮. কীভাবে বড় সন্তানদেরকে অসুস্থতার দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাগুলো বোঝার জন্য সাহায্য করা যেতে পারে আর কীভাবে এটা তাদের কাছে উপকারজনক হতে পারে?
১৮ বড় সন্তানদের এটা বুঝতে সাহায্য করা উচিত যে, এক কঠিন পরিস্থিতি বিদ্যমান আর এর জন্য পরিবারের প্রত্যেকের বিভিন্ন ত্যাগস্বীকার করা প্রয়োজন। ডাক্তারের ফি ও চিকিৎসার খরচ দিতে হবে বলে বাবা-মায়ের পক্ষে অন্যান্য সন্তান যেমনটা চাইবে, সেই অনুযায়ী সেগুলো জোগানো সম্ভব নয়। এতে কি সন্তানরা অসন্তুষ্ট হবে এবং এইরকম মনে করবে যে তারা বঞ্চিত হচ্ছে? নাকি তারা পরিস্থিতি বুঝবে এবং প্রয়োজনীয় ত্যাগস্বীকার করতে ইচ্ছুক হবে? এর অধিকাংশই নির্ভর করে বিষয়বস্তু নিয়ে কীভাবে আলোচনা করা হয়েছে এবং পরিবারের মধ্যে কী ধরনের মনোভাব গড়ে তোলা হয়েছে, সেটার ওপর। বস্তুতপক্ষে, অনেক পরিবারে কোনো সদস্যের অসুস্থতা সন্তানদের পৌলের এই পরামর্শ অনুসরণ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করেছে: “প্রতিযোগিতার কিম্বা অনর্থক দর্পের বশে কিছুই করিও না, বরং নম্রভাবে প্রত্যেক জন আপনা হইতে অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর; এবং প্রত্যেক জন আপনার বিষয়ে নয়, কিন্তু পরের বিষয়েও লক্ষ্য রাখ।”—ফিলিপীয় ২:৩, ৪.
চিকিৎসাপদ্ধতিকে যেভাবে দেখতে হবে
১৯, ২০. (ক) পরিবারের কোনো সদস্য যখন অসুস্থ হয়, তখন পরিবারের মস্তকরা কোন দায়িত্বগুলো বহন করে? (খ) যদিও বাইবেল কোনো চিকিৎসা সংক্রান্ত পাঠ্যপুস্তক নয় কিন্তু কীভাবে এটি অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে নির্দেশনা জোগায়?
১৯ ভারসাম্যপূর্ণ খ্রিস্টানরা চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আপত্তি করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ঈশ্বরের আইনের বিরুদ্ধে যায়। তাদের পরিবারের কোনো সদস্য যখন অসুস্থ হয়, তখন তারা আক্রান্ত ব্যক্তির কষ্ট লাঘব করার জন্য সাহায্য পেতে আকাঙ্ক্ষী। তা সত্ত্বেও, পেশাদার ব্যক্তিদের বিতর্কমূলক মতামতগুলো থাকতে পারে, যা বিবেচনা করে দেখতে হবে। অধিকন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আকস্মিকভাবে নতুন নতুন রোগ ও ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হচ্ছে আর এগুলোর মধ্যে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি নেই। এমনকি মাঝে মাঝে সঠিকভাবে রোগনির্ণয় করাও কঠিন। তাহলে একজন খ্রিস্টানের কী করা উচিত?
২০ যদিও একজন বাইবেল লেখক চিকিৎসক ছিলেন এবং প্রেরিত পৌল তার বন্ধু তীমথিয়কে চিকিৎসা সংক্রান্ত সাহায্যকারী পরামর্শ দিয়েছেন, তবুও শাস্ত্র হল এক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নির্দেশক, কোনো চিকিৎসা সংক্রান্ত পাঠ্যপুস্তক নয়। (কলসীয় ৪:১৪; ১ তীমথিয় ৫:২৩) তাই, চিকিৎসাপদ্ধতির ব্যাপারে খ্রিস্টান পরিবারের মস্তকদের নিজেদের ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে। তারা হয়তো মনে করতে পারে যে, তাদের একাধিক পেশাদার ব্যক্তির মতামত নেওয়া দরকার। (তুলনা করুন, হিতোপদেশ ১৮:১৭.) নিশ্চিতভাবেই তারা তাদের পরিবারের অসুস্থ সদস্যের জন্য প্রাপ্তিসাধ্য সর্বোত্তম সাহায্য চাইবে আর অধিকাংশ ব্যক্তিই পেশাদার ডাক্তারদের কাছ থেকে তা পাওয়ার চেষ্টা করে। কেউ কেউ বিকল্প স্বাস্থ্যগত চিকিৎসার ব্যাপারে স্বচ্ছন্দ বোধ করে থাকে। এটাও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তা সত্ত্বেও, স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় খ্রিস্টানরা ‘ঈশ্বরের বাক্যকে তাহাদের চরণের প্রদীপ, তাহাদের পথের আলোক’ হতে বাধা দেয় না। (গীতসংহিতা ১১৯:১০৫) তারা সবসময় বাইবেলের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলে। (যিশাইয় ৫৫:৮, ৯) এভাবে তারা এমন রোগনির্ণয় পদ্ধতিগুলো পরিহার করে, যেগুলোর সঙ্গে প্রেতচর্চা জড়িত এবং তারা এমন চিকিৎসাপদ্ধতিও এড়িয়ে চলে, যেগুলো বাইবেলের নীতিগুলোকে লঙ্ঘন করে।—গীতসংহিতা ৩৬:৯; প্রেরিত ১৫:২৮, ২৯; প্রকাশিত বাক্য ২১:৮.
