সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

প্রেম, “সিদ্ধির যোগবন্ধন”

প্রেম, “সিদ্ধির যোগবন্ধন”

অধ্যায় ৬

প্রেম, “সিদ্ধির যোগবন্ধন”

‘কেন যে সন্ধ্যেবেলা খাবার সময়মত হয় না জানি না?’ স্বামী রুক্ষভাবে বলে ওঠেন, সারাদিন পরিশ্রম করার পর অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন।

‘অভিযোগ করা এবার বন্ধ কর। তৈরি হয়েই গেছে,’ স্ত্রী রেগে বলে ওঠে। তার দিনও খুব আরামে কাটেনি।

‘কিন্তু তুমি সবসময় দেরি কর। তুমি কেন কখনও সময়ে কোন কিছু দিতে পার না?’

‘কথাটা ঠিক বলনি!’ স্ত্রী চেঁচিয়ে ওঠে। ‘তুমি যদি একদিন ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার ভার নিতে, তাহলে তুমি এত অভিযোগ করতে না। এমন কি, তারা তো তোমারও ছেলেমেয়ে!’

এইভাবে, স্বামীস্ত্রীর মধ্যে এই ছোটখাট বিষয়টি তিল থেকে তালে পরিণত হয়, যার পরিণামে দুজনেই ক্রোধান্বিত হন ও পরস্পরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। যতক্ষণ না দুজনেই দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হন ততক্ষণ তারা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতেই থাকেন এবং তাদের সেদিনের সন্ধ্যাবেলাটি নষ্ট হয়ে যায়। দুজনের মধ্যে একজন হয়ত সেটি ঘটতে না দিতেও পারতেন। এটি দেখায় যে, দুজনেই তাদের নিজেদের অনুভূতির প্রতি মগ্ন ছিলেন এবং সাথীর অনুভূতি সম্পর্কে ভুলে গিয়েছিলেন। ক্রুদ্ধ স্নায়ু তিক্ততার সৃষ্টি করেছিল।

বহু ক্ষেত্রে এই প্রকৃতির সমস্যা আসতে পারে। টাকাপয়সা নিয়েও হতে পারে। অথবা স্বামী হয়ত মনে করতে পারেন যে তার স্ত্রী অত্যধিক অধিকারপ্রিয়, অন্যদের সাথে মেলামেশা করে তাকে আনন্দ উপভোগ করতে দিতে সে চায় না। স্ত্রী হয়ত মনে করতে পারে তাকে অবহেলা করা হচ্ছে বা তার অস্তিত্বকে মাত্র স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কোন বড় সমস্যা বা কয়েকটি ছোট সমস্যার কারণেও উদ্বেগ থাকতে পারে। যে কোন কারণই হোক না কেন, এখন আমাদের উদ্দেশ্য হল যে কিভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যাবে। দুজনের মধ্যে যে কেউ ‘অন্য গাল ফিরিয়ে দিতে’ ইচ্ছুক হয়ে, “মন্দের পরিশোধে কাহারও মন্দ” না করে পরিবর্তে ‘উত্তমের দ্বারা মন্দকে পরাজয়’ করে সমস্যাটি দানা বাঁধতে না দিতে পারে। (মথি ৫:৩৯; রোমীয় ১২:১৭, ২১) তা করতে সংযম ও পরিপক্কতার প্রয়োজন। খ্রীষ্টীয় প্রেমের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

প্রেম বলতে আসলে কী বুঝায়

প্রেম কী এবং কী নয়, সে সম্বন্ধে যিহোবা ঈশ্বর ১ করিন্থীয় ১৩:৪-৮ পদে প্রেমের সংজ্ঞাকে অনুপ্রাণিত করেন: “প্রেম চিরসহিষ্ণু, প্রেম মধুর, ঈর্ষা করে না, প্রেম আত্মাশ্লাঘা করে না, গর্ব্ব করে না, অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থ চেষ্টা করে না, রাগিয়া উঠে না, অপকার গণনা করে না, অধার্ম্মিকতায় আনন্দ করে না, কিন্তু সত্যের সহিত আনন্দ করে; সকলই বহন করে, সকলই বিশ্বাস করে, সকলই প্রত্যাশা করে, সকলই ধৈর্য্যপূর্ব্বক সহ্য করে। প্রেম কখনও শেষ হয় না।”

প্রেম হয়ত অনেক কিছুর উপর ভিত্তি করে হতে পারে—দৈহিক আকর্ষণ, পারিবারিক সম্বন্ধ অথবা একে অপরের সাহচর্যে পরস্পরের মধ্যে আনন্দ উপভোগ। কিন্তু বাইবেল দেখায় যে, প্রেমকে প্রকৃত মূল্যবান হতে হলে তা ভালবাসা ও আকর্ষণকে ছাপিয়ে যাবে এবং প্রিয়জনের যে জিনিসে সবচেয়ে মঙ্গল হবে তা করতে পরিচালিত করবে। সেই প্রকৃতির প্রেম এমন কি শাসন ও ভর্ৎসনা করতেও পারে, যেমন পিতামাতা তাদের ছেলেমেয়েদের বা যিহোবা তাঁর উপাসকদের করে থাকেন। (ইব্রীয় ১২:৬) আবেগ ও অনুভূতি নিশ্চয় থাকবে, কিন্তু সেগুলি যেন অপরের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচার ও সঠিক নীতিগুলিকে উপেক্ষা না করে। সেই ধরনের প্রেম একজনকে বিবেচনা ও ন্যায়ের নীতি অনুসারে সকলের সাথে আচরণ করতে পরিচালিত করবে।

প্রেম কিভাবে আমাদের পারিবারিক জীবনে উপকার করতে পারে সেই সম্বন্ধে আরও ভালভাবে উপলব্ধি করতে, আসুন আমরা ১ করিন্থীয় ১৩:৪-৮ পদের সংজ্ঞাটি বিশদভাবে বিবেচনা করি।

১০“প্রেম চিরসহিষ্ণু, প্রেম মধুর।” আপনি কি আপনার সাথীর প্রতি চিরসহিষ্ণু? এমন কি যখন মনে হয় যে পরিস্থিতি উত্তেজিত করে তুলছে এবং হয়ত অন্যায় দোষারোপ করা হচ্ছে, তখনও কি আপনি সংযত থাকতে পারেন? আমাদের সকলের সাথে যিহোবা ঈশ্বর চিরসহিষ্ণু ও ‘ঈশ্বরের মধুর ভাব একজনকে মনপরিবর্ত্তনের দিকে নিয়ে যায়।’ চিরসহিষ্ণুতা ও মধুর ভাব, এই দুই গুণাবলিই ঈশ্বরের আত্মার ফল।—রোমীয় ২:৪; গালাতীয় ৫:২২.

১১ প্রেম মন্দকাজকে অনুমোদন করে না, কিন্তু তা “খুঁত”ও ধরে না। প্রেম অধৈর্যও নয়। দোষত্রুটি ক্ষমা করা যায় এমন অবস্থাকে বিবেচনা করে। (১ পিতর ৪:৮; গীতসংহিতা ১০৩:১৪; ১৩০:৩, ৪) এবং এমন কি গুরুতর বিষয়গুলিকে ক্ষমা করতেও প্রস্তুত থাকে। প্রেরিত পিতর ভেবেই নিয়েছিলেন যে তিনি চিরসহিষ্ণু যখন তিনি যীশুকে জিজ্ঞাসা করেন: “আমার ভ্রাতা আমার নিকটে কত বার আপরাধ করিলে আমি তাহাকে ক্ষমা করিব? কি সাত বার পর্য্যন্ত?” যীশুর উত্তর ছিল: “তোমাকে বলিতেছি না, সাত বার পর্য্যন্ত, কিন্তু সত্তর গুণ সাত বার পর্য্যন্ত।” (মথি ১৮:২১, ২২; লূক ১৭:৩, ৪) প্রেম বার বার ক্ষমা করে এবং অশেষ দয়া দেখায়। আপনি কি তা করছেন?

১২ প্রেম “ঈর্ষা করে না।” কোন প্রকৃত কারণ ছাড়াই যে সঙ্গী ঈর্ষা করে তার সাথে বাস করা কষ্টকর। সেই প্রকৃতির ঈর্ষা হল সন্দেহজনক, অত্যধিক অধিকারপ্রিয়। এটি শিশুসুলভ এবং অপর ব্যক্তিকে অন্যের সাথে স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ হতে বাধা দেয়। সহজ সরলভাবে কিছু দেওয়াতে আনন্দ আসে, ঈর্ষাযুক্ত দাবিতে আসে না।