২১, ২২. কীভাবে এশিয়ার একজন মহিলা বাইবেলের একটা নীতি নিয়ে যুক্তি করেছিলেন আর তিনি যে-সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা কীভাবে তার পরিস্থিতিতে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল?
২১ এশিয়ার একজন যুবতী মহিলার কথা বিবেচনা করুন। একজন যিহোবার সাক্ষির সঙ্গে অধ্যয়ন করার ফলে বাইবেল সম্বন্ধে শিখতে শুরু করার কিছুদিন পর, তিনি অপরিণত বয়সের একটা মেয়ের জন্ম দেন, যার ওজন ছিল মাত্র ১·৪৭ কিলোগ্রাম। সেই মহিলার মন একেবারে ভেঙে যায়, যখন ডাক্তার তাকে বলেন যে, এই বাচ্চা গুরুতর প্রতিবন্ধী হবে এবং কখনো হাঁটতে পারবে না। তিনি তাকে পরামর্শ দেন যেন সেই বাচ্চাকে কোনো আশ্রমে দিয়ে দেওয়া হয়। তার স্বামী বুঝতে পারছিলেন না যে কী করবেন। সেই মহিলা কার ওপর নির্ভর করতে পারতেন?
২২ তিনি বলেন, “আমার মনে পড়ে যে, আমি বাইবেল থেকে এই বিষয়টা শিখেছি, ‘দেখ, সন্তানেরা সদাপ্রভুদত্ত অধিকার, গর্ব্ভের ফল তাঁহার দত্ত পুরস্কার।’” (গীতসংহিতা ১২৭:৩) তিনি সেই “অধিকার” বা উত্তরাধিকারকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ও তার যত্ন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম প্রথম বিষয়টা কঠিন ছিল কিন্তু যিহোবার সাক্ষিদের স্থানীয় মণ্ডলীর খ্রিস্টান বন্ধুদের সাহায্যে সেই মহিলা তার বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় বিশেষ সাহায্য জোগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। বারো বছর পর সেই বাচ্চা কিংডম হলের সভাগুলোতে যেতে সমর্থ হয়েছিল এবং সেখানকার অল্পবয়সিদের সাহচর্য উপভোগ করেছিল। সেই মা মন্তব্য করেন: “আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, বাইবেলের নীতিগুলো আমাকে সঠিক বিষয়টা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাইবেল আমাকে যিহোবা ঈশ্বরের সামনে এক শুচি বিবেক বজায় রাখতে এবং এমন কোনো আক্ষেপ না করতে সাহায্য করেছে, যা কিনা আমার বাকি জীবনে কষ্ট দিত।”
২৩. যারা অসুস্থ ও যারা অসুস্থদের যত্ন নেয়, তাদেরকে বাইবেল কোন সান্ত্বনা প্রদান করে?
২৩ অসুস্থতা আমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকবে না। ভাববাদী যিশাইয় সেই সময়ের বিষয়ে উল্লেখ করেন, যখন “নগরবাসী কেহ বলিবে না, আমি পীড়িত।” (যিশাইয় ৩৩:২৪) এই প্রতিজ্ঞা দ্রুত আসন্ন নতুন জগতে পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু, তার আগে পর্যন্ত আমাদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে হবে। তবে আনন্দের বিষয় যে, ঈশ্বরের বাক্য আমাদের নির্দেশনা ও সাহায্য জোগায়। বাইবেল আচরণের যে-মৌলিক নিয়মনীতি জোগায় তা স্থায়ী এবং তা অসিদ্ধ মানুষের চিরপরিবর্তনশীল মতামতগুলোর ঊর্ধ্বে। তাই, একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি গীতরচকের সঙ্গে একমত হবেন, যিনি লিখেছিলেন: “সদাপ্রভুর ব্যবস্থা সিদ্ধ, প্রাণের স্বাস্থ্যজনক; সদাপ্রভুর সাক্ষ্য বিশ্বসনীয়, অল্পবুদ্ধির জ্ঞানদায়ক। . . . সদাপ্রভুর শাসন সকল সত্য, সর্ব্বাংশে ন্যায্য। . . . তাহা পালন করিলে মহাফল হয়।”—গীতসংহিতা ১৯:৭, ৯, ১১.