১৩ “অন্তর্জ্বালার কাছে কে দাঁড়াইতে পারে?” বাইবেল জিজ্ঞাসা করে। অসিদ্ধ দেহের এটি একটি কার্য। (হিতোপদেশ ২৭:৪; গালাতীয় ৫:১৯, ২০) নিরাপত্তা বোধের অভাব এবং কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট কোন ঈর্ষার ইঙ্গিত কি আপনি আপনার মধ্যে দেখতে পেয়েছেন? অন্যের দোষ ধরা খুব একটা কঠিন নয়, কিন্তু যখন আমরা নিজেদের পরীক্ষা করে দেখি তখন নিজেরাই বেশি উপকৃত হই। “যেখানে ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতা, সেইখানে অস্থিরতা ও সমুদয় দুষ্কর্ম্ম থাকে।” (যাকোব ৩:১৬) ঈর্ষা বিবাহকে নষ্ট করে দিতে পারে। ঈর্ষাপরায়ণ বাধ্যবাধকতা দ্বারা আপনার সাথী সুরক্ষিত থাকবে না, কিন্তু প্রেমময় মনোযোগ, বিবেচনা ও বিশ্বাস দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।

১৪ প্রেম “অত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব্ব করে না।” এটি সত্যি যে বহু লোক বড়াই করতে ভালবাসে কিন্তু খুব কম লোকেই তা শুনতে পছন্দ করে। আসলে, মিথ্যা বড়াইকারীকে যে কেউ ভালভাবে চেনে তাকে হয়ত সেটি লজ্জিত বোধ করাবে। কিছু ব্যক্তি হয়ত নিজের সম্বন্ধে দম্ভ করে বলতে ভালবাসে, আবার অন্যে সেই বিষয়টিই অন্যভাবে বলে থাকে। তারা সমালোচনা করে ও অপরকে ছোট করে এবং অপরের সাথে তুলনা করে তারা নিজেদের তাদের থেকে উঁচু বলে মনে করে। সুতরাং, একজন অপরকে নিচু করে নিজেকে উঁচু করে দেখাতে পারে। সাথীকে ছোট করা হল প্রকৃতপক্ষে নিজের সম্বন্ধে বড়াই করার এক উপায়।

১৫ আপনি কি কখনও আপনার সাথীর দোষত্রুটিগুলি সম্বন্ধে প্রকাশ্যে বলেন বলে, নিজেই বুঝতে পেরেছেন? আপনার সাথীর উপর তা কিরূপ প্রতিক্রিয়া করেছে বলে আপনি মনে করেন? যার দোষত্রুটিগুলিকে প্রকাশ করা হচ্ছে সে যদি আপনি হতেন তাহলে আপনি কিরূপ মনে করতেন? প্রেম প্রদর্শিত হচ্ছে বলে মনে করতেন? না, নিজের সম্বন্ধে প্রশংসা করে বা অপরকে ছোট করে প্রেম “আত্মশ্লাঘা করে না।” আপনার সাথীর সম্বন্ধে কথা বলার সময় গঠনমূলক হোন; সেটি আপনাদের দুজনের মধ্যে বন্ধনকে দৃঢ় করবে। এবং আপনার সম্বন্ধে যা বলা হয় সেই সম্বন্ধে হিতোপদেশ ২৭:২ পদের বিজ্ঞ পরামর্শ কাজে লাগান: “অপরে তোমার প্রশংসা করুক, এবং তোমার নিজ মুখ না করুক; অপরিচিত তোমার প্রশংসা করুক, তোমার নিজ ওষ্ঠ না করুক।”—রিভাইসড্‌ স্ট্যাণ্ডারড ভারশান।

১৬ প্রেম “অশিষ্টাচরণ করে না।” অনেক বিষয় আছে যা সম্পূর্ণরূপে অশোভন, যেমন পারদার্য, মদ্যাসক্তি এবং হঠাৎ অত্যন্ত ক্রোধ প্রদর্শন। (রোমীয় ১৩:১৩) প্রেমের বৈসাদৃশ্যে, এসকলই বিবাহ বন্ধনের ক্ষতি করে। কটুব্যবহার, অমার্জিত ভাষা ও আচরণ, তার সাথে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবহেলা করা, এই সবকিছুই মানব শোভনতার অভাব দেখায়। এই ক্ষেত্রে আপনার সাথীকে অপমানিত না করতে আপনি কতটা সাবধান থাকেন? আপনি কি আপনার স্বামী বা স্ত্রীকে বিবেচনা দেখান, উত্তম ব্যবহার, সম্মান করেন? যে বিবাহ সুখী, স্থায়ী তাকে এই সকলই সাহায্য করে।

১৭ প্রেম “স্বার্থ চেষ্টা করে না, রাগিয়া উঠে না।” প্রেম আত্মকেন্দ্রিক নয়। এই অধ্যায়ের প্রথমে যে দম্পতির সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে তারা যদি এই রকম হতেন তাহলে কত ভালই না হত। রাতের খাবার দেরি হওয়াতে স্বামী, স্ত্রীকে রুক্ষভাবে কথা বলতেন না এবং স্ত্রীও চেঁচিয়ে উত্তর দিত না। যদি স্ত্রী বুঝতে পারত যে স্বামী ক্লান্ত বলেই বিরক্ত বোধ করছেন তাহলে সে রেগে না গিয়ে হয়ত এইভাবে উত্তর দিত: ‘রান্না প্রায় হয়েই এসেছে। সারাদিন বোধহয় তোমার খাটুনি গেছে। টেবিল সাজাবার আগে, আমি তোমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা সরবৎ দিচ্ছি।’ অথবা স্বামী যদি শুধুমাত্র নিজের সম্বন্ধে চিন্তা না করে একটু বেশি বোধশক্তি দেখাতেন তাহলে তিনি হয়ত জিজ্ঞাসা করতে পারতেন যে সাহায্য করার জন্য কিছু করতে হবে কি না।

১৮ আপনার সাথী কিছু বললে বা করলে আপনি কি সহজে রেগে যান বা সেই কথা বা কাজের পিছনে উদ্দেশ্যটি কী তা আপনি বুঝতে চেষ্টা করেন? সেটি হয়ত কোন কিছু না ভেবে, না বুঝে করা হয়েছে, অপমান করার উদ্দেশ্যে করা হয়নি। আপনার যদি ভালবাসা থাকে তাহলে ‘সূর্য্য অস্ত না যেতে যেতে আপনাদের কোপাবেশ শান্ত’ হবে। (ইফিষীয় ৪:২৬) যদি আপনার সাথী বিরক্ত বোধ করে ও আপনাকে দুঃখ দেওয়ার জন্যই সেই কথাগুলি বলে বা কোন কিছু করে, তাহলে কী? রাগ শান্ত হওয়া পর্যন্ত কি আপনি অপেক্ষা করতে পারেন না এবং তারপর সে বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন? দুজনের জন্যই ভাল হবে এই মনে করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গেলে তা আপনাকে সঠিক বিষয়টি বলতে সাহায্য করবে। “জ্ঞানবানের হৃদয় তাহার মুখকে বুদ্ধি দেয়।” “যে অধর্ম্ম আচ্ছাদন করে, সে প্রেমের অন্বেষণ করে,” আরও বেশি ঝগড়ার সৃষ্টি করে না। (হিতোপদেশ ১৬:২৩; ১৭:৯) তর্ক করে যেতে এবং নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার প্ররোচনাকে দমন করে আপনি প্রেমের পক্ষেই জয়ী হবেন।

১৯ প্রকৃত প্রেম “অধার্ম্মিকতায় অনন্দ করে না, কিন্তু সত্যের সহিত অনন্দ করে।” নিজের সাথীকে প্রতারণা করা চালাকির বিষয় ভাবে না—সেটি সময় ব্যবহারের ক্ষেত্রে, টাকাপয়সা খরচ করা বা সংসর্গ সম্পর্কে হোক না কেন। ধার্মিক প্রদর্শন করতে অর্ধ-সত্য বলে না। প্রতারণা বিশ্বাসকে নষ্ট করে। প্রকৃত প্রেম থাকতে হলে, আপনাদের দুজনেরই সত্য কথা বলে আনন্দ পাওয়া উচিৎ।

প্রকৃত প্রেমের শক্তি ও সহ্য ক্ষমতা আছে

২০ “সকলই বহন করে, সকলই বিশ্বাস করে, সকলই প্রত্যাশা করে, সকলই ধৈর্য্যপূর্ব্বক সহ্য করে।” ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এই দুজন যখন পরস্পরের সাথে মানিয়ে নিতে এবং সহজবশ্য হতে শেখে তখন বিবাহে যে চাপ ও কষ্ট আসে প্রেম সেটি বহন করে। ঈশ্বরের বাক্যে যে সকল পরামর্শ দেওয়া আছে প্রেম তা বিশ্বাস করে ও মনপ্রাণ দিয়ে কাজে লাগায়, এমন কি যখন পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকে তখনও। যারা অসাধুতার আশ্রয় নেয় তাদের সাথে আচরণ করার সময়, প্রেম প্রতারণা না করে অহেতুক সন্দেহও করে না। পরিবর্তে, তা বিশ্বাস প্রদর্শন করে। আরও, এটি উত্তম কিছুর আশা করে। বাইবেলের পরামর্শ প্রয়োগ করলে যতটা সম্ভব ভাল ফল উৎপাদন করবে এই দৃঢ় নিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে, সেই আশা। তাই প্রেম গঠনমূলক, আশাবাদী এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিপাতকারী হতে পারে। তাছাড়া, এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল নয় বা শুধুমাত্র মোহাচ্ছন্ন অবস্থাও নয়। সত্য প্রেম সহ্য করে, যখন জীবন কষ্টকর হয় তখন সমস্যার মোকাবিলাও করে। প্রেমের স্থায়ী থাকার ক্ষমতা আছে। তা গভীরও বটে; সকল শক্তিসহ এটি দয়ালু, নম্র ও ত্যাগস্বীকারকারী হওয়ার জন্য জীবনযাপন করা সহজ হয়।

২১ সেই প্রকৃতির “প্রেম কখনও শেষ হয় না।” যদি কোন কঠিন পরিস্থিতি দম্পতিকে আর্থিক কষ্টের মধ্যে ফেলে, তখন কী হয়? অন্য কোন জায়গায় আরও সুখকর জীবন পাওয়ার আশা না করে, যে স্ত্রীয়ের সেই প্রকৃতির প্রেম আছে সে বিশ্বস্তভাবে তার সাথীকে সঙ্গ দেয়, মিতব্যয়ী হতে চেষ্টা করে ও হয়ত তার স্বামীর আয়ের অভাবও পূরণ করতে পারে। (হিতোপদেশ ৩১:১৮, ২৪) কিন্তু যদি স্ত্রী কোন রোগের ফলে বহু বছর অসুস্থ থাকে, তাহলে কী? যে স্বামীর এই প্রকৃতির প্রেম আছে, তিনি স্ত্রীয়ের প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে তার যতটা সম্ভব করেন, স্ত্রী এখন ঘরের যে কাজগুলি করতে অক্ষম তা করে সাহায্য করেন এবং তার বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তা দিতে তিনি সবকিছুই করবেন। ঈশ্বর স্বয়ং এই সম্বন্ধে উদাহরণ স্থাপন করেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেবকেরা যে কোন পরিস্থিতিতেই আসুক না কেন কোন কিছুই তাদের ‘ঈশ্বরের প্রেম থেকে পৃথক করতে পারেনি।’—রোমীয় ৮:৩৮, ৩৯.

২২ সেই প্রেম থাকলে কোন্‌ সমস্যা আর থাকতে পারে? আপনার বিবাহে কি তা আছে? আপনি কি ব্যক্তিগতরূপে তা প্রয়োগ করেন?

প্রেমকে বৃদ্ধি হতে দেওয়া

২৩ প্রেম, পেশীর মত, ব্যবহার করলে শক্তিশালী হয়। অপরপক্ষে, প্রেম আবার বিশ্বাসের মত, কার্যবিহীন মৃত। আমাদের অন্তরতম অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে যে কথাবার্তা ও কার্যগুলি করা হয় তাকে বলা হয় যে হৃদয় থেকে আসে, আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রেরণার প্রকাশ করে। “হৃদয় হইতে যাহা ছাপিয়া উঠে, মুখ তাহাই বলে। ভাল মানুষ ভাল ভাণ্ডার হইতে ভাল দ্রব্য বাহির করে।” কিন্তু যদি আমাদের অন্তরের অনুভূতি মন্দ হয় তাহলে “অন্তঃকরণ হইতে কুচিন্তা, নরহত্যা, ব্যভিচার, বেশ্যাগমন, চৌর্য্য, মিথ্যাসাক্ষ্য, নিন্দা আইসে।”—মথি ১২:৩৪, ৩৫; ১৫:১৯; যাকোব ২:১৪-১৭.

২৪ কী প্রকৃতির চিন্তাধারা ও অনুভূতি আপনি হৃদয়ে পোষণ করেন? ঈশ্বর কিভাবে প্রেম প্রদর্শন করেছেন সেই সম্বন্ধে আপনি যদি প্রতিদিন চিন্তা করেন ও তাঁর উদাহরণ অনুকরণ করতে চেষ্টা করেন তাহলে উত্তম প্রেরণা আরও শক্তিশালী হবে। আপনি যতই এই প্রেম প্রদর্শন করবেন ততই আপনি সেই প্রেম অনুসারে কাজ করবেন ও কথা বলবেন, আর সেটি আপনার হৃদয়ে আরও বেশি গভীরভাবে গেঁথে যাবে। ছোট ছোট বিষয়ে প্রতিদিন প্রেম প্রদর্শন করার অভ্যাস করলে সেটি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে। কখনও যদি কোন বড় প্রশ্ন ওঠে, তখন সেখানে সেই প্রেম দৃঢ় সুরক্ষিত থাকবে, আপনাকে তার মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।—লূক ১৬:১০.

২৫ আপনার সাথীর মধ্যে আপনি কি কোন প্রশংসনীয় বিষয় লক্ষ্য করেন? তাহলে প্রশংসা করুন! দয়া প্রদর্শন করতে আপনি কি প্ররোচিত হন? সেই প্ররোচনা দেখান! প্রেম পেতে হলে আমাদের প্রেম প্রদর্শন করতেই হবে। এইগুলি অভ্যাস করার দ্বারা আপনাকে ও আপনার সাথীকে ঘনিষ্ঠ করে তুলবে, আপনাদের দুজনকে একাত্মা করবে, দুজনের মধ্যে প্রেমকে বৃদ্ধি করবে।

২৬ প্রেমের বৃদ্ধি করতে হলে, বন্টন করে নিন। প্রথম মানুষ আদম পরমদেশে বাস করত। তার সমস্ত দৈহিক চাহিদাগুলি প্রচুররূপে পূরণ করা হয়েছিল। প্রথম থেকেই সে অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যে ঘেরা জায়গায় বাস করত। সেখানে শুধুমাত্র তৃণভূমি ও পুরাশি, বনজঙ্গল ও জলধারা ছিল তা নয়, কিন্তু বহু বিভিন্ন রকমের পশুপাখিরাও ছিল যারা, পৃথিবীর তত্ত্বাবধায়করূপে তার অধীনস্থ ছিল। তবুও এই সমস্ত থাকা সত্ত্বেও একটি চাহিদা পূরণ হয়নি: কোন মানুষের সাথে এই পরমদেশের সৌন্দর্য উপভোগ বন্টন করে নেওয়া। একটি আকর্ষণীয় সূর্যাস্ত অবাক হয়ে দেখার সময় আপনি কি কখনও একা থেকেছেন আর ভেবেছেন যে আপনার সাথে দেখার জন্য যদি কোন এক প্রিয়জন থাকত? অথবা আপনার কাছে হয়ত উত্তেজনামূলক সুসংবাদ ছিল কিন্তু তা বলার জন্য কেউ ছিল না? যিহোবা ঈশ্বর আদমের চাহিদাটি বুঝতে পেরেছিলেন এবং যার সাথে তার চিন্তা অনুভূতি সে ভাগ করে নিতে পারে এমন এক সাথী তিনি তাকে দিয়েছিলেন। বন্টন করে নেওয়া দুজনকে ঘনিষ্ঠ করে তোলে এবং প্রেমকে শিকড় গাড়তে ও বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে।

২৭ বিবাহ হল ভাগ করে নেওয়া। হয়ত, ঘরের মধ্যে ভালবাসার এক চাহনি, একটি স্পর্শ, দুটো মিষ্টি কথা, কোন কথা না বলে দুজনে এক সঙ্গে বসে থাকা। প্রত্যেকটি কাজই ভালবাসা প্রদর্শন করতে পারে: বিছানা পাতা, বাসন ধোয়া, স্ত্রী যা পছন্দ করে কিন্তু বাজেটে কুলাবে না বলে কখনও তা না চাইলেও তা কিনে দিতে পয়সা জমানো, কাজ পড়ে থাকলে স্বামী বা স্ত্রীকে সাহায্য করা। কাজ এবং খেলা, সমস্যা ও আনন্দ, সফলতা ও ব্যর্থতা, মনের চিন্তা এবং হৃদয়ের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়াই হল ভালবাসা। দুজনের মধ্যে একই লক্ষ্য রাখুন, একসঙ্গে সেই লক্ষ্যে পৌঁছান। সেটিই দুই ব্যক্তিকে একে পরিণত করে; আর সেটিই ভালবাসাকে বাড়িয়ে তোলে।

২৮ আপনার সাথীকে সেবা করলে, তার প্রতি আপনার প্রেমকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করবে। এক স্ত্রী সাধারণত খাবার রান্না করে, বিছানা করে, ঘর পরিষ্কার করে, কাপড় ধোয়ে, ঘরের কেনাবেচা সম্বন্ধে দেখাশোনা করে সেবা করে থাকে। সাধারণত স্ত্রী যে খাবার রান্না করে, যে বিছানা পাতে, যে ঘর সে পরিষ্কার করে, যে কাপড় সে কাচে, সেগুলি যুগিয়ে স্বামী সেবা করে থাকে। এই সেবা, এই দেওয়া আনন্দ দেয় এবং ভালবাসাকে বাড়িয়ে তোলে। যেমন যীশু বলেন নেওয়ার থেকে দেওয়াতে আনন্দ বেশি। অথবা, সেবা পাওয়ার থেকে সেবা করাতে বেশি আনন্দ আছে। (প্রেরিত ২০:৩৫) তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেন যে “তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, তাকে হতে হবে তোমাদের সেবক।” (মথি ২৩:১১, নিউ ইংলিশ বাইবেল) এই প্রকৃতির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিযোগিতামূলক আত্মাকে দূর করবে এবং আনন্দ যোগাবে। যখন আমরা সেবা করি তখন আমরা উপলব্ধি করি যে আমাদের প্রয়োজন আছে, উদ্দেশ্যকে সম্পন্ন করছি আর সেটিই আমাদের আত্ম-সম্মান দেয় ও তৃপ্ত করে। সেবা করতে ও সেই প্রকৃতির তৃপ্তি লাভ করতে, স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই বিবাহ প্রচুর সুযোগ দেয়, ফলে তাদের বৈবাহিক জীবন প্রেমে আরও সুদৃঢ় হয়।

২৯ বিবাহ সাথীদের মধ্যে যদি একজন ঈশ্বরের খ্রীষ্টীয় সেবক হন যিনি এই সকল বাইবেল নীতি পালন করে থাকেন কিন্তু অপরজন করে না, তাহলে কী? খ্রীষ্টীয় ব্যক্তি কিরূপ আচরণ করবেন সেই সম্পর্কে কি এটি পরিবর্তন আনবে? মুখ্যত নয়। খ্রীষ্টীয় ব্যক্তির পক্ষে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বেশি কথা বলার না থাকলেও, আচরণ তাকে একইভাবে করতে হবে। যিহোবার সেবকের মতই অবিশ্বাসী সাথীর সেই একই মূল প্রয়োজনগুলি আছে, কিছু ক্ষেত্রে তারা একইভাবে প্রতিক্রিয়াও করেন। এই সম্বন্ধে রোমীয় ২:১৪, ১৫ পদে বলা হয়েছে: “যে পরজাতিরা কোন ব্যবস্থা পায় নাই, তাহারা যখন স্বভাবতঃ ব্যবস্থানুযায়ী আচরণ করে, তখন কোন ব্যবস্থা না পাইলেও আপনাদের ব্যবস্থা আপনারাই হয়; যেহেতুক তাহারা ব্যবস্থার কার্য্য আপন আপন হৃদয়ে লিখিত বলিয়া দেখায়, তাহাদের সংবেদও সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষ্য দেয়, এবং তাহাদের নানা বিতর্ক পরস্পর হয় তাহাদিগকে দোষী করে, না হয় তাহাদের পক্ষে সমর্থন করে।” সাধারণত উদাহরণযোগ্য খ্রীষ্টীয় আচরণকে উপলব্ধি করা হয়ে থাকে এবং ভালবাসাকে গভীর করে।

৩০ প্রেম নিজেকে প্রকাশ করতে কোন নাটকীয় পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে না। কিছু ক্ষেত্রে, প্রেম এক বস্ত্রের মত। আপনার বস্ত্রকে কী একসঙ্গে ধরে রাখে? দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটি বড় বড় গেরো? অথবা সুতোর হাজার হাজার ছোট সেলাই? হাজার হাজার ছোট সেলাই বস্ত্রকে ধরে রাখে, তা আমরা আক্ষরিক বস্ত্র বা আত্মিক “ভূষণ”, যে সম্বন্ধেই বলি না কেন, সেটি সত্য। এটি হল প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা ও করা কাজের ক্রমাগত একত্রীকরণ, যে “বস্ত্র” কোনদিন ছিঁড়বে না এবং আক্ষরিক বস্ত্রের মত মূল্যহীন হবে না। বাইবেল বলে এটি হল, ‘অক্ষয় ভূষণ।’—১ পিতর ৩:৪.

৩১ আপনি কি চান আপনার বিবাহ “সিদ্ধির যোগবন্ধন” দ্বারা একত্রে থাকুক? তাহলে কলসীয় ৩:৯, ১০, ১২, ১৪ পদের পরামর্শ অনুসারে কাজ করুন: “তোমরা পুরাতন মনুষ্যকে তাহার ক্রিয়াশুদ্ধ বস্ত্রবৎ ত্যাগ করিয়াছ, এবং সেই নূতন মনুষ্যকে পরিধান করিয়াছ, . . . করুণার চিত্ত, মধুর ভাব, নম্রতা, মৃদুতা, সহিষ্ণুতা পরিধান কর . . . প্রেম পরিধান কর; তাহাই সিদ্ধির যোগবন্ধন।”

[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]

১-৬. (ক) যখন বিবাহ সাথীরা নিজেদের অনুভূতিতেই নিমগ্ন থাকেন তখন কী হয়? (খ) কোন্‌ শাস্ত্রীয় নীতিগুলি অনুসরণ করলে গুরতর তর্কবিতর্কের সৃষ্টি করাকে রোধ করা যেতে পারে?

৭-৯. (ক) প্রথম করিন্থীয় ১৩:৪-৮ পদে প্রেম কিভাবে বর্ণিত হয়েছে? (খ) এই প্রেম কী প্রকৃতির?

১০, ১১. যে বিবাহ সাথী চিরসহিষ্ণু ও মধুর ভাব দেখায় তার কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি?

১২, ১৩. ঈর্ষা কিভাবে প্রকাশ পায় এবং সেটিকে দমন করার জন্য কেন প্রচেষ্টা করতে হবে?

১৪, ১৫. (ক) বড়াই করা কিভাবে প্রেমের অভাবের প্রকাশ করে? (খ) সাথীকে ছোট না করার পরিবর্তে একজনের কী করা উচিৎ?

১৬. কোন্‌ অশিষ্টাচারগুলি এক প্রেমময় ব্যক্তি এড়িয়ে চলবেন?

১৭. যে ব্যক্তি নিজের স্বার্থ চেষ্টা করে না তিনি কিভাবে ঝগড়া এড়িয়ে চলতে পারেন?

১৮. প্রেম কিভাবে একজনকে উত্তেজিত হওয়ার থেকে বিরত করে?

১৯. (ক) ‘অধার্মিকতায় আনন্দ না করার’ মধ্যে কী অন্তর্ভুক্ত হতে পারে? (খ) কেন তা এড়িয়ে চলা উচিৎ?

২০. কিভাবে প্রেম (ক) ‘সকলই বহন করে’? (খ) ‘সকলই বিশ্বাস করে’? (গ) ‘সকলই প্রত্যাশা করে’? (ঘ) ‘সকলই ধৈর্য্যপূর্বক সহ্য করে’?

২১, ২২. কতগুলি কোন্‌ পরিস্থিতি প্রদর্শন করে যে প্রেম কখনও শেষ হয় না?

২৩. আমরা প্রেমের কাজগুলি করব কি না তা কী নির্ধারণ করে?

২৪, ২৫. ভালবাসা দেখাতে আপনার প্রেরণাকে কিভাবে আপনি সুদৃঢ় করতে পারেন?

২৬, ২৭. বিষয়গুলি বন্টন করে নেওয়া কিভাবে একজনের ভালবাসাকে গভীর করে তোলে?

২৮. সেবা করা কিভাবে ভালবাসাকে বৃদ্ধি করে?

২৯. এমন কি যারা ঈশ্বরের সেবক নন তাদের কাছেও কিভাবে প্রেম আকর্ষণীয় হয়?

৩০. নাটকীয় পরিস্থিতিতেই কি শুধুমাত্র ভালবাসা দেখানো দরকার? আপনি কেন সেইরূপ উত্তর দেবেন?

৩১. কলসীয় ৩:৯, ১০, ১২, ১৪ পদে প্রেম সম্বন্ধে কোন্‌ উত্তম পরামর্শ দেওয়া আছে